ভূমিকা : বাঙালির জাতীয় চরিত্রের মধ্যে লুক্কায়িত আছে এক প্রাণশক্তি। যে শক্তি একদিকে বাইরের রাজনীতিক ও ধর্মীয় ঝড় তুফানের হাত থেকে রক্ষা করেছে। অপরদিকে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, মন্বন্তরও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বাঙালির সে শক্তিকে ধ্বংস করতে পারেনি। আর সে শক্তিই হলো বাঙালির সংস্কৃতিক চেতনা। এ সংস্কৃতি হলো বাঙালির প্রাণের সৃষ্টি।
সংস্কৃতির স্বরূপ : ল্যাটিন ‘কালচারা’ শব্দ থেকে ইংরেজিতে ‘কালচার’ শব্দটা এসেছে। ‘কালচারের’ একটা অর্থ ‘কর্ষণ’। কালচারের সমার্থক শব্দ বাংলায় ‘সংস্কৃতি’। সংস্কৃতি শব্দটা বেশ ব্যাপক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেছেন-
কমল হিরের পাথরকে যদি বিদ্যা বলা যায় তবে তাহা হইতে যে দ্যুতি বাহির হয় তাহাই কালচার।
অর্থাৎ সংস্কৃতি অর্থ বলা যায় উজ্জ্বলতা। এই উজ্জ্বলতা তার সমগ্র ভাবজীবনের এই অন্তরঙ্গ ভাবজীবনের প্রকাশ ঘটে একটা জাতির চাল-চলন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সামাজিক রীতিনীতি, সংগীত, আচার-বিচার, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা, ললিতকলা, শিল্পপ্রবণতার সকল কিছুর মধ্যে।
বাংলার সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ : বাঙালি শংকর জাতি। নৃতত্ত্ববিদরা অনুমান করেন বাঙালি অস্ট্রিক জাতির শাখা থেকে এসেছে, আবার দ্রাবিড় জাতির প্রভাবও এদেশে আছে। তাই আর্যরা যখন এদেশে এলো তখন আর্য-অনার্য সংস্কৃতি মিলেমিশে এদেশে এক মিশ্র সংস্কৃতির সৃষ্টি করল। আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলোতে, পদাবলি সাহিত্যে এই মিলনের প্রভাব দেখা যায়। মুসলমান আমলের আগে এদেশে পৌরাণিক সংস্কারে ভরা ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা চালু ছিল। তাছাড়া বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বাংলা সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছিল। মুসলমান শাসকেরা এদেশে বসবাস শুরু করলে ইসলামীয় সংস্কৃতির নানা প্রভাব বাঙালি সংস্কৃতির পড়তে থাকে। মুসলমান সুলতানরাও বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলেন। ফলে সুফি সাধকদের চিন্তাধারা আমাদের বাউল গানকে সমৃদ্ধ করল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ রাজত্বকালে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতিতে নবজাগরণের সূচনা হয়। তাই বলা যায়, বাংলায় সংস্কৃতি একক উপাদানে তৈরি নয়, নানা সংস্কৃতির পলি পড়ে এত মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বাঙালি কাউকেই দূরে সরিয়ে রাখেনি, সে সবাইকেই গ্রহণ করেছে। সকলের সংস্কৃতির তিল তিল সোনা সংগ্রহ করে সে রচনা করেছে অনবদ্য তিলোত্তমা মৃতি-বাংলার সংস্কৃতি।
বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি : বাঙালি তার বিশেষ ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সহায়তায় এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি তৈরি করতে পেরেছে। কালের প্রয়োজনে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির নানা আধুনিকীকরণ ঘটেছে। বাঙালি হলো অতিথিপরায়ণ ও আবেগপ্রবণ জাতি। অধিকাংশই কৃষিজীবী হওয়ার কারণে তাদের ন্যূনতম খাওয়াপরার জন্য তেমন একটা মাথা ঘামাতে হয় না, অধিকাংশ সময়ই তাদের অবসর, কিন্তু তারা কর্মবিমুখ নয়। তাদের ঘরে সারা বছরই থাকে উৎসবের আয়োজন। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সৃজনশীলতা। বাঙালির নিত্যকর্মের মধ্য দিয়েই তাদের সহজাত সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। গৃহসজ্জা, সুচিশিল্প, পাটশিল্প, মৃৎশিল্প, রেশমশিল্প, স্থাপত্যশিল্পে বাঙালি তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। যা বিশ্বদরবারে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচয় দিয়ে এক বিশেষ স্থান অর্জন করেছে।
বাঙালির সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য : বাঁঙালি সংস্কৃতির অনুপন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তার চাল-চলনে, আচার-ব্যবহার, পোশাকে-পরিচ্ছদে, তার আহারে-বিহারে, তার রুচি ও মননে, শিল্প-সাহিত্যে, চিত্রকলায়, নৃত্যচর্চায় তথ্য সকল দিকে। বাঙালির ঢোলক বাজানো, গাছের কাজ কুঁদে নৌকা বানানো, বাঙালির কীর্তন, উগান, নিজস্ব অলংকার বানানোর পদ্ধতি, চাল ও চিড়ের সাহায্যে নানান খাবার বানানো, বাঁশের বাঁশিতে সুর তোলা, পুথিপাঠ, বাঙালির চট্টীপাঠ, বাঙালি নারীর শাড়ি পরা, বাঁশ ও বেতের নানা কাজে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে। বাঙালির ভাটিয়ালি, বাউল ও মুর্শিদী গান সংগীত রুচিশীলতার একটি মাধ্যম। নদীমাতৃক বাংলা তার সন্তানকে দিয়েছে শিল্প-সাহিত্যের ঝোঁক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর সন্তান। এছাড়া বাংলার শাখা ও শঙ্খের কাজ। চারুকলা ও কারুকলা বাঙালির সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ।
সংস্কৃতির সংকট : অবশেষে বাঙালির সংস্কৃতির জীবনে এলো চরম সংকট মুহূর্ত। এলো অন্ধকারের কালরাত্রি। আর্থনীতিক নিশ্চয়তা সে হারাল। বিশ্বাসবোধে লাগল ভাঙনের প্রচণ্ড আঘাত। বিদেশি সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুকরণের পথ ধরে এলো পশ্চিমা সংস্কৃতি। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল যন্ত্র-সভ্যতার বিষবাষ্প। শুরু হলো অপসংস্কৃতির এক নতুন অধ্যায়। সমাজের সর্বস্তরে বিকৃত জাতিকে আজ যেন গ্রাস করতে উদ্যত। সাহিত্যের নামে কুরুচিপূর্ণ রচনা বাজার ছেয়ে ফেলেছে। সৎকার্য ও সৎচিন্তার মধ্য দিয়ে প্রকৃত ধর্মকর্ম আজ অনুপস্থিত, ধর্মের নামে কুশিক্ষা, সমাজসেবার আমে দলাদলি। সংগীতের নামে হইচই এবং বেশভূষার নামে হাস্যকর অনুকৃতি সাংস্কৃতিক জীবনে গ্লানি ও মিথ্যাচারে পুঞ্জীভূত করেছে।
উপসংহার : বাঙালি সংস্কৃতির মূল স্রোতধারায় মিশে আছে বহু ধারা। যুদ্ধ, মহামারি, রাষ্ট্রবিপ্লব, বিজাতীয়ভাবের প্রভাবে বাঙালি জাতি বহুবার পর্যুদস্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁর সংস্কৃতির মৌল, শাশ্বত রূপটি স্রোতধারার মতো নিত্যবহমান। তাই বাঙালিরা সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য। যাতে হারিয়ে না যায় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। তা না হলে বাংলার সংস্কৃতি তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলবে।