সূচনা : বন্ধুরা বলেন, আমি নাকি ঘরকুণো। অনেক চেষ্টা করেও তারা আমাকে ঘরের বাইরে নিতে পারেন না। আর যদিও বা পারেন তখন আবার আমাকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেন। কেননা, আমি কথা কইতে পারি না, চুপ করে থাকি। যাঁরা অপরিচিত তাঁরা আমাকে ভাবেন অহংকারী এবং এই মিথ্যা ধারণা ভাঙাবার কোন উপায় না দেখে বন্ধুরাও হন বিব্রত। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন যে, আমি সরাকেই (আমার ঘর) ধরা জ্ঞান করি।
গুরুত্ব : কথাটা হয়ত প্রতিবাদের যোগ্য। তবু মনে হয়, এর মধ্যে সত্যতাও আছে। এই ঘরে বসেও বাইরের জগতের সঙ্গে একটা সহজ যোগাযোগের উপায় আমার আছে। তা হল দক্ষিণের জানালাটা। ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলে বৃহৎ জীবনের যে আভাস আমার প্রত্যক্ষগোচর হয়, অনেক সময় হৈ চৈ করে সারাটা দিন বাইরে কাটালেও তা সম্ভবপর হয় কিনা সন্দেহ। কেননা, সবান্ধব আমরা যখন বাইরে যাই, তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বা নিজেদের জাহির করতে আমরা এত ব্যস্ত থাকি যে, সেই উচ্ছ্বাসের চারপাশটাকে আমরা নিয়তই অবহেলা করি।
প্রকৃতি : আমার জানালার একটু পরেই একটা অপ্রশস্ত রাস্তা। এদিকটা খুব জনবহুল নয় বলে লোক চলাচলও তত প্রচুর নয়। একটা টিউব-ওয়েল সরকারী বদান্যতার নমুনাস্বরূপ রাস্তায় শোভা পাচ্ছে। কলতলার কলরব শুনতে শুনতে প্রায়ই ঘুম ভাঙ্গে। বুঝি, নতুন দিনের সূচনা হয়েছে, সকলেই নিজের কাজকর্ম আরম্ভ করেছে। একটু পর রাস্তা দিয়ে অফিসের কর্মচারীরা ছাতা মাথায় খবরের কাগজ হাতে, সাইকেলে চড়ে কিংবা পদযুগল ভরসা করেই ছুটে চলেন। স্কুলের ছেলেরা যায় তারপর একটি দুষ্ট ছেলে রোজ তাকে এক পায়ের চটিটাকে ছুঁড়ে ফেলে সামনের দিকে। ঐ পর্যন্ত পৌছে চটিটাকে পায়ে গলিয়ে আরেক পার্টি ছুঁড়ে দেয় সামনে। এই করে সে যাবে আর আসবে।তারপর গান গাইতে গাইতে আসে সেই অন্ধ ভিক্ষুকটা বাচ্চা ছেলেটি তার পথ দেখায়। তারপর আবার যখন এসে জানালার ধারে বসি, তখন সকালে যাদের দেখেছিলাম, তারা ঘরে ফিরছে। সন্ধ্যা হয়। চারদিকের আলো আসে কমে। রাত্রি গাঢ় হলে এই এলাকার দোকানী শ্রেণীর লোক রাস্তায় ক্যারম খেলতে বসে।
কল্পনা : আমার ঘরের জানালাটাকে মনে হয় একটা স্থায়ী ফ্রেম— যার মধ্যে নানা সময়ের নানা ছবি ভেসে ওঠে ৷ জীবনের টুকরো টুকরো ছবি সবকটা এগুলোকে বিছিন্ন করে দেখলেও অনেক ছবির মালা গাঁথা যায়, মনে মনে অনেক কথা কল্পনা করে নেওয়া যায়— প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘হয়ত’ গল্পের মত। কী বিচিত্র জীবন মানুষের। জীবিকার তাড়নায়, ভবিষ্যতের কল্পনায় মানুষ কী না করছে। তারপর একেকদিন কত কান্নার মাঝ দিয়ে এই রাস্তা দিয়েই তাকে চলে যেতে হয়। তেমনি আবার, যে মেয়েটিকে আবাল্য দেখছি, শানাই বাজিয়ে একদিন সেও চলে যায় নতুন জীবনের সূচনা করতে। জীবনের মানে কি অনিশ্চিত ভ্রমণ? জীবন কি পর্বে পর্বে সাজানো? কবির বাণী মনে পড়ে।
দিন কতকের মেয়াদের শুধু
ধার করা এই জীবন মোর,
হাস্য মুখে ফেরত দেবো
সময়টুকু হলেই ভোর।
জানালা থেকে দেখি বলেই জীবনটাকে টুকরো করে দেখি। তার আদিঅন্ত কিছু জানিনে। হঠাৎ কখনও টের পাই, সেই অন্ধ ফকিরটা আর গান গেয়ে ভিক্ষা করতে আসে না। হঠাৎ কোন দিন দেখি, অফিসে যাওয়ার সময় চলে যাবার পর কেউ মন্থরগতিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কি ব্যাপার? বোধ হয় তার ছাটাই হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করতে বাধে আমার। তারপর সেই দুষ্ট ছেলে নিয়মিত পরীক্ষা পাশ করল কিনা, সেই নববধূ জীবনে সুখশান্তির মুখ দেখল কিনা, কে জানে।যেমন মানুষের জীবন, তেমনি প্রকৃতি। মেঘে মেঘে সূর্য যে কত ছবি এঁকে যায় রঙের ছটায়, সে বুঝি বোঝা যায় না আমার জানালা থেকে না দেখলে। শরতের প্রভাতে, বর্ষার দুপুরে, বসন্তের রাতে প্রকৃতির কী বিচিত্র সাজ। শীতে দেখি দূরে গাছটার মাথা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে-কেবল নিষ্পত্র ডালগুলো ছন্নছাড়া ছেলের মত মাথা উঁচিয়ে থাকে। তারপর একদিন তাতে সবুজের ছোঁয়া লাগে একটুখানি। তারপর নতুন পাতায় যায় ভরে। তখন যেমন তার শোভা তেমনি তার চাঞ্চল্য।
উপসংহার : এমনি করে আমার জানালা থেকে আমি বাইরের জগৎটাকে দেখি। বড় ভাল লাগে। দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও কী বিপুল সংগ্রাম করছে মানুষ জীবনের জন্য। আর প্রকৃতির কী বিপুল সমারোহ। কে যেতে চাইবে তাকে ছেড়ে। জীবন ও প্রকৃতি নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আমার সামনে। আর আমার মনে হয়। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। কিংবা এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।