গাণিতিক যুক্তি
বাস্তব সংখ্যা (Real Number)
প্রাথমিক আলোচনা
বাস্তব সংখ্যার (Real Number) বিস্তৃতি সুবিশাল। তাই বাস্তব সংখ্যার বিশদ আলোচনা
করতে হলে আমাদের বাস্তব সংখ্যার পাশাপাশি সংখ্যা উদ্ভব কিংবা আবিষ্কারের সাথে
পরিচিত হওয়া জরুরি। মূলত বাস্তব সংখ্যার কন্টেন্ট হলেও আমরা বাস্তব সংখ্যার সাথে
সংখ্যা নিয়ে খুব ভালো একটা সম্যক ধারণা নিব এবং পরবর্তীতে এই বিষয়বস্তু গুলো
আমাদের গণিতের আসল মজা দিবে। বিরক্তিকর আর ভয়ানক গণিত হয়ে যাবে আপনার সবচে প্রিয়
আর পছন্দের সাবজেক্ট।
মানুষ মূলত তার প্রয়োজনের তাগিদেই গুণতে ও লিখতে শেখে। সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ
লিখার জন্যে বিভিন্ন চিহ্ন ও প্রতীক ব্যবহার করতো। আমরা গণনার জন্যে ১, ২, ৩, ৪
কিংবা i, ii, iii, অথবা 1, 2, 3 ইত্যাদি চিহ্ন ব্যবহার করি। পরিমাণকে প্রতীক তথা
সংখ্যা আকারে প্রকাশ করার পদ্ধতি থেকেই গণিতের উৎপত্তি। সংখ্যার ইতিহাস মানব
সভ্যতার ইতিহাসের মতনই প্রাচীন৷ তবে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, প্রাচীন
মিশেরের পুরোহিতরা প্রথম আনুষ্ঠানিক গণিতের ব্যবহার শুরু করে। তাই ধরা হয়,
সংখ্যাভিত্তিক গণিতের জন্ম যীশুখৃষ্টের জন্মের প্রায় ২ হাজার বছর পূর্বে। এরপর,
প্রাচীন ভারতবর্ষের গণিতবিদগণ শূন্য ও ১০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি এবং চীন ও
আরবীয়রা শূন্য, ধনাত্মক, ঋণাত্বক, পূর্ণ সংখ্যা, ভগ্নাংশ, মূলদ, অমূলদ ইত্যাদি
সংখ্যার সাথে আমাদের পরিচয় করান আর এভাবেই সংখ্যাভিত্তিক গণিতের জন্ম হয়েছিল।
বাস্তব সংখ্যা : কোনো বাস্তব সংখ্যা একটি মান যা একটি অসীম
দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট সরলরেখা বরাবর একটি পরিমাণ নির্দেশ করে। ধনাত্মক, ঋণাত্বক এবং
শূন্য সবই বাস্তব সংখ্যা। বাস্তব সংখ্যাকে ইংরেজিতে Real Number বলা হয় এবং একে R
দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
সংজ্ঞা : যে সকল সংখ্যাকে সরলরেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় তাদেরকে বাস্তব
সংখ্যা বলা হয়।নিম্নে বাস্তব সংখ্যার ডায়াগ্রাম বা সরলরেখার মাধ্যমে বাস্তব
সংখ্যার সরলরেখা দেখানো হল:
বাস্তব সংখ্যার শ্রেণিবিন্যাস
বাস্তব সংখ্যারকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
- মূলদ সংখ্যা
- অমূলদ সংখ্যা
বাস্তব সংখ্যার প্রকারভেদ ৩ ধরনের হলেও প্রধানত ২ (মূলদ এবং অমূলদ) গাছের
শাখাপ্রশাখার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
পরবর্তি অংশ আরো ভালো করে বুঝতে সংখ্যা পদ্ধতির শ্রেণি বিভাগ দেখে নিন।
বাস্তব সংখ্যায় পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখতে হলে আপনাকে উপরোল্লিখিত প্রকারভেদগুলো
সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। চলুন এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে আসি:
১। মূলদ সংখ্যা (Rational Number) : যে সমস্ত সংখ্যা দুইটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত
(ভাজক শূন্য ব্যতিত) আকারে প্রকাশ করা যায়, তাদেরকে মূলদ সংখ্যা বলে। মূলদ
সংখ্যার সেটকে Q দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যেখানে,
Q={x:x=$\frac pq$; যেখানে p, q∈Z এবং Q ≠ 0}
২। অমূলদ সংখ্যা (Irrational Number) : যে সমস্ত সংখ্যা মূলদ সংখ্যা নয় অর্থাৎ যে
সমস্ত সংখ্যা দুইটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত আকারে প্রকাশ করা যায় না, তাদেরকে অমূলদ
সংখ্যা বলে। মূলদ সংখ্যার সেটকে Q' দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যেমন:
- পূর্ণবর্গ নয় এমন যেকোন স্বাভাবিক সংখ্যা সংখ্যার বর্গমূল অমূলদ সংখ্যা। উদাহরণ: $\sqrt{২১}$, $\sqrt{৩}$, $\sqrt{৫}$, $\sqrt{২}$ এবং e ও π অমূলদ সংখ্যা।
- দশমিকের পরের ঘরগুলো যদি ভিন্ন ভিন্ন আকারে অসীম (পৌনঃপুনিক নয়) হয়, তবে সংখ্যাটি অমূলদ সংখ্যা। উদাহরণ: ৫.৩৫৭৬।
৩। ভগ্নাংশ (Fraction) : যে সব সংখ্যাকে ভাগ করলে নিঃশেষে বিভাজ্য হয় না অর্থাৎ, a
যদি b দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য না হয়, তবে $\frac ab$ একটি ভগ্নাংশ। এখানে,
লব (Numerator) = a ও
হর (Denominator) = b
৪। পূর্ণসংখ্যা (Integer) : পূর্ণসংখ্যাকে Integer বলা হয়। ধনাত্মক, ঋণাত্বক কিংবা
শূন্য কে পূর্ণসংখ্যা (তবে ভগ্নাংশ বা দশমিক সংখ্যা হবে না) বলে। পূর্ণ সংখ্যার
সেটকে Z দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
Z={...... -3, -2, -1, 0, 1, 2, 3, ......}
বা, Z={0, ±1, ±2, ±3 ......}
খেয়াল করুন : শূন্য (০) একটি Integer বা পূর্ণ সংখ্যা।
৫। প্রকৃত ভগ্নাংশ (Proper Fraction) : যে ভগ্নাংশের হর বড় এবং লব ছোট তাকে প্রকৃত
ভগ্নাংশ (হর > লব) বলে। উদাহরণ: $\frac ৫৭$, $\frac {৩}{১১}$, $\frac {৯}{১৩}$ ইত্যাদি।
৬। অপ্রকৃত ভগ্নাংশ (Improper Fraction) : যে ভগ্নাংশের হর ছোট হয় এবং লব বড় হয়
তাকে অপ্রকৃত ভগ্নাংশ (হর < লব) বলে। উদাহরণ: $\frac ৩২$, $\frac ৭৪$, $\frac ৯৪$ ইত্যাদি।
৭। মিশ্র ভগ্নাংশ : যে ভগ্নাংশে পূর্ণ সংখ্যার সঙ্গে প্রকৃত ভগ্নাংশ যুক্ত থাকে
সে ভগ্নাংশকে মিশ্র ভগ্নাংশ বলে। মিশ্র ভগ্নাংশের পূর্ণ অংশকে সমস্ত বলে।
উদাহরণ: $২\frac ৫৭$, $৩\frac {৯}{১১}$, $৪\frac ৩৭$,
৮। দশমিক ভগ্নাংশ : যে ভগ্নাংশকে দশমিক চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় অথবা মূলদ
এবং অমূলদ সংখ্যার ভগ্নাংশকে দশমিক ভগ্নাংশ বলে। উদাহরণ: ১.২৩৪, ০.৫৬৭
ইত্যাদি।
৯। স্বাভাবিক সংখ্যা (Natural Number) : সাধারণত ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যাকে স্বাভাবিক
সংখ্যা বলে। যেমন: ১,২,৩,৪ ইত্যাদি। একে N দ্বারা প্রকাশ করা হয়। স্বাভাবিক
সংখ্যাকে ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যাও বলা হয়।
১০। ঋণাত্বক পূর্ণ সংখ্যা : শূন্য (০) থেকে ছোট সংখ্যা সমূহকে ঋণাত্বক সংখ্যা
বলে। ঋণাত্বক সংখ্যা যেহেতু পূর্ণ সংখ্যার একটি প্রকারভেদ আর তাই ঋণাত্বক পূর্ণ
সংখ্যা বলতে মূলত শূন্যের চেয়ে ছোট পূর্ণ সংখ্যা গুলো বুঝায়। উদাহরণ: –১, –২, –৩,
–৪ ইত্যাদি।
১১। সসীম দশমিক ভগ্নাংশ : যে সংখ্যাকে ভাগ করলে দশমিক সংখ্যার পরের সংখ্যাগুলো
সসীম বা নির্দিষ্ট ফলাফল হয়ে শেষ হয়, তাকে সসীম দশমিক ভগ্নাংশ বলে। উদাহরণ: $\frac ৩২$, =
১.৫।
১২। অসীম দশমিক ভগ্নাংশ : কোনো দশমিক ভগ্নাংশ এর মধ্যে দশমিক বিন্দুর পর
অঙ্কগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাকে অসীম দশমিক ভগ্নাংশ বলে। যেমন $\frac {১০}{৩}$ = ৩.৩৩৩.... এরকম
একই সংখ্যা বার বার পুনরাবৃত্তি হয়।
১৩। পৌনঃপুনিক দশমিক ভগ্নাংশ : যেসব দশমিক ভগ্নাংশে দশমিক বিন্দুর ডানে একটি অঙ্ক
ক্রমান্বয়ে বারবার বা একাধিক অঙ্ক পর্যায়ক্রমে বারবার আসে, তাকে পৌনঃপুনিক
দশমিক ভগ্নাংশ বলে। একে আবৃত দশমিক ভগ্নাংশ ও বলা হয়। পৌনঃপুনিক দশমিক ভগ্নাংশে
যে অংশ রিপিট অর্থাৎ পুনঃপুনঃ হয়, তাকে আবৃত অংশ বলে। যেমন: ৪.৫৫৫৫৫৫...,
১২.২৩৪৫৬৪৫৬..... ইত্যাদি।
এবার সংখ্যা নিয়ে আরো কিছু জানুন:
১৪। মৌলিক সংখ্যা (Prime Number) : ১ হতে বৃহত্তর যে সকল সংখ্যার ১ এবং ঐ সংখ্যা
ব্যতীত আর অপর কোনো গুণনীয়ক থাকে না, তাদের মৌলিক সংখ্যা বলে। উদাহরণ: ২, ৫, ৭, ১১,
১৩ ইত্যাদি।
জেনে রাখুন : ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত মোট ২৫ টি মৌলিক সংখ্যা আছে। যথা: ২, ৩, ৫, ৭,
১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯, ৩১, ৩৭, ৪১, ৪৩, ৪৭, ৫৩, ৫৯, ৬১, ৬৭, ৭১, ৭৩, ৭৯, ৮৩,
৮৯, ৯৭। এই মৌলিক সংখ্যাগুলোর যোগফল ১০৬০।
প্রতি দশে কতটি করে মৌলিক সংখ্যা আছে তা বুঝবেন কি করে? দেখুন :
১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ২, ৩, ৫, ৭ = ৪টি
১১ থেকে ২০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ১১, ১৩, ১৭, ১৯ = ৪টি
২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ২৩, ২৯ = ২টি
৩১ থেকে ৪০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৩১, ৩৭ = ২টি
৪১ থেকে ৫০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৪১, ৪৩, ৪৭ = ৩টি
৫১ থেকে ৬০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৫৩, ৫৯ = ২টি
৬১ থেকে ৭০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৬১, ৬৭ = ২টি
৭১ থেকে ৮০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৭১, ৭৩, ৭৯ = ৩টি
৮১ থেকে ৯০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৮৩, ৮৯ = ২টি
৯১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যায় মৌলিক সংখ্যা ৯৭ = ১টি
অর্থাৎ, কোন দশে কতটি মৌলিক সংখ্যা তা মনে রাখার সহজ পদ্ধতি হলো : ৪৪-২২-৩২২-৩২১। এই নাম্বারটি মোবাইল নাম্বারের মত মুখস্ত করে করে ফেলা উচিৎ।
১৫। কৃত্রিম সংখ্যা (Composite Number) : যে সকল সংখ্যার ১ এবং ঐ সংখ্যা ব্যতীত
আরো অপর গুণনীয়ক থাকে, তাদের কৃত্রিম সংখ্যা বলে। উদাহরণ: ৬, ৮, ৯, ১০
ইত্যাদি।
১৬। সহমৌলিক সংখ্যা (Co–Prime Number) : দুই বা ততোধিক সংখ্যার সাধারণ গুণনীয়ক
(উৎপাদক) কেবলমাত্র ১ হলে, ঐ সংখ্যাগুলো পরস্পর সহমৌলিক হয়। যেমন:
১৬ এর মৌলিক উৎপাদক ১, ২, ২, ২, ২
২৫ এর মৌলিক উৎপাদক ১, ৫, ৫
তাহলে দেখা যাচ্ছে দুটি সংখ্যা ১৬ এবং ২৫ এর ১ ছাড়া আর অন্য কোন সাধারণ গুণনীয়ক
নেই। সুতরাং ১৬ ও ২৫ পরস্পর সহমৌলিক।
বাস্তব সংখ্যার স্বীকার্য ভিত্তিক বর্ণনা
১. আবদ্ধতা (Clusure): p, q ∈ Z হলে
- a+b ∈ R
- a-b ∈ R
- ab ∈ R
- a÷b (b≠0) ∈ R
অর্থাৎ, যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগের প্রক্রিয়ায় R আবদ্ধ।
২. বিনিময়যোগ্যতা (Commutativity) : a, b ∈ R হলে,
- a+b = b+a
- ab = ba
৩. সংযোজনযোগ্যতা (Associativity) : a, b, c ∈ R হলে
- (a+b)+c = a+(b+c)
- (ab)c = a(bc)
৪. বন্টনযোগ্যতা (Distributivity) : a, b, c ∈ R হলে
- a(b+c) = ab + ac
- (b+c)a= ba + ca
বাস্তব সংখ্যার গুণন যোগের উপর বন্টনযোগ্য।
৫. অভেদকের অস্তিত্ব (Existence of Identity) : ১টি মাত্র সংখ্য ০ (শূন্য) ∈ R বিদ্যমান, যেন সকল a ∈ R এর জন্য a+0 = 0+a = a এবং ১টি মাত্র সংখ্যা 1∈R বিদ্যমান যেন সকল a∈R এর জন্য a.1 = 1.a = a
0 কে যোগের অভেদক এবং 1 কে গুণনের অভেদক বলা হয়।
৬. বিপরীতকের অস্তিত্ব (Existence of Inverse) : সকল a ∈ R এর জন্য একটি মাত্র (-a) ∈ R এবং শূন্য ব্যতীত প্রত্যেক a ∈ R এর একটি মাত্র a-1 ∈ R বিদ্যমান, যেমন:
- a+(-a) = (-a)+a = 0
- a.a-1 = a-1.a = 1
৭. অনন্যতা (Uniqueness): a, b, c, d ∈ R হলে এবং a = b ও c = d হলে,
- a + c = b + d
- ac = bd
বাস্তব সংখ্যার থিওরী এগুলো জানলেই যথেষ্ট। যদি আপনার উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো ভালো
আয়ত্বে থাকে তাহলে যেকোনো প্রতিযোগীতামূলক বা চাকুরীর পরীক্ষার জন্যে বাস্তব
সংখ্যা নিয়ে আপনাকে আলাদা করে আর কিছু পড়তে হবে না। তবে হ্যা— বাস্তব সংখ্যা নিয়ে
আপনার প্রস্তুতিকে শতভাগ করতে আমাদের বাস্তব সংখ্যা নিয়ে পরবর্তী গাণিতিক পোস্টগুলি পড়ুন।
Azibul Hasan