ভূমিকা : কোন জাতির সমৃদ্ধি নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের ওপর। বলা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের ওপর। বলা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকে। সোজা কথায় পেটে খেলে পিঠে সয়। জীবনে অভাব অনটন না থাকলে জীবনের সুন্দর বিকাশ সাধিত হতে পারে। তাই জীবনের সুখ-শান্তির জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতার ভিত্তি সুদৃঢ় হতে হবে। আর দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ়ভাবে গড়তে হলে দেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর প্রতি দেশবাসীর আকর্ষণ দেখাতে হবে। বিদেশের পণ্য ক্রয় করে জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করলে দেশের অর্থনীতিতে আসে প্রবল আঘাত। সেজন্য দেশের সম্পদ ব্যবহারের জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বর্তমান অবস্থা : স্বাধীন জাতির জন্য এটা বিশেষ অগৌরবের যে, আমরা বিদেশী পণ্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করি। দেশীয় জিনিসের প্রতি দেশের লোকদের তেমন কোন আগ্রহ নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তারা পারতপক্ষে দেশের পণ্য কিনতে চায় না। সামান্য জিনিসও বিদেশী হলে ভাল এমন একটা মনোভাব সবসময় কাজ করে। দেশীয় পণ্য যত ভালই হোক না কেন তার প্রতি একটা অনীহার ভাব অনেকের মনে বিরাজ করে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। বিদেশী পণ্যের একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে, অপরদিকে দেশীয় পণ্য বাজারে মার খেয়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার বিদেশী পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু চোরাচালানীরা অবৈধভাবে সেসব নিষিদ্ধ পণ্য দেশে এনে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার এই অপব্যাবহারের জন্য দেশের সমৃদ্ধি আসছে না বরং বৈদেশিক মুদ্রার অভাব প্রয়োজনীয় উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয় করা যাচ্ছে না।
কর্তব্য : এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না। স্বাধীন দেশের অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ় করে জাতীয় জীবনের কল্যাণ সাধনের জন্য স্বদেশের পণ্যের প্রতি মমত্ববোধ গড়ে তুলতে হবে- বিদেশী পণ্য বর্জন করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে যাতে অবৈধ পথে বিদেশী পণ্য দেশের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। সেই সঙ্গে দেশীয় পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরকারের পৃষ্ঠকোষকতা দান করা দরকার। দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন বর্তমান শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমস্যা দূরীকরণ, দেশীয় পণ্য বাজারজাতকরণ, মুলধন বিনিয়োগের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, কারিগরি সাহায্যের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনবোধে আইন করে বিদেশী পণ্য বর্জনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবশ্য মুক্তবাজার অর্থনীতির বদৌলতে বিদেশী পণ্যে দেশের বাজার ছেয়ে গেছে। তবে সস্তা পেলেই বিদেশী পণ্য কিনতে হবে এমন ধারণা সঠিক নয়। কৃচ্ছ্রতায় বিশ্বাসী হলে এ সংকট পরিহার করা তেমন কঠিন নয়।
দেশবাসীর এ ব্যাপারে বিশেষ কর্তব্য রয়েছে। দেশের সকলকে বিশেষ সচেতন হতে হবে যাতে বিদেশী পণ্যের ব্যবহারে দেশের সম্পদ নষ্ট না করা হয়। জনগণ যদি এ ব্যাপারে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় তবে বিদেশী পণ্য সহজেই বর্জিত হবে এবং দেশীয় পণ্য পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবে। সেই সঙ্গে দেশীয় পণ্যের মান বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের দেশের জিনিস যেকোন অংশেই বিদেশের জিনিসের চেয়ে নিচু মানের নয় সেকথা জনগণকে বুঝাতে হবে। মুখে মুখে অনেকেই দেশপ্রেমের কথা বলেন। কথায় কথায় দেশের প্রেমে বিগলিত হয়ে ওঠেন। তবে এ সব যে কেবল ফাঁকা বুলি তা অনুভব করা যায় তাদের চাল-চলন যাপন পদ্ধতি দেখলে। অনেকেই মুখে বড় কথা বললেও বিদেশী পণ্য ছাড়া তাঁদের চলে না। বিদেশমুখী এ হেন মনোভাবের জন্য স্বদেশের পণ্যের প্রতি বিকৃষ্ণ ভাব সবার মধ্যে দেখা যায়। ফলে নিজের দেশের পণ্যের প্রতি ভালবাসা দেখিয়ে আদর্শ স্থাপনের মত ত্যাগী মানুষ নেই।
উপসংহার : দেশের পণ্য ব্যবহারের মধ্যেই জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি নির্ভরশীল। সেজন্য সরকার সাম্প্রতিককালে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিদেশী অনাবশ্যক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ হয়েছে, চোরাচালানী নিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের এই মহতী উদ্যোগের সঙ্গে দেশবাসীর সহযোগিতা করতে হবে এবং স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের পণ্য ব্যবহারে তৎপর হতে হবে।