“শিশুশ্রম বন্ধের আবশ্যকতা” বিষয়ে প্রধান অতিথির একটি ভাষণ তৈরি কর।
শিশুশ্রম বন্ধের আবশ্যকতা
‘শিশুশ্রম বন্ধের অবশ্যকতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, আলোচকবৃন্দ,
উপস্থিত সুধী মণ্ডলী, এতক্ষণ ধরে শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে সম্মানিত আলোচকবৃন্দ যে
কথাগুলো বলেছেন, তার বাইরে কিছু বলা সম্ভব নয়। আমার সব কথাই তাঁরা বলে গেছেন।
তাঁদের পরামর্শ সমর্থন করে নিয়ে আমি সংক্ষেপে কিছু বলতে চেষ্টা করব।
আমরা একটা কথা প্রায়শই বলি, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। সেটা
কীভাবে, তাঁর ব্যাখ্যা আপনাদের অজানা নয়। আবার কথায় কথায় আমরা বলি, শিশুরাই
আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? পাঁচ বছর বয়স থেকে কলকারখানায়,
গ্যারেজে, ওয়ার্কশপে কাজ করে, গাড়ির হেলপারি করে, ইট-পাথর ভাঙার কাজে যোগ
দিয়ে, পিতা-মাতা পরিবারের স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে, স্কুলে না গিয়ে, লেখাপড়া
না শিখে, নিরক্ষর থেকে, নানা রকম রোগে ভুগে, জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে বেঁচে থেকে? মোটেই
না। শিশুরা কীভাবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে? এগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো শিশুই
জাতির ভবিষ্যৎ হতে পারবে না। এসব করে কোনো শিশুই তার পিতার স্বপ্ন, দেশের স্বপ্ন
পূরণ করতে পারবে না। শিশুদের দিয়ে আমরা অল্প বেতনে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু
দুবেলা খাবারের বিনিময়ে যে সুবিধা নিই, তা শুধু তাদের জন্য ক্ষতিকর নয়, আমাদের
জন্যও আত্মঘাতী।
আমরা অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমিতিতে, সেমিনারে শিশুশ্রম বন্ধের জন্য বড় বড় কথা
বলি, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা করি না। প্রথমে আমাদের এ স্ববিরোধী কার্যক্রম
বন্ধ করতে হবে। সরকার শিশুশ্রম বন্ধের জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো পালন
করতে হবে এবং যারা তা অমান্য করছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। শিশুকে
পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এসব
কথা আজকের অনেক বক্তাই এখানে আপনাদের বলেছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে শিক্ষা। আমরা
যদি শিশুদের যথাযথভাবে শিক্ষার আওতায় না আনতে পারি তাহলে জাতীয় উন্নতি সম্ভব
হবে না। কারণ শিশুরা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে না উঠলে তারা দেশের জন্য অকল্যাণকর
কাজের কর্মী হয়ে উঠবে। তাতে দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি ব্যাহত হতে বাধ্য।
শিশুশ্রমের ভয়াবহ পরিণতি এবং শ্রমবাজারে শিশুদের অমানবিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক
আলোচক অনেক পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। আমার কাছে এমনই একটি পরিসংখ্যান আছে।
আইএলও'র হিসাবমতে পৃথিবীতে শ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ।
এদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ। এশিয়া প্রশান্ত
মহাসাগরীয় অঞ্চলেরই রয়েছে ১২ কোটি ৭০ লাখ শিশুশ্রমিক। বিশ্বের প্রতি ৬ শিশুর
মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম, পাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন
প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার শিশু মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
বাংলাদেশে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের অবস্থা আরও করুণ।
তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা তাদের টোকাই
বলে, পিচ্চি বলে ডাকি। আমাদের এ আচরণ বন্ধ করতে হবে। সারাদেশে অব্যাহতভাবে
শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে। দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসায়
প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় এখনও বেআইনিভাবে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শিশুশ্রম
বন্ধের কঠোর আইন থাকলেও সে আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকার কারণে শত
চেষ্টা করেও শিশুশ্রম বন্ধ করা যায় না। অথচ অবশ্যই তা বন্ধ করতে হবে। আজকের
অনুষ্ঠানের আলোচকদের এ বিষয়ে নানা পরামর্শের সারসংক্ষেপ করে আমি বলতে চাই যে,
শিশুশ্রম বন্ধের জন্য—
- শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
- শিশুশ্রমে নিয়োগকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিশুশ্রমে শিশুর পিতা-মাতা এবং সমাজের মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
- শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আশা করি, আজকের আলোচনা আপনাদেরকে শিশুশ্রম বন্ধের ব্যাপারে উৎসাহিত করবে। শিশুর
জন্য সুন্দর জীবন বয়ে আনুক আজকের আলোচনা- এ প্রত্যাশায় শেষ করছি। সবাইকে
ধন্যবাদ।