বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্চ মাস

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১-এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০-এর নভেম্বরে সংঘটিত অপারেশন ব্লিটজ়-এর পরবর্তী অনুষঙ্গ। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ-এর মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। বাঙালিরা তখন পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, যা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ধারণার বাইরে ছিল।

পেছনের কথা 
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বাঙালিরা আশা করেছিল যে ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং আওয়ামী লীগ ৬ দফা অনুসারে সরকার গঠন করবে। ২৮ ১৯৭১-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি)-এর জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে জাতীয় বিধানসভার কার্যাবলি মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দেন। পিপিপি এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলো, জুলফিকার আলী ভুট্টো এও বলেন যে তিনি বাঙালিদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চান। এই স্থগিতকরণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ ১৯৭১-এ একটি গণসমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ এতই সফল ছিল যে পাকিস্তান সরকার সেনাছাউনি ও পূর্বপাকিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়।

পরিকল্পনা পদ্ধতি 
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়। 

অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়) তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলী এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদিম। জেনারেল টিক্কা খান এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারক করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।

পরিকল্পনায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ 
পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং স্বশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাসনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

সিদ্ধান্ত একজনরে 
  • সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করতে হবে। 
  • সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে। 
  • ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী করতে হবে। 
  • সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। 
  • টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফসহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। 
  • সকল পূর্বপাকিস্তানি (বাঙালি) সৈন্যদলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। 
  • আওয়ামী লীগের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন। 

পরিকল্পনায় পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল- ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। ঢাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ হলে পাকিস্তানের ৯ম এবং ১৬তম ডিভিশনের সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য বিমান যোগে ঢাকা চলে আসবে। যেসব শহরে বিমানঘাঁটি আছে (চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা) সেসব শহরে সরাসরি ঢাকা থেকে সি-১৩০ বিমান অথবা হেলিকপ্টার ট্রুপস-এর মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা হবে। 

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাদের বিন্যাস 
১৪তম পদাতিক ডিভিশনই পাকিস্তানি সেনাদের একমাত্র ডিভিশন যাদের পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১-এর মার্চে ঘাঁটি ছিল। যেখানে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তিনটি ব্রিগেড থাকার কথা, সেখানে এই ডিভিশনে চারটি পদাতিক ব্রিগেড ছিল। ৫৭তম পদাতিক বাহিনীকে ঢাকায়, ৫৩তম পদাতিক বাহিনীকে কুমিল্লায়, ২৩তম ব্রিগেডকে রংপুরে এবং ১০৭তম ব্রিগেডকে যশোরে পাঠানো হয়। ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার নামের একজন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার ছিলেন চট্টগ্রামের কমান্ডে। সাধারণভাবে প্রতি ব্রিগেডে ৩ থেকে ৪টি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ও একটি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং আরো কিছু সাহায্যকারী অংশ থাকে। 

এই চারটি ব্রিগেডে মোট ১২টি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ছিল যেগুলোর সবগুলোতে ছিল শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা (প্রধানত পাঞ্জাব, বালুচ, পাঠান এবং সিন্ধিদেরই প্রাধান্য দেয়া হয়)। তাদের ২৫ মার্চের আগেই পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। এই ডিভিশনের আরো ছিল ৫টি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ২০টি এফ-৮৬ সাবের জেট এবং ৩টি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ৪টি এমআই-৮ এবং ৪টি এলট-III হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অপারেশনের জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুরের কাছাকাছি লালমনিরহাটে, সিলেটের কাছাকাছি সালুটি করে, যশোরে এবং ঠাকুরগাঁয়ের কাছে বিমানঘাঁটিগুলো স্থাপন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান নৌবাহিনীর চারটি গানবোট (রাজশাহী, যশোর কুমিল্লা এবং সিলেটে) একটি পেট্রোল বোট (বালাঘাট) এবং একটি পিএনএস জাহাঙ্গির নামে একটি ডেস্ট্রয়ার ছিল। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর পিএনএস বাবুর নামের পতাকাবাহী জাহাজ অপারেশন শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তানে আসে। বেশির ভাগ নৌঘাঁটিই ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মংলায়। 

