মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখার জন্য বাঙালির আত্মদানের রক্তরঞ্জিত শহীদ দিবস অমর একুশে ফেব্রুয়ারি নতুন সহস্রাব্দের প্রথম থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্বব্যাপী মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্বের কাছে বাংলা ভাষা আর তার সগৌরব ঐতিহ্য এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
বাংলা ভাষার জাতীয় মর্যাদার পরিপূর্ণ স্বীকৃতি লাভ সম্ভবপর হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। বাংলা ভাষা সৃষ্টির প্রারম্ভ কাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ না করার পরিপ্রেক্ষিতে অবহেলিত ও অনদৃত হয়ে যুগ যুগ ধরে স্বার্থান্বেষী মহলের অশুভ তৎপরতার বিষনিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে তাকে অগ্রসর হতে হয়েছে। বিচিত্র প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলা ভাষার গুরুত্ব তার সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমাকে নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল করে রেখেছে। তবে যথাযোগ্য পরিচর্যার অভাবে বাংলা ভাষা দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের অনুসারী হয়েও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপযুক্ত গুরুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। অথচ ভাষার অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য, এর আকর্ষণীয় গুণাবলি এবং বিপুল জনগোষ্ঠী কর্তৃক এর ব্যবহারের দিক বিবেচনায় এই ভাষার আন্তর্জাতিক চারিত্র্যের সম্ভাবনা অত্যধিক বলে মনে হতে পারে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সপ্তম স্থানের অধিকারী এই ভাষায় বৈচিত্র্যধর্মী ভাব প্রকাশের উপযোগিতা কম নয়। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারে বহু ভাষার শব্দরাজি থেকে উদার সংগ্রহের নিদর্শন বিদ্যমান। সর্বপ্রকার ধ্বনি উচ্চারণের সম্ভাব্যতা, ভাব প্রকাশের ব্যাপক উপযোগীতা এবং শ্রুতিমাধুর্য ও প্রাঞ্জলতা এই ভাষাকে করেছে বিশিষ্ট। বাংলা গদ্যের উপৎপত্তিকালে বিশিষ্ট পরিচর্যাকারী উইলিয়াম কেরি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, যথাযোগ্য পরিচর্যাকারী বাংলা ভাষা সৌন্দর্য ও প্রাঞ্জলতায় বিশ্বের কোন ভাষায় পশ্চাদপদ হতে পারবে না। সে যুগে জনৈক বিদেশী পণ্ডিত ইটালীয় ভাষার শ্রুতিমাধুর্য এবং জার্মান ভাষার জটিল ভাবপ্রকাশ ক্ষমতার সম্মিলন বাংলা ভাষায় বিদ্যমান বলে মনে করেছিলেন।
হাজার বছরের সগৌরব পদচারণার ফলে বাংলা ভাষার মাধ্যমে যে বিপুল সাহিত্যসম্ভার রূপায়িত হয়ে উঠেছে তার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কম নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাংলা ভাষায় অপরাপর সাহিত্য কীর্তিও আন্তর্জাতিক পাঠকসমাজে আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী ভাবমূলক কবিতার কথা উল্লেখযোগ্য। তাঁর যে বলিষ্ঠ বাণী বাঙালি জীবনে আন্দোলনের প্রেরণা যুগিয়েছে তা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হ?য়ে বিভিন্ন দেশে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বাংলাদেশের মায়াময় পল্লীর যে আনন্দবেদনা রূপ দিয়েছেন তাতে বিদেশীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে কবিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিদেশী ভাষায় বাংলার অনুবাদ কর্ম বিশ্বের কাছে বাঙলা ভাষাকে অধিকতর মর্যাদাবান করে তুলছে। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীর ভূমিকা উৎসাহজনক।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যের সীমাহীন ভাণ্ডারের প্রলোভন বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। বিশ্বের উন্নতদেশের লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বাংলাদেশের লোক সাহিত্যের সামঞ্জস্য বিদ্যমান। বরং বাংলার লোকসাহিত্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষকগণ এখানকার রসাস্বাদনে বিশ্বখ্যাত রোঁমা রোঁমা, সিলভা লেভী, স্যার জর্জ গ্রীয়ারসন, উইলিