↬ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা
↬ একজন বীরশ্রেষ্ঠের কথা
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল
ভূমিকা : ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন,
তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ মোস্তফা কামাল।
মোস্তফা কামালের পরিচয় : ভোলা জেলার দৌলতখান থানার একটি গ্রামের নাম
হাজিপুর। ১৯৪৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মোস্তফা কামাল এ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর
বাবার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন হাবিলদার।
মোস্তফা কামালের ছেলেবেলা : ছেলেবেলা থেকেই মোস্তফা কামাল খুব সাহসী ও
ডানপিটে ছিলেন। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। কুমিল্লা সেনানিবাসে
সৈনিকদের সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজ কিশোর মোস্তফা কামাল মুদ্ধ হয়ে দেখতেন আর ভাবতেন-
আমিও একজন সৈনিক হব।
সৈনিক হিসেবে যোগদান : ১৯৬৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে
যোগদান করেন। এরপর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্টে নিয়োগ লাভ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মোস্তফা কামাল : ১৯৭১ সাল। পাকিস্তান
সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনকে মেনে নিতে পারল না। ২৫ মার্চ রাতের
অন্ধকারে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল এ দেশের রিসস্ত্র মানুষের ওপর। এ সময় যেসব বাঙালি
সৈন্য বিদ্রোহ করেছিলেন, মোস্তফা কামাল তাঁদের অন্যতম। যুদ্ধ চলছে। শত্রুর আক্রমণ
প্রতিহত করার জন্য ২নং প্লাটুনকে গঙ্গাসাগরের উত্তরে দরুইন গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা
শিবিরে পাঠানো হয়। মোস্তফা কামাল এ প্লাটুনের একজন সৈনিক ছিলেন।
মোস্তফা কামালের কৃতিত্ব : ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। চার দিকে প্রচণ্ড শব্দ,
অস্ত্রের গর্জন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুরইনের দিকে এগিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের
ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। প্রচণ্ড যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হলেন।
পাশেই ছিলেন মোস্তফা কামাল। তিনি এগিয়ে এলেন। নিমেষে হাতে তুলে নিলেন তাঁর
অস্ত্র। অবিরাম গুলি। মোস্তফা কামাল শত্রুকে পুরো ঘায়েল করতে পারেননি, বাঁচিয়ে
দিয়েছিলেন নিজের একটি কোম্পানিকে। আর তাই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি চিরকালের জন্য
বেঁচে রইলেন।
উপসংহার : মোস্তফা কামাল আমাদের গর্ব, অহংকার। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত
দিন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোস্তফা কামাল আমাদের মনের মণি কোঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে
থাকবেন।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ
ভূমিকা : স্বাধীনতাযুদ্ধে যাঁরা বীরের মতো লড়াই করে শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদের
একজন নূর মোহাম্মদ শেখ। তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়।
জন্ম : বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ তৎকালীন যশোর জেলার নড়াইল সাব
ডিভিশনের মহেশখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তারিখ হলো ১৯৩৬ সালের ২৬
ফেব্রুয়ারি।
পিতা-মাতা : নূর মোহাম্মদ শেখের পিতার নাম আমানত শেখ আর মাতার নাম
জান্নাতুন নেসা।
শিক্ষাজীবন : নূর মোহাম্মদ শেখ বিশেষ পড়ালেখা করতে পারেননি। কারণ তাঁর
ঝোঁক ছিল গান, নাটক আর থিয়েটারের প্রতি।
কর্মজীবন : বাল্যকালেই নূর মোহাম্মদ শেখ পিতা-মাতাকে হারান। ফলে বদলে যায়
তাঁর জীবনের গতি। তিনি যোগ দেন ইপিআর বাহিনীতে।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার
পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নূর মোহাম্মদ শেখও বসে থাকেননি। যোগ দিলেন
স্বাধীনতাযুদ্ধে।
বীরত্ব : নূর মোহাম্মদ শেখ যশোরের গোয়ালহাট্টি ক্যাম্পে সহযোদ্ধাদের সাথে
টহল দিচ্ছিলেন। তাঁদের অবস্থানের খবর পেয়ে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক
থেকে ঘিরে ফেলে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসীম সাহসে তিনি সহযোদ্ধাদের রক্ষা
করেন।
যেভাবে শহিদ হলেন : যুদ্ধে নিজেদের অসহায়ত্ব টের পেয়ে নূর মোহাম্মদ শেখ
সহযোদ্ধাদের পিছিয়ে যেতে বলেন। আর তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধা নান্নু মিয়াকে কাঁধে
নিয়ে একাই যুদ্ধ করতে থাকেন। একসময় শত্রুর গুলিতে তিনি শহিদ হন।
‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি লাভ : স্বাধীনতাযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও বীরত্বের জন্য
তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
উপসংহার : বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। দেশের
জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন। আমরা তাঁকে কখনো ভুলব না।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ
ভূমিকা : ১৯৭১ সালে যাঁরা এ দেশের জন্য বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মুন্সী আবদুর রউফ।
জন্ম : ১৯৪৩ সালের ১ মে আবদুর রউফ ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানায়
সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা-মাতা : মুন্সী আবদুর রউফের পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান। তাঁর
মাতার নাম মকিদুন্নেসা।
শিক্ষাজীবন : আবদুর রউফ ছাত্র হিসেবে বেশ মেধাবী ছিলেন। শিক্ষকরা তাঁর ব্যাপারে
বেশ আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর পিতা মারা যান। এ কারণে আবদুর রউফের
শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।
কর্মজীবন : সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে আবদুর রউফ ইপিআর বাহিনীতে যোগ দেন।
সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ল্যান্স নায়েক হন এবং এক নম্বর মেশিনগান চালক পদে উন্নীত
হন।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান : ১৯৭১ সালে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আবদুর
রউফ তখন দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
বীরত্ব : পাকিস্তানি নৌ সেনাদের আক্রমণের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা মহালছড়ির
কাছে বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাশে অবস্থান নেন। পাকিস্তানিরা সাতটি
স্পিডবোট আর দুটি মোটর লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে
পাকিস্তানিদের ওপর। পাকিস্তানিরা সাতটি স্পিডবোট হারিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অবস্থা
বেগতিক দেখে আবদুর রউফ সহযোদ্ধাদের পিছু হটতে বলে একাই বীরের মতো যুদ্ধ করতে
থাকেন।
যেভাবে শহিদ হলেন : অসীম সাহস নিয়ে আবদুর রউফ একই প্রতিরোধ করতে থাকেন
শত্রুদের। হঠাৎ একটি গোলা এসে আঘাত হানে তাঁর শরীরে। শহিদ হন মুন্সী আবদুর রউফ।
‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি লাভ : স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের কারণে মুন্সী
আবদুর রউফ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি লাভ করেন।
উপসংহার : বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ বাংলার সাহসী সন্তান ছিলেন। তিনি
আমাদের গর্ব, আমাদের অসহংকার।