অপারেশনের পূর্বে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ 
অপারেশনে নামার আগেই যাতে সংশ্লিষ্ট সব পাকিস্তানি ইউনিট কমান্ডার তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল অপারেশনর সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারীদের। আর এই কাজটি করা দরকার ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করা, অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানে আনা, আঞ্চলিক সেনানায়কদের কার্যবিবরণী প্রদান- এই সব কিছুই করা প্রয়োজন ছিল কোন সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে। ২৪ ও ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে করে প্রধান প্রধান গ্যারিসনগুলো পরিদর্শন করেন এবং গ্যারিসন কমান্ডার ও অপারেশনের অন্যান্য সিনিয়র পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এই দলের সাথে ছিলেন জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিট্টা, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল এবং প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদউল্লাহ। জেনারেল ফরমানকে যশোরে পাঠানো হয়, জেনারেল খাদিম নিজে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের গ্যারিসন কমান্ডারদের ব্রিফ করেন এবং ব্রিগেডিয়ার এল ইদ্রুস ও কর্নেল সাদউল্লাহ রংপুর সফরে যান। 

রসদপত্র ব্যবস্থাপনা 
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল কামার আলী মির্জা এবং ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য, মূল কারণ ছিল তখন। অসহযোগিতার কার্যকলাপের কারণে সেনানিবাসগুলোতে খাদ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। অস্ত্রের মূল ভাণ্ডার ছিল ঢাকার অদূরে অবস্থিত রাজেন্দ্রপুরে এবং ৯০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজে খালাসের অপেক্ষায় ছিল। সুতরাং জাহাজ থেকে রসদপত্র খুব দ্রুত খালাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ততোদিনে ১৩ এফএফ এবং ২২ বালুচ ঢাকায় পৌঁছে গেছে, পাকিস্তান থেকে পিআইএ ফ্লাইট এ করে বিশেষ যাত্রীরা ঢাকায় আসতে শুরু করেছে। পাকিস্তানিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সফলতা নিশ্চিত করতে ২৫ মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে পুরো একটি ব্রিগেড পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো। 

সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অদল বদল 
সফলতা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনী বাঙালি কর্মকর্তাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলো থেকে বদলি করে দিয়ে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী মোতায়েন করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত দুটি পাকিস্তানি ইউনিট, ২৫তম পাঞ্জাব ও ২০তম বেলুচ, এর প্রত্যাবর্তন পিছিয়ে দেয়া হয়, তার ওপর ২৫ মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে ঢাকায় উড়ে আসে ১৩তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২২তম বেলুচ রেজিমেন্ট। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য ২৫ মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোন গ্যারিসনে প্রথমেই অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হয় নি।

একনজরে মুক্তিযুদ্ধ

ঘোষণা : ২৬ মার্চ ১৯৭১। ঘোষক : শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি : এম এ জি ওসমানী। অস্থায়ী সরকার গঠন : ১০ এপ্রিল ১৯৭১। সরকারের শপথগ্রহণ : ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ : ভারত (৬ ডিসেম্বর ১৯৭১)। মোট সেক্টর : ১১টি। নৌ-সেক্টর : ১০ নম্বর। খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা : ৬৭৬ জন। বীরশ্রেষ্ঠ : ৭ জন। বীরউত্তম : ৬৮ জন। বীরবিক্রম : ১৭৫ জন। বীরপ্রতীক : ৪২৬ জন। একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক : ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। মহিলা বীরপ্রতীক : ২ জন। ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী গঠন : ২১ নভেম্বর ১৯৭১। যৌথ কমান্ডের সেনাধ্যক্ষ : জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয় দিবস : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।

২৫ মার্চের পূর্বে বাঙালি ইউনিটগুলোর বিস্তার 
অপারেশন শুরুর আগেই সমস্ত নিয়মিত বাঙালি ইউনিটকে একসাথে নিরস্ত্র করার অনুমতি দেননি জেনারেল হামিদ, ফলে পাকিস্তানি নেতৃত্ব অন্যান্য উপায় বাঙালি ইউনিটগুলোর সম্ভাব্য হুমকি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে। ২৫ মার্চে এবং এর আগের সময়গুলোতে হাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট। ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়, তাদেরকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয় বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে, এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, এবং সবগুলো অংশকেই রেডিও এবং তারহীন যোগাযোগের গ্রিড থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়। বাঙালি কর্মকর্তাদের হয় ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়, নয় তো নেতৃত্বের কেন্দ্র বা সরাসরি অপারেশনে নিয়োজিত ইউনিটগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়। 

অপারেশন সার্চলাইট ২৫/২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল 
এটি হচ্ছে ২৫ মার্চ হতে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সময়ে অর্থাৎ অপারেশন যে সময়ে শেষ হয় সে সময়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী কোন কোন স্থানে নিয়োজিত ছিল। যেসব স্থানকে অপারেশন সার্চলাইটে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এখানে শুধু সেগুলোর বিবরণ আছে, সারা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতিরোধের কথা নেই। কোন কোন স্থানে ২৫ মার্চেই পাকিস্তানি আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু হবার সাথে সাথেই বাঙালি বাহিনীর সাথে পাকিস্তানিদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। 

ঢাকা 
২৫ মার্চ ১৯৭১ এ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান প্রধান লক্ষ্যবস্তু। মানচিত্রটি সঠিক মাপে নেই। মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নিম্নলিখিত লক্ষ্য ছিল : 
  • রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা এবং টেলিফোন/টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া। 
  • ঢাকা শহরের সড়ক, রেল ও নৌ-পথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং নদীতে টহল জারি করা। 
  • অপারেশন চলাকালীন সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের আরো ১৫ জন বড় নেতাদের গ্রেফতার করা। 
  • ধানমণ্ডি এলাকায় এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করা। 
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দপ্তর, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস ও পরাভূত করা এবং ২য় ও ১০ম ইবিআর কে নিরস্ত্র করা। 
  • গাজীপুর অস্ত্র কারখানা এবং রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্রগুদাম দখল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। 

পাকিস্তানি সেনা : পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তরের সাথে যুক্ত হয়ে ১৪তম ডিভিশন এবং ৫৭তম ব্রিগেডও ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। যেসকল নিয়মিত সেনা ইউনিটগুলো উপস্থিত ছিল সেগুলো হলো ৫৭তম ব্রিগেড যার সাথে আরো ছিল : ১৮ এবং ৩২তম পাঞ্জাব (সি.ও লে.কর্নেল তাজ) রেজিমেন্ট, ১৩তম সীমান্তবর্তী রেজিমেন্ট, ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট, ৬০৪তম ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা/গুপ্ত) ইউনিট এবং ৩১তম ভূ-গোলন্দাজ বাহিনী (সি.ও লে.কর্নেল জাহিদ হাসান)। ১৪তম ডিভিশন সদর দপ্তরের সাথে নিম্নলিখিত ইউনিটগুলো যুক্ত ছিল : ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট (সি.ও লে.কর্নেল সাফফাত আলী পাকিস্তানি), ৩য় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের উপকরণ (সি.ও লে.কর্নেল জেড.এ খান পাকিস্তানি), ১৯তম সংকেত প্রদানকারী রেজিমেন্ট (সি.ও লে.কর্নেল ইফতেখার হুসাইন- পাকিস্তানি), এবং ১৪৯তম পদাতিক বাহিনী। PAF (পাকিস্তানি বিমান বাহিনী) এর সব কিছু তেজগাঁও বিমানবন্দরে জড়ো করা হয়। সাথে ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্ট থেকে এক স্কোয়াড্রনের কমপক্ষে ১৪টি M24 শ্যাফি ট্যাঙ্ক ঢাকায় জড়ো করা হয়। এইসকল ইউনিটের সংযুক্তি। হিসাবে ৫৭তম ব্রিগেড, ১৪তম ডিভিশন এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তর থেকে অন্যান্য সাহায্যকারী (ইঞ্জিনিয়ারিং, সরবরাহকারী এবং চিকিৎসা ইউনিট) দল ঢাকায় অবস্থান নেয়। 

বাঙালি সশস্ত্রদল : ১০ম ইবিআর (সি.ও লে.কর্নেল মহিউদ্দিন-বাঙালি) ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত ছিল। ২৫০০ ইপিআর সৈন্যদল (১৩তম, ১৫তম এবং ১৬তম উইং, সাথে ইপিআর সদর দপ্তর উইং এবং সংকেত প্রদানকারী উইং) পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরে অবস্থান করছিল। প্রতিটি ইপিআর উইংএ ছিল ৩টি কোম্পানি। যদিও বেশিরভাগ ইপিআর সৈন্যরা পিলখানায় অবস্থান করছিল, তবুও এর মধ্যে দুটি কোম্পানিকে মিরপুরে, দুটি কোম্পানিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং একটিকে গভর্নর হাউসে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান ছিলেন পুরো ইপিআর বাহিনীর প্রধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি লে.কর্নেল আনোয়ার হোসাইন শাহ ইপিআর এর ঢাকা সেক্টরের সৈন্যদের কমান্ডার। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অন্ততপক্ষে ২০০০ সশস্ত্র পুলিশ ছিল। ২য় ইবিআর বাহিনী (সি.ও লে.কর্নেল রাকিব-বাঙালি) ছিল ঢাকার উত্তরে জয়দেবপুরে সাথে, এক কোম্পানি ছিল টাঙ্গাইলে, আরো এক কোম্পানি ছিল ময়মনসিংহে এবং একটি ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল গাজীপুরে। ইপিআর এর দ্বিতীয় উইংএর সদর দপ্তরও (সি.ও ক্যাপ্টেন কামার আব্বাস পশ্চিম পাকিস্তানি) ছিল ময়মনসিংহে, যেখানে কোন বাঙালি অফিসার ছিল না। ঘটনার পরম্পরা : মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক প্রণীত ঢাকা আক্রমণের পাকিস্তানি পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ : 
  • ১৩তম সীমান্তবর্তী সৈন্যদল সেনানিবাসে সংরক্ষিত শক্তি হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা প্রদান করবে। 
  • ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। 
  • ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র করবে এবং ইপিআর সদর দপ্তরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে নেবে। 
  • ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে নিষ্ক্রিয় করবে। 
  • ১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। 
  • ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। 
  • 3SSG-এর একটি প্লাটুন শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার দায়িত্বে ছিল। 
  • ২২তম বালুচ এবং ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহীদের নিষ্ক্রিয় করার দায়িত্বে ছিল। 
  • ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট এরপর পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে। 

অসহযোগ আন্দোলন ১৯৭১ 
অসহযোগ আন্দোলন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত। হরতাল, অবরোধ, কল কারখানা বন্ধ, অফিস আদালত বন্ধ প্রভৃতি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন পালিত হয়েছিল। 
  • ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল - ২ মার্চ। 
  • ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন শেষ হয়েছিল - ২৫ মার্চ। 
  • অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই ২ মার্চ ছাত্রসংগঠনগুলো যে পরিষদ গঠন করেছিল - স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। 
  • ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন - ১ মার্চ, ১৯৭১। 
  • অধিবেশন স্থগিতকরণের প্রতিবাদে ঢাকায় ও সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয় যথাক্রমে ২ মার্চ ও ৩ মার্চ। 
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে প্রথমবারের মত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় - ২ মার্চ। 
  • ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ‘স্বাধীনতা ইশতেহার' ঘোষণা করে - ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। 
  • আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি - সঙ্গীতটি পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়- ৩ মার্চ, ১৯৭১। 
  • বঙ্গবন্ধু ‘রেসকোর্স ময়দানে’ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন - ৭ মার্চ। 
  • অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম ছয়দিনে সরকারি প্রেসনোট অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা ছিল - ১৭২ জন নিহত এবং ৩৫৮ জন আহত। 
  • ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে ‘প্রতিরোধ দিবস' পালন করে - ২৩ মার্চ। 
  • স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয় - অসহযোগ আন্দোলন। 
  • ‘লোকটি এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু, এবার তারা শাস্তি এড়াতে পারবে না’ উক্তিটি করেছিল - জেনারেল ইয়াহিয়া খান। 
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক ঘোষণা করা হয় - ৩ মার্চ।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ 
  • ভাষণকাল : ৭ মার্চ, ১৯৭১। 
  • ভাষণ শুরু : বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। 
  • স্থান : রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), রমনা, ঢাকা।    
  • মোট সময় : ১৮ মিনিট, মতান্তরে ১৯ মিনিট। 
  • শব্দ সংখ্যা : ১১০৮টি। 
  • চিত্র ধারণকারী : পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের এমএনএ। 
  • রেকর্ডকারী : এএইচ খন্দকার। 
  • ভাষণে দাবি ছিল : ৪টি। 
  • প্রথম লাইন : ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
  • শেষ লাইন : এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। 
  • ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য ঘোষণা করে : ৩০ অক্টোবর, ২০১৭। 
  • ভাষণটি অনূদিত হয় : ১২টি ভাষায়। 
  • ৭ মার্চ ভাষণ প্রদানকালে যে আন্দোলন চলছিল - অসহযোগ আন্দোলন। 
  • অসহযোগ আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছিল - ৭ মার্চ ভাষণের পর। 
  • অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় - ৭ মার্চ ভাষণে। 
  • ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ সংবিধানের যে তফসিলে অন্তর্ভুক্ত— পঞ্চম তফসিলে।


বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাত শেষে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা (অনূদিত) 
ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।
---শেখ মুজিবুর রহমান (২৬ মার্চ, ১৯৭১)

  • স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের শুরু - ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত বারোটার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। 
  • স্বাধীনতার ঘোষক - জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 
  • আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি হয় - ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। 
  • স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে সংযোজন হয় - পঞ্চদশ সংশোধনীতে। 
  • আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন - অধ্যাপক ইউসুফ আলী। 
  • ২৬ মার্চ অপরাহ্ন ২টা ৩০ মিনিটে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক - আব্দুল হান্নান। 
  • ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন - মেজর জিয়াউর রহমান।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post