ভূমিকা : শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির অপরিণামদর্শী ব্যবহারের
ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলছে
মেরু অঞ্চলে। দ্রুত হারে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর
হরেক রকম প্রজাতি। হানা দিচ্ছে নানা ধরনের ভাইরাস। তাই আজ শ্লোগান উঠেছে ‘কার্বন
নিঃসরণ কমাও, বিশ্ব বাঁচাও’। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে জীবাশ্ম
জ্বালানিমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
জীবাশ্ম জ্বালানি : জীবাশ্ম জ্বালানি বলতে জীব থেকে সৃষ্ট জ্বালানিকে
বুঝায়। কোটি কোটি বছর পূর্বে বিভিন্ন গাছপালা এবং জীবজন্তু প্রচণ্ড ভূমিকম্প বা
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক কারণে মাটি চাপা পড়ে তাপে
এবং চাপে যে জ্বালানি তৈরি হয় তাকে জীবাশ্ম জ্বালানি বলে। এ জ্বালানি বায়ুর
অনুপস্থিতিতে অবাত পচন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। এ প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তৈরি হতে
সাধারণত কয়েক কোটি বছর সময় লাগে। জীবাশ্ম জ্বালানি কঠিন বা তরল আকারে খনি থেকে
উত্তোলন করে তাপ শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানিতে উচ্চ
পরিমাণে কার্বন থাকে। আমাদের পরিচিত কিছু জীবাশ্ম জ্বালানি হলো— কয়লা, প্রাকৃতিক
গ্যাস, খনিজ তেল ইত্যাদি।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার : বর্তমান মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে কয়লা, গ্যাস,
তেল ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির ভিত্তিতে। জীবনের প্রায় সব ধরনের কর্মকাণ্ডে এসব
জ্বালানির ব্যবহার রয়েছে। কয়লা অতি পরিচিত একটি জ্বালানি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের
প্রধান উপাদান কয়লা। রান্না করতে ও বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালাতে ব্যবহৃত হয় কয়লা।
একসময় কয়লা পানি পরিশোধনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এছাড়া কয়লা থেকে অনেক
প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন— কোলগ্যাস, আলকাতরা, বেনজিন, অ্যামোনিয়া, টলুয়িনি
প্রভৃতি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক গ্যাস বর্তমানে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদার্থ।
এর প্রধান ব্যবহার জ্বালানি হিসেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, রান্নার কাজে এবং সার
কারখানায় প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার রয়েছে। শক্তির অন্যতম পরিচিত উৎস খনিজ তেল
বা পেট্রোলিয়াম। বর্তমান সভ্যতায় এর ব্যবহার ব্যাপক। গ্রামের কুঁড়ে ঘর থেকে
শুরু করে আধুনিক সভ্যতার পরিবহন ব্যবস্থা সর্বত্রই এর ব্যবহার রয়েছে।
পেট্রোলিয়াম থেকে নিষ্কাশিত তেল পেট্রোল। পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের প্রধান ব্যবহার
তড়িৎ ও যান্ত্রিক শক্তির উৎপাদনে। এছাড়া পেট্রোলিয়াম থেকে নানান রকম প্রসাধনী
যেমন— ক্যাশমিলন, পলিয়েস্টার, টেরিলিন ইত্যাদি পাওয়া যায়।
পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব : জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট
গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো (CO2, CH, CFC SO, প্রভৃতি) বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য
দায়ী। বিজ্ঞানীদের মতে, কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে ভূমণ্ডলের তাপমাত্রা
ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকবে, যার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বাড়বে, তেমনি এক
সময় পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য স্থানে পরিণত হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে পরিবেশ
দূষণ খুব বেশি ঘটে। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, কয়লা থেকে তাপবিদ্যুৎ
কেন্দ্রে তড়িৎ আহরণে কর্মীদের মৃত্যুর হার পারমাণবিক রিএ্যাক্টরে কর্মীর মৃত্যুর
হারের সমান। গাড়ি, বিমান, জাহাজ ও ট্রেন চালাতে যে জ্বালানি ব্যবহৃত হয় তা
প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানি। মোটরগাড়ি ও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশ দূষণ
করে। এছাড়া বাতাসে CO-এর পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় যা ঐ অঞ্চলের
জীববৈচিত্র্যের ওপরও প্রভাব ফেলে।
উন্নত দেশগুলোর কার্বন নির্গমন : বিশ্বে মোট শক্তি ব্যবহারের ৮১ শতাংশ
জীবাশ্ম জ্বালানি। কয়েক দশক ধরে উদ্বেগজনকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার
বাড়ছে। কার্বন নির্গমন ও জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নত দেশগুলো দায়ী। আর উন্নয়নশীল
ও দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শিল্পোন্নত দেশগুলো আগেই বিশ্বের
বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করেছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন
নির্গমনকারী দেশের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে চীন আর যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে
যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করছে, চীন তার দ্বিগুণ গ্যাস বাতাসে
ছড়াচ্ছে। মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। আর পৃথিবীর সমগ্র
কার্বন নিঃসরণের এক চতুর্থাংশই করছে চীন।
কার্বন নির্গমনে শীর্ষ ১০ দেশ
ক্রম দেশ | কার্বন নির্গমন (গিগা টন) |
---|---|
১. চীন | ১০.০৬ |
২. যুক্তরাষ্ট্র | ৫.৪১ |
৩. ভারত | ২.৬৫ |
৪. রাশিয়া | ১.৭১ |
৫. জাপান | ১.১৬ |
৬. জার্মানি | ০.৭৫ |
৭. ইরান | ০.৭২ |
৮. দক্ষিণ কোরিয়া | ০.৬৫ |
৯. সৌদি আরব | ০.৬২ |
১০. ইন্দোনেশিয়া | ০.৬১ |
ব্যবহার কমাতে বৈশ্বিক উদ্যোগ : জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বিশ্বের
বেশ কিছু দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প বাতিল করেছে। শক্তি
উৎপাদনে পুরো বিশ্ব এখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পারমাণবিক শক্তির দিকে
ঝুঁকছে। মূলত এ কারণেই বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন নির্গমনকারী চীন ২০৩৫ সালের মধ্যে
১৫০টি পারমাণবিক চুল্লি তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। চীন অঙ্গীকার করেছে, ২০৬০
সালের মধ্যে তারা কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হবে। তারা বিদেশে আর কোনো নতুন
কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে আমেরিকা কার্বন নিঃসরণ
কমিয়ে ২০০৫ সালের তুলনায় অর্ধেকে নামিয়ে আনবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে
অর্থ সাহায্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করবে। দেশটি চাইছে ২০৩০ সালের
মধ্যে সেখানে নতুন গাড়ির অর্ধেকই হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। এছাড়া তারা ২০৫০ সালের
মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন
(ইইউ) অঙ্গীকার করেছে ১৯৯০-এর স্তর থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৫৫
শতাংশ হ্রাস করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো
হচ্ছে জার্মানি, ইতালি এবং পোল্যান্ড। এছাড়া রাশিয়া, জাপান, ভারতসহ বিশ্বের
অনেক দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ
কমানোর প্রতিশ্রুতি আশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশের ভূমিকা : ‘কপ-২৬’ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পৃথিবীর
তাপমাত্রাকে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫° ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে
৯৯টি দেশের সঙ্গে এক চুক্তিতে যোগ দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কার্বন নির্গমন কমিয়ে
দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে চায়। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি সরকার ১০টি পরিকল্পিত
কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে। এছাড়া ২০২৪ সালের মধ্যে পরিবেশ দূষণকারী
সমস্ত প্রচলিত ইট ভাটা বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের প্রধান
কার্বন নিঃসরণকারী হলো যানবাহন। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবহন খাতে দেখা দিতে পারে
একটি বড় পরিবর্তন। কারণ এই সময়ের মধ্যে দেশে ১০ হাজার হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক
যানবাহন আসবে। ব্রডগেজ ও ইলেক্ট্রনিক লোকোমোটিভ চালু হবে; সেইসঙ্গে ভালো মানের
জ্বালানি এবং ইউরো থ্রি ও ফোর টাইপ ইঞ্জিনের প্রবর্তন হবে। কৃষি খাতে, সার
প্রয়োগ ও সার ব্যবস্থাপনা থেকে মিথেন নির্গমন কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের
পরিকল্পনা করেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। ঢাকায় বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের জন্য
একটি প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সেইসঙ্গে, একটি ইনসিনারেশন বা
বর্জ্যা পুড়িয়ে ফেলার প্ল্যান্ট নির্মাণ ও একটি আঞ্চলিক সমন্বিত আবর্জনার
ভাগাড় তৈরির পাশাপাশি রিসোর্স রিকভারি বা সম্পদ পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা তৈরির
পরিকল্পনাও করেছে সরকার। এছাড়া পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০৩০ সালের মধ্যে বনাঞ্চলের
পরিমাণ ২৪ শতাংশে উন্নীত করতে চায়।
বিকল্প জ্বালানি : বিজ্ঞানীদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানিবিহীন পৃথিবীর কথা
কল্পনা করা হলে প্রথমেই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে আসে বিদ্যুৎ শক্তির কথা। আর
বিদ্যুৎ তৈরির জন্য ব্যবহার হতে পারে নবায়নযোগ্য শক্তি বায়ুপ্রবাহ, পানির
স্রোত, সূর্যের আলো ইত্যাদি। বাস্তবিকই এটি হতে পারে জীবাশ্ম জ্বালানির একমাত্র
বিকল্প। তখন শহরে প্রধান যানবাহন হিসেবে থাকবে বিদ্যুৎ-চালিত ট্রেন ও বাস। এ
ছাড়া বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি, বিমানপ্রযুক্তিরও যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটবে। আন্তর্জাতিক
মালামাল পরিবহন অনেকাংশেই হবে নৌপথে। যেখানে বায়ুশক্তিচালিত জাহাজ চলাচল করবে। এ
কারণে অনেক নদী ও খাল সৃষ্টি করা হবে। অনেকের মতে, সস্তা জীবাশ্ জ্বালানির কারণে
নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহারের প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। তবে জীবাশ্ম
জ্বালানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যাবে।
বিশ্বে অনেক স্থানে এখনই সৌরশক্তি ব্যবহার করে রান্না করা হয়। ভবিষ্যতে সৌরশক্তি
ব্যবহারের প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলে এটি ব্যবহার করে শিল্প-কারখানাও গড়ে উঠতে
পারে। বর্তমান বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬ শতাংশই আসে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র
থেকে। পৃথিবীর অনেক স্থানে এখনো জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন
বাড়ানো হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (TEA) পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫
সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে কয়লাকে ছাড়িয়ে যাবে
নবায়নযোগ্য শক্তি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে
সোলার বা সৌরবিদ্যুতের অবদান ৮০ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে
সোলার ফটোভোলটাইক (পিডি) ও বাতাসের সমন্বিত অবদান ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশে উন্নীত
হবে।
উপসংহার : একটা বিষয়ে এখন পুরো বিশ্ব একমত যে, পৃথিবীকে জলবায়ু
পরিবর্তনের হাত থেকে টেকসই সুরক্ষা দিতে হবে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে চাইলে
কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে
হবে এবং এজন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।