মায়ের কয়েকবার ডাকাডাকি করার পর সবুজ ঘুম থেকে উঠলো। উঠেই সে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফ্রেশ হবার পর সে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। সবুজদের বাড়িতে তারা চারজন। মা, বাবা, তার বোন নাফিসা এবং সে। ডাইনিং টেবিলটা যে খুব বড় তা বলা যাবে না। কিন্তু টেবিলটা খুব্ দামী। সবুজের বাবা এটা গত দুদিন আগেই নিয়ে এসেছিলেন। তার বাবা এখন সোফায় বসে টিভি দেখছেন। টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে তা সবুজ গতকাল পত্রিকায় পড়েছিল। পত্রিকা পড়তে তার খুব একটা ভালো লাগে না। কিন্তু তার বাবা তার সামনে চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র পড়াশুনা করলেই হবে না। একজন ভালো ছাত্রকে সকল দিকেই পারদর্শী হতে হবে। তার দরকার প্রচুর জ্ঞান। আর এই জ্ঞান শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব না। তাই পত্রিকা- বই ,পুস্তক পড়তে হবে।” বলা যায় তার বাবার আদেশ মানতেই পত্রিকায় ঢু মেরেছিল সে। সবুজ দু তিন ওভার দেখলো। বাংলাদেশ দলের টেস্টের দৈন্যদশা যেন সচক্ষে দেখতে পেল সে। এতদিন শুধু শুনেই আসছিল। ৩ ওভারেই ৩ উইকেট নাই! পরে মা এসে খাবারের জন্য তাগাদা দেয়ায় আর দেখতে পারলো না। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েই চলে গেলো স্কুলে। স্কুলে যাবার পথে সবুজের এক বন্ধু আসিফের সাথে তার দেখা হলো। আসিফের সাথেই গল্প করতে করতে হাঁটতে শুরু করলো সে।
তারা যখন স্কুলে গিয়ে পৌঁছায় তখন প্রায় ১০.৩০ বেজে গেছে। এসেম্বলীতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এরপর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে এসেম্বলী শেষ হলো। শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলো সব শিক্ষার্থীরা। সবুজও প্রবেশ করতে যাবে তখন নোটিশ বোর্ডের দিকে তার চোখ পড়লো। আজ তো ১৭ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এ উপলক্ষেই আজ রচনা ও চিত্রাংকণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এরপর সে রচনা প্রতিযোগিতার নিয়মাবলি পড়ে নিল। বিষয় হলো : বাংলার অলরাউণ্ডার বঙ্গবন্ধু। সবুজের কাছে এ নিয়ে কোন ধারণাই নেই। তাই সবুজ হাল ছেড়ে দিল। নাহ, এমন রচনার বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব না। সে ক্লাসে চলে গেলো। আজ শ্রেণিকক্ষ যেন নতুন সাজে সেজেছে। ক্লাসের ঘণ্টা বাজার পর সাবিনা ম্যাডাম প্রথমে ক্লাসে এলেন।
- আসসালামু আলাইকুম ছাত্ররা। কেমন আছো তোমরা?
- ওয়ালাইকুমুস সালাম ম্যাম। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
- আলহামদৃলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। আচ্ছা, তোমরা কি জানো আজকে একটি বিশেষ দিন। বলো তো কি দিবস আজকে?
- জ্বি ম্যাম। আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।
- হুমম। ঠিক বলেছে। যার ডাকে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রণাংগণে। যার বক্তব্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশমাতৃকা স্বাধীন করার জন্য আজ তারই জন্মদিন।
- জ্বি ম্যাম।
- আচ্ছা এ উপলক্ষে আমাদের স্কুল কিন্তু রচনা ও চিত্রাংকণের আয়োজন করেছে। তোমরা কে কে অংশগ্রহণ করবে হাত তুলো।
দেখা গেলো যে রনি ছাড়া কেউই হাত তুললো না। ম্যাডাম বিস্ময়ের সুরে বললেন,
- কি ব্যাপার? শুধু রনি ছাড়া আর কেউ অংশগ্রহণ করবে না! কিন্তু কেন?
- ম্যাম। আসলে এ সম্পর্কে আমাদের সঠিক জানা নেই।
- কি সম্পর্কে ?
- যে বিষয়ে আমাদের রচনা লিখতে হবে সে সম্পর্কে।
ম্যাডাম রচনার নোটিশ সাথে করেই নিয়ে এসেছিলেন। খানিকক্ষণ তিনি সেকখানে চোখ তুলে চাইলেন।
- ও আচ্ছা! বাংলার অলরাউণ্ডার বঙ্গবন্ধু?
- জি ম্যাম।
- আচ্ছা। তোমরা জানো ক্রিকেটে বর্তমানে বিশ্বসেরা অলরাউণ্ডারের নাম কি?
- সাকিব আল হাসান। (কয়েকজন খুব উৎসাহী হয়ে বললো)
ঠিক বলেছো। সাকিবকে অলরাউণ্ডার কেন বলা হয় জানো? কারণ সে ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে সমানভাবে পারদর্শী। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন একজন সত্যিকারের অলরাউণ্ডার।
সত্যিকারের অলরাউণ্ডার! অবাক হলোঅনেকেই।
হ্যা সত্যিকারের অলরাউণ্ডার। বিষয়টা আমি তোমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। তোমরা তো জানো, বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের কথা। যে ভাষণ এখনও বিশ্বের কাছে নন্দিত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু যে ভালো বক্তব্য দিতে পারতেন এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। শুধু তাই নয়, তিনি একজন ভালো শ্রোতাও বটে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সাংবাদিক ও বিদেশি কূটনীতিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি সবাইকে সে প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে। তিনি একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী। তিনি একজন সুলেখকও। বিভিন্ন সময়ে তিনি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে লিখেছেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক ভাইকে নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন সোহরাওয়ার্দীকে নিয়েও। এই সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আইডল। তিনি বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে লেখালেখি ও সৃজনশীলতার চর্চা তিনিই শুরু করেছিলেন বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ ছাড়া একজন মুসলিম কারো কাছে মাথা নত করবে না’ এরকম ঘোষণা তার মতো মহামানবের পক্ষেই দেয়া সম্ভব হয়েছিল। তিনি যুদ্ধ পরবর্তী দেশে ইসলাম শিক্ষাও প্রচার ও প্রসারের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী। বাঙালি জাতির আশা-আকাঙক্ষার কথা বলেছেন সবখানে। নিজের ছিলেন ত্যাগী। মানুষের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। শুধুমাত্র এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিসের দিক দিয়েই তিনি অলরাউণ্ডার নন, নৈতিক গুণাবলির চর্চার দিক দিয়েও তিনি অলরাউণ্ডার। আবার তিনি শুধু এ দুটো ক্ষেত্রে অলরাউণ্ডার ছিলেন বললেও ভুল হবে। বরং যুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠনের সময়কালেও তিনি প্রত্যকটি সেক্টরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তাই তিনি এ দিক দিয়েও ছিলেন অলরাউণ্ডার। যেমন- তিনি দেশে ফিরেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, বাংলাদেশকে তিনি প্রাচ্যের সুইজারল্যাণ্ড হিসেবে গড়ে তুলবেন। চারদিকে তখন শুধু দৈন্যদশা। এর মধ্যে তিনি এ ধরণের ঘোষণা দিলেন। তাহলে কি পরিমাণ দৃঢ়তা ছিলেন তার মধ্যে ভাবা যায়!! আবার শুধু কথা বলেই তিনি খালাস হয়ে যান নি বরং তা কর্মে সম্পাদন করে দেখিয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা একাডেমী, অনেক স্কুল- কলেজ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের সরকারিকরণ করেন। বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছেন। শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের ব্যবস্থা করেন। কবি-সাহিত্যিকদের জন্য পুরস্কারের প্রচলন করেন। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করেন। শ্রমিক কর্মচারীদের তিনি ভাই বলে আখ্যা দিতেন। তাদের প্রতি যেন বৈষম্য না করা হয় সে ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তোমাদের মনে আছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা। তিনি বলেছিলেন,
“শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”
বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেষ্ট। তার দ্বারা কারো দু পয়সা ক্ষতি হয়েছে এমন কথা কেউ বলতে পারবে না।
এরই মধ্যে প্রথম পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা বেজে উঠলো। এরপর আয়োজিত হবে রচনা ও চিত্রাংকণ প্রতিযোগিতা। ম্যাডামের কথা এতক্ষণ সবাই মন দিয়ে শুনছিলো। নিমিষেই যেন চলে গেছিল অন্য ভূবনে। ইতিহাসের দাবড়ানো ঘোড়ায় করে অনেক দূর চলে গেছিল। বেল বাজার ফলে তারা সচকিত হয়ে উঠলো। সবাই ব্যাগ-বই গুছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবুজের জন্য ভালোই হলো। অনেকগুলো তথ্য পেয়ে গেল সে। ম্যাডাম আরেকটা এনাউন্সমেন্ট দিলেন।
- তোমরা সবাই শোন, ২৬ শে মার্চ কিন্তু ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে এ স্কুলে।
সবার মধ্যে হৈ হৈ রব পড়ে গেল।
- আচ্ছা ছেলেরা তোমরা জান আমাদের বঙ্গবন্ধুরও কিন্তু প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। একজন কমপ্লিট অলরাউণ্ডার। তাই না ?
- জ্বি ম্যাম।
সবাই চলে গেল হলরুমে। সেখানে রচনা প্রতিযোগিতা হবে। সবুজ অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে লিখলো। ম্যাডামের কথা শেষ হবার পর তার মনে শুধু একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো আর তা হলো- “আমাকেও অলরাউণ্ডার হতে হবে।” আজ আমি তাই চিত্রাংকণ ও রচনা দুটিতেই নাম দিবো। সবুজ দুটোতেই নাম দিল। অবশেষে রেজাল্ট এনাউন্সমেন্টের সময়ও সে দুটোতেই পুরস্কার ছিনিয়ে আনলো।
বাইরে চারদিকে কোলাহল। সবাই সবুজ সবুজ রব ধ্বনি তুলছে। দুটো পুরস্কার পাওয়ায় পুরো স্কুল যেন তার প্রশংসায় মুখরিত। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে! পরক্ষণে মনে পড়লো এখন তো ১০ টা বাজে। স্কুল....। ও! আজ তো শুক্রবার। স্কুল ছুটি। সে আনন্দে দৌড় মেরে বাবার কাছে চলে গেল।
“জানো বাবা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অলরাউণ্ডার।”
তার বাবাও তার সাথে একমতের ভঙ্গি করলেন। কিন্তু কিছুটা বিস্ময়ের সাথে।
বাবা! আমি আজ থেকে সবদিকে পারদর্শী হবার চেষ্টা করবো। আমি গান করব, কবিতা, গল্প লিখবো। সবই করবো শুধু আমার দেশের জন্য। আমি তোমাদের কাজেও সাহায্য করবো আজ থেকে। ঠিক বঙ্গবন্ধুর মতো।
জানালা দিয়ে তখন বাতাস বইছে। ফুরফুরে বাতাস। এ শান্তির বাতাসের মধ্যেই একটা দমকা হাওয়া এসে ক্যালেণ্ডারেটাকে একটু নড়িয়ে দিল। সবুজের চোখ চলে গেল সে দিকে। আরে! আজ তো ১৭ মার্চ!