ভূমিকা : ‘বইমেলা’ শব্দটা শুনলেই বোঝা যায়, এই আয়োজনটি বই নিয়ে আর তা নিয়ে আসে উৎসবমুখর এক আমেজ। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বইমেলাগুলো অন্যতম হলো একুশে বইমেলা। ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত এই মেলাটি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে পরিচিত। প্রতিবছর এই মেলা পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও আমি চলে গিয়েছিলাম অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। প্রিয় লেখকদের বই কেনা, বইয়ে তাদের অটোগ্রাফ নেওয়া, অজানা বইগুলো সংগ্রহ করাসহ বন্ধুদের সাথে সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা দিয়ে অনাবিল আনন্দে কেটেছে আমার বইমেলায় ঘোরাঘুরির সে দিনটি।
বইমেলা : এদেশে বইমেলার চিন্তাটি প্রথম মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদ্দীনের। তার উদ্যোগেই ১৯৬৫ সালে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
লাইব্রেরির নিচতলায় প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বইমেলার প্রবর্তন করেন চিত্তরঞ্জন সাহা। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন 'সুসম্পন্ন হয়। আর সেটির আয়োজন করেন তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা। এরপর থেকে প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে একুশে বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে। বাঙালি জাতিসত্তার উদ্বোধনের স্মৃতিবাহী একুশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা যুক্ত হয়ে মেলাটি এখন নতুন আঙ্গিকে, পরিসরে ও মাত্রিকতায় উন্নীত হয়েছে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা/বইমেলায় আমার একদিন : বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে উদ্যাপিত হয়। এক্ষেত্রে ছুটির দিন ও ছুটির দিন বাদে অন্যান্য দিনে পৃথক সময়ে মেলা শুরু হয়। প্রবেশের জন্য কোনো ফি ধার্য করা হয় না। তবে প্রবেশপথে থাকে পুলিশ চেকপোস্ট। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা প্রান্তে জঙ্গি হামলার কারণে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতা থেকে দর্শনার্থী ও ক্রেতা-সাধারণকে নিরাপত্তা দিতেই সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশ চেকপোস্টে ছেলেরা ও মেয়েরা আলাদা লাইন ধরে মেলায় প্রবেশ করে। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় সকাল ১১টাতেই মেলা শুরু হয়। এছাড়া অন্যান্য দিন কর্মজীবীদের কথা বিবেচনা করে মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টার পর। আমি ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবারে মেলায় গিয়েছিলাম। তাই বেশি সময় মেলায় ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলাম। এজন্য অন্য সকলের মতো আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছিলাম।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ : এ বইমেলায় বর্ধমান হাউজ সংলগ্ন এলাকা থেকেশুরু করে বাংলা একাডেমির পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র, পুকুরপাড়ের চারপাশ, বাংলা একাডেমির মূলভবন ও মিলনায়তনের চারপাশের প্রায় সবটা জুড়েই বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল বসে। মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম, রফিক, জব্বার, রকত, শফিউর এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো কৃতি ব্যক্তিদের নামে ভাগ করা হয়। এই মেলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বহু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও তাদের স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ করে। আমি বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ঘুরে, শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ আরাে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল দেখতে পেলাম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইগুলো প্রধানত বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণেই দেখেছি। আর প্রায় সারাক্ষণই মেলায় নতুন আসা বইগুলো ঘোষণা শুনতে পেয়েছি।
নজরুল মঞ্চ, তথ্যকেন্দ্র ও লেখককুঞ্জ : মেলাতে থাকে লেখককুঞ্জ এবং সেখানে প্রায়শই বিভিন্ন লেখক উপস্থিত থাকেন। তারা বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সাথে মতবিনিময় করেন। লেখককুঞ্জে গিয়ে আমি বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য লেখক-সাহিত্যিকের দেখা পেলাম, তাদের সাথে কথা বলার সুযােগ পেলাম। মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন বইগুলো নাম, এসব বইয়ের লেখক ও প্রকাশকের নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল। এরই সাথে দৈনিক প্রকাশিত বইয়ের সামগ্রিক তালিকাও লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল। এসময় আমি নজরুল মঞ্চে দাঁড়িয়ে কয়েকটি
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম।
লিটলম্যাগ চত্বর : বর্তমানে অমর একুশে বইমেলায় বেশ জনপ্রিয়তার সাথে স্থান করে নিয়েছে লিটল ম্যাগাজিন। বিশেষকরে তরুণ লেখকদের লেখা প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম হলো লিটল ম্যাগাজিন। তাই এই চত্বরে তরুণ লেখকদের আনাগোনাই সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য স্টলের পাশাপাশি বর্ধমান হাউজের পেছন দিকে গোল করে এই লিটল ম্যাগাজিনের স্টলগুলো বসে। আমি বেশ কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনও কিনলাম।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পুকুরপাড়ের পিঠা উৎসব : বাংলা একাডেমির পুকুরপাড় সংলগ্ন স্থানে নানারকম খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তবে এসবকিছুর মধ্যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল পিঠার দোকান। ঐতিহ্যবাহী নানা পিঠা দিয়ে স্টল সাজিয়ে বসেছিল বিক্রেতারা। একদিকে পিঠা বানানো হচ্ছিল, অন্যদিকে গরম পিঠায় কামড় বসাচ্ছিল মানুষ। ভাপা, পুলি, পাটিসাপটা, চিতই, মালপোয়া প্রভৃতি হরেক রকম পিঠার স্বাদে মগ্ন ছিল ক্রেতারা।
বাংলা একাডেমি থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বইকেনা : বাংলা একাডেমির স্টলগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে দুপুর পেরিয়ে গেল। তাই দুপুরের খাওয়া সেরেই আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানস্থ মেলার বাকি অংশে ঢুকে পড়লাম। এসময় আমার সাথে বন্ধু মিলি ও সুতপাও এসে শামিল হলো। আমরা তিনজনই বই কেনা শুরু করলাম। মেলা প্রাঙ্গণের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো প্রাণটি পলিথিন ও ধূমপান মুক্ত। তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা যেমন সিডি, ভিসিডি প্রভৃতিও স্থান করে নিয়েছে এ মেলায়।
মুক্তমঞ্চে নাটক ও চ্যানেলে সাক্ষাৎকার : মেলা ঘুরে ক্লান্ত হয়ে আমরা মুক্তমঞ্চে গিয়ে বসলাম। মুক্তমঞ্চে মেলা চলাকালীন নানা পথনাটক, মঞ্চনাটক ও অন্যান্য পরিবেশনা হয়। আমরা বিশ্রাম নিতে নিতে দুটো পথনাটক দেখলাম। এরপর আমরা বইগুলো নিয়ে টেলিভিশনের এক রিপোর্টার অনুরোধে মেলা বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিলাম।
বইকেনা ও মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ : বাংলা একাডেমির নিজস্ব স্টল থেকে আমরা বেশ কয়েকটি বই কিনলাম। কেননা তাদের সংগ্রহের বইগুলো ভিন্ন ধাঁচের হয়। এছাড়া বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান, প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ ও উচ্চারণ অভিধানও কিনলাম। এভাবে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত একটা দুটো করে অনেক বই কেনা হয়ে গেল। সন্ধ্যার পরপরই আমরা মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করলাম।
উপসংহার : কত ধরনের মেলাতেই না আমরা যাই, তবে বইমেলার আবেদন সবচেয়ে আলাদা। এই আবেদন কোনো ভাবেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। আর তাই প্রতিবারের মতো এবারও বইমেলায় গিয়ে অনাবিল আনন্দে আমার দিন কেটেছে। তাছাড়া প্রিয় লেখকদের বেশকিছু নতুন বই কিনেছি আমি যা আমার আকাঙ্ক্ষাকে তৃপ্ত করবে। বস্তুত একজন সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে বই পড়ার বিকল্প নেই। আর এক্ষেত্রে বইমেলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।