আজ আমার মন বড় অশাস্ত। এক অন্তর্যদের বিশাল ঢেউ আমার চিত্তকে ক্ষুগ্ধ করে তুলেছে। নিজেকে চেনার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। কি আমার পরিচয়? আমি কি নামসর্বচ্ছ এক ভৌগোলিক সংজ্ঞামাত্র? না কি শুধুমাত্র প্রকৃতির খেলার হাতিয়ার? চলছি তো চলছিই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই, এই যে অনাদি অনন্ত জীবনপ্রবাহ এর কি কোন তাৎপর্য নেই? এ জগতে আমার পরিচয় কি মঙ্গলদাত্রী রূপে, নাকি ভীষণ ভয়ংকরী রূপে!
এই তো আমার বা কোল ঘেঁষে উঠেছে সুবিশাল জনপদ। কত ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাণিজ্যকেন্দ্র রয়েছে সেখানে। এটি কী আমার জন্য নয়? ডান কোল ঘেঁষে তাকাও। যতদূর দৃষ্টি যায়— কেমন সবুজ শ্যামল। নানা বর্ণের শস্যের মাঠ কেমন সরস লাবণ্যে উপচে পড়ছে। এখানে কী আমার কোন ভূমিকা নেই? অথচ দেখ বছর দশেকের সাঁতার না জানা একটি বালক আজ সঙ্গীদের সঙ্গে গোসল করতে এসে আমাতে ডুবে মরেছে, এটাও কী আমার দোষ? বালকটির শোকাতুর মা যখন বিলাপ করে কাঁদছিল তখন আমারও তো মনে হয়েছিল আমার বুকের সব জল বুঝি তার দুঃখে অশ্রু হয়ে বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও সেই নারী আমায় তিরস্কার করল রাক্ষসী বলে। অভিশাপ দিল- আমার মতো তোর বুকও খাঁ খাঁ হবে। আমি চম্কে উঠেছিলাম তখন। সত্যিই কী আমি রাক্ষুসী? তাই কী একদিন আমার জলধারা শুকিয়ে যাবে? শুকনো বালিয়াড়ি আর বালির চরা জলের দাগ নিয়ে আমি পড়ে থাকবো মৃত? তবে যে জানতাম আমার লয় নেই, বিনাশ নেই? তাই মন আজ স্মৃতির পাতা উলটে দেখছে আমার কী পরিচয়। কী আমার সুকীর্তি, কী আমার বিধ্বংসী রূদ্রতা।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, আমি একটা নদী। জানি, অমনি প্রশ্ন করবে নদী, তোমার নাম কি? আমি বলব- নামে কিবা আসে যায়? কাজেই পরিচয়। আমাকে তোমরা যে নাম দাও সেই নামেই আমি খুশি। তাইতো দেশে দেশে পথে পথে আমার বিভিন্ন নাম। আমি কখনো গঙ্গা, কখনো পদ্মা, আবার কখনোবা মেঘনা। আর দেশ? ‘তোমার বাড়িই আমার বাড়ি, আমার বাড়ি নেই।’ যে দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাই, সে দেশই আমার দেশ। তবে হ্যা, সুনির্দিষ্ট জন্যজ্ঞান আমার আছে। সেটি যদি দেশ ধরো তবে তা হলো হিমালয়ের পাদদেশ। গঙ্গোত্রী হিমবাহের বিশাল বরফের স্তর গলে আমি নেমে এসেছি। জন্মেই দেখি আমার হৃদয় এক উন্মাতাল আনন্দে পরে, থরো। বাঁধ না মানা এক চঞ্চল বেগ আমাকে কেবলই ছুটিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সামনে। প্রবল বেগে রূপালি জলধারা নক্ষত্র চূর্ণের মতো উৎক্ষিপ্ত করতে করতে উঁচুনিচু পাথরের পর পার হই। এক সময় পেয়ে যাই সমতল ভারত ভূমি।
বয়সেও তখন আসে তারপোর লাবণ্য। অবাক বিষয়ে পৃথিবীর রূপশোভা দেখতে দেখতে আমি সামনে এগোই। দেখি এই বিশ্বে আমার আগমন অবাঞ্চিত নয়। মানুষ আমায় স্বাগতম জানাচ্ছে। আমার জলধারা তাদের পূর্ণ পীযুষ ধারা। আমার স্পর্শে জগতের সব মালিন্য ধুয়ে মুছে যায়। পুণ্যার্থীরা আমাতে অবগাহন করে পাপ মোচন করে। এক সুদীর্ঘ পথ পিছনে রেখে এসে পেয়ে যাই সুন্দরী বঙ্গভূমি বাংলাদেশের মার্টি। এত দিনে পরম আত্মবিশ্বাসে দেখলাম আমি জগতের শ্যামলতা, সরসতা, সজীবতা ও বহমান জীবন ধারার উৎস। আমি আমার দুই তীরকে জল ও পলি দিয়ে সজীব ও উর্বর করে তুলি। তাতে মাটি হয়ে উঠে অধিক ফসল ফলাবার উপযোগী। আমার উপর দিয়ে নৌপথে যাতায়াত বা মালামাল বহন অত্যপ্ত সহজ ও স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ। তাই আমার তীরে তীরে গড়ে উঠেছে কত শহর-বন্দর, গ্রাম, জনপদু, শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র। আমার পথের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। নিচু ভূমি পেলেই আমি সেদিকে ধেয়ে যাই। তাই এক দেশের সাথে অন্য দেশের বন্ধন গড়ে তুলি আমি অতি সহজেই।
এছাড়াও চলার পথে পথে আমি যখন মোড় পরিবর্তন করি তখন রেখে যাই আমার শাখা প্রবাহ, আমার পথে নতুন কোন সঙ্গী নদী পেলে তাকেও নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেই। বুকে আমার এক অনন্ততা। বিরাট বিশাল সাগরের বুঝে গিয়ে তার স্নেহসুধা পাবার তৃষ্ণা আর উদ্দেশ্যেই আমি এগিয়ে যাই। এমনি করে আমি দেশে দেশে সভ্যতার এক আশ্চর্য বন্ধন রচনা করে চলেছি। আমার মাধ্যমেই এক দেশের সভ্যতা ও জ্ঞান অন্য দেশে প্রসারিত হচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে আমারই তীরে তীরে গড়ে উঠেছে কত আশ্চর্য সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা, আর্য সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা ইতিহাসের বিস্ময়। এই বিষয় তো আমাদেরই কীর্তি।
ইতিহাসের কথা বাদ দিলেও দেখি, বর্তমান যুগেই কী আমার প্রয়োজনীয়তা কম? স্নান করতে, পান করতে, কৃষিকর্মে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমার জল, আমার স্রোতবেগ কতই না উপকারী। আবার মানব বসতিকে পরিচ্ছন্ন করতে শিল্পকারখানার বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করতেও আমি আমার উদার বুক মেলে ধরি। আবার এই মানুষেরই সুবিধার জন্য দুঃসহ কষ্ট সহ্য করেই আমার বুকে সেতু নির্মাণ করতে দিই। আমার ক্রীড়াভূমি স্বরূপ সরস তীর ঢেকে বানাতে দিই রেলপথ। আর আমার চঞ্চল উদ্দাম চলার কোলে মানুষ যখন নিষ্ঠুরভাবে বাধ নির্মাণ করে বেঁধে দেয় তাও আমি সহ্য করি। কারণ মানুষের কল্যাণ করাই আমার হৃদয়ের একান্ত ইচ্ছা। আমার নৈসর্গিক শোভা দিয়ে আমার রূপালি ধারা দিয়ে এই বঙ্গভূমিকে আমি করেছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আমার বুকের পাল তোলা নৌকা, ডিঙ্গি নাও বেয়ে যাওয়া কিশোর, আমার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া গাংচিল, সাদা বক, রাঙা মেঘ, আমার তীরে বাঁশের কঞ্চিতে, ঝোপে ঝড়ে বসে থাকা মাছরাঙা- এসব দৃশ্য দেখে কত কবি সৃষ্টি করেছেন কত অমর কাব্য। কত শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে কত চিত্রমালা।
তবুও কি আমি রাক্ষুসী? তবে হ্যা, অস্তিত্বের বিনাশ কেউ চায় না। তাই বর্ষায় যখন আমার দুকূল উপচে পড়ে প্রাণ বন্যায় আমি যখন নিজকে ধরে রাখতে পারি না, তখন নিতান্ত নিরূপায় হয়ে আমি বাঁধ ভেঙ্গে এগিয়ে যাই। যখন ভয়ংকর ঝড় আমাতে ঘূর্ণি তোলে, তখন আমার বেগ হয় আরো প্রচণ্ড৷ প্রবল গতিতে আমি ধেয়ে যাই। সেই বাধ ভাঙ্গা প্রাণের আবেগে আমার দুই তীরের কত গ্রাম, কত ফসলের মাঠ কত প্রাণ ধ্বংস হয়, সে খেয়ল তখন আমার থাকে না। অস্তিত্ব রক্ষায়, আপন সত্তার বিকাশে আমি যেন তখন মাতাল হয়ে উঠি। কিন্তু এই নেশা আমার ক্ষণিকের। তাই তো যখন বর্ষার ধারা থেমে যায়, ঝড় শান্ত হয়, তখন আমিও শান্ত হই। বিধ্বস্ত গ্রাম, বিন্ষ্ট শস্য আর মানুষ ও গবাদি পশুর মৃতদেহ দেখে আমি হই শোকাভূত। বিবেকের যন্ত্রণায় কাতর হই।
ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমি বাড়াই দানের হাত। উজাড় করে দেই নরম পলি। মাঠভরা সোনালি ধান। যে কূল ভেঙ্গেছি, তার বিপরীতে গড়ি নতুন কূল। জগাই নতুন চর। মানষেরা সেখানে নতুন স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ঘর বাঁধে, ফসল ফলায়। দূর দূরান্ত থেকে উড়ে আসে সাদা বক, বালিহাঁস, পানকৌড়ি। আবার সম্পদে শস্যে কল্যাণময়ী হয়ে উঠি। আবার মাঝি নৌকা বায় জেলে জাল ফেলে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে নগর। মানুষ আবার নতুন কর্মোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানেই আমার জীবনের সার্থকতা। আমার নামের সার্থকতা। আমি ‘পুণ্য পীযূষ সত্যবাহিনী' অনন্ত প্রবাহিনী।