↬ মুঠোফোনে ব্যাংকিং সেবা
↬ ব্যাংক এখন হাতে হাতে
↬ হাতের মুঠোয় ব্যাংকিং সুবিধা
ভূমিকা : বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ব্যবহারে নতুনত্ব আসছে, নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার যুক্ত হচ্ছে। আর এর ফলে মানুষের জীবনযাপন ও জীবন পরিচালনার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে সহজ, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, যে দেশ প্রযুক্তির দিক থেকে যত এগিয়ে সেই দেশের উন্নতি ততই উচ্চে। আমাদের দেশও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে পিছিয়ে নেই। মোবাইল ব্যাংকিং প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রসার তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
মোবাইল ব্যাংকিং কী : একজন গ্রাহক মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করে যে পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন করতে পারেন তাকে বলা হয় মোবাইল ব্যাংকিং। ব্যাংকের শাখাবিহীন এমন একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্বল্প খরচে খুব সহজে ও দ্রুত আর্থিক সেবা নিশ্চিত করা যায়। তাই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজে টাকা পাঠানোর এই সেবা মাধ্যমটি এখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
মোবাইল ব্যাংকিং-এর যাত্রা : বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে কয়েকটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে মোবাইল ফোননির্ভর ব্যাংকিং সেবা চালুর অনুমতি দেয়। বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক এ সেবা প্রথম চালু করে। ৩১ মার্চ এ সেবার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
যারা আছে এই যাত্রায় : বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস সংক্ষেপে এমএফএস-এর আর্থিক সেবা দিচ্ছে ১৬টি ব্যাংক। এগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ্-বাংলার রকেট, ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইউনাগ, সাউথইস্ট ব্যাংকের টেলিক্যাশ, ওয়ান ব্যাংকের ওকে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাই ক্যাশ, প্রাইম ব্যাংকের প্রাইম ক্যাশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের স্পট ক্যাশ, ট্রাস্ট ব্যাংকের মোবাইল মানি, মেঘনা ব্যাংকের ট্যাপ এন পে। এছাড়া রূপালী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, বাংলাদেশ কমার্স, এনসিসি ও যমুনা ব্যাংক দিচ্ছে শিশুর ক্যাশ। এগুলোর মধ্যে সেবার মান ও জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রকেট এবং ডাক বিভাগের নগদ। মেঘনাসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক এমএফএস সেবা বন্ধ করে দিয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিং-এর গুরুত্ব : দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের ইতিবাচক ব্যাংকিংয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেননা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ সেবার সুফল ভোগ করছে। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। ফেরিওয়ালা বা ফুটপাতের দোকানদার, মুটে-মজুর, বাস-ট্রাকের ড্রাইভার, কাজের বুয়া, রিকশা ও ভ্যানওয়ালারা সারা দিন পরিশ্রম করে কোনো এজেন্টের কাছে গিয়ে টাকা পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। স্ত্রী বা বাবা-মা নিমেষেই টাকা পেয়ে যান। যারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত তাদেরও মাঝেমধ্যে গ্রামে থাকা গরিব আত্মীয়-স্বজনকে টাকা পাঠাতে হয়। খুচরা বিক্রেতা জিনিস কিনে পাইকারি বিক্রেতাকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করে। ছোট ব্যবসায়ীদের এতে সময় বাঁচে, ঝুঁকিও কমে। ছাত্রদের টিউশন ও ভর্তি ফি পরিশোধ, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান, সরকারি উপবৃত্তি বিতরণ সবই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই দেওয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে যারা টাকা পাঠান তারাও এমএফএস সেবাদানকারীর মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। বড় করপোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পমালিকরাও এ সেবার সুবিধা পেয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মীর বেতন হয় বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও কিস্তির টাকা জমা হয় মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। অনেক কোম্পানির পণ্য বিক্রির টাকা জমা হয় এ মাধ্যমে। এভাবেই দিন দিন মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গণমানুষ উপকৃত হচ্ছে।
সেবা উপভোগের পদ্ধতি : মোবাইল ব্যাংকিং সেবা শুরু করতে হলে প্রথমেই এ সেবার অধীনে নিবন্ধন করতে হয়। যেকোনো অপারেটরের মোবাইল সংযোগ গ্রহণকারীই এ ব্যাংকিং সেবার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। অনুমোদিত স্থান থেকে গ্রাহকেরা নিবন্ধন ফরম সংগ্রহ করতে এবং জমা দিতে পারেন। ফরমের সঙ্গে গ্রাহকের ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র বা ছবিযুক্ত অন্য কোনো পরিচয়পত্র সরবরাহ করতে হবে। গ্রাহকের মোবাইল নম্বরটিই অ্যাকাউন্ট নম্বর হিসেবে বিবেচিত হবে। হিসাব তৈরির পর গ্রাহকের মোবাইল ফোনে ব্যাংকের সিস্টেম থেকে ওভার অ্যাকটিং ভয়েস রেসপন্স কল যাবে। এই কলে গোপন পিন নম্বর পাওয়া যাবে। এজেন্টের কাছ থেকে টাকা তোলার জন্য এই পিন নম্বরটি প্রয়োজন হয়। কোনো ঝুঁকি ছাড়াই এই গোপন পিনকোড ব্যবহার করে মোবাইলে টাকা লেনদেন করা যায় সহজেই।
গ্রাহকসংখ্যা ও আর্থিক লেনদেন : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই, ২০২০ পর্যন্ত এসএফএস সেবার নিবন্ধিত গ্ৰাহকসংখ্যা ছিল ৯ কোটি ২৬ লাখ। এদের মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক ৪ কোটি ২৬ লাখ। দেশজুড়ে এ সেবা দিতে এজেন্ট রয়েছে ১০ লাখের বেশি। জুলাই মাসে ৬৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে দিনে ৫ বারে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা এবং মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ক্যাশ ইন করা যায়। আর দিনে ৫ বার সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা এবং মাসে ২০ বারে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্যাশ আউট করা যায়। পাশাপাশি একজন গ্রাহক তার মোবাইল অ্যাকাউন্টে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা স্থিতি রাখতে পারবেন।
মোবাইল ব্যাংকিং-এর সুবিধা : মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের মাধ্যমে একজন গ্রাহক যেসব সুবিধা পেতে পারেন সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো—
- ২৪ ঘণ্টা, ৩৬৫ দিন লগইন করার সুবিধা।
- যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় বসে অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স জানা যায়।
- একই ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যায়।
- নিজের একাধিক অ্যাকাউন্টের মধ্যে টাকা পাঠানো যায়।
- ইউটিলিটি বিল– বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ফোন ইত্যাদির বিল পরিশোধ করা যায়।
- অ্যাকাউন্টের আয়-ব্যয়, উত্তোলন ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়।
- চেকবইয়ের জন্য আবেদন ও চেকের পেমেন্ট বাতিল করা যায়।
- সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ইত্যাদি জানা যায়।
মোবাইল ব্যাংকি-এর ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা:
- পাসওয়ার্ড গোপন রাখা।
- লেনদেনের ক্ষেত্রে মোবাইল নম্বরটি বারবার যাচাই করা।
- প্রতারক চক্রের হাত থেকে বাঁচতে যেকোনো ফোন বা মেসেজ ভালোভাবে যাচাই করা।
উপসংহার : প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষের যুগে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার ও সূফল থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। কেননা বিশ্বব্যাপী আজ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জয়জয়কার। বাংলাদেশে উন্নতি ও সমৃদ্ধির এই পর্যায়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল ব্যাংকিংকে কাজে লাগিয়ে এদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের জীবনযাত্রায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারবেন এ কথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়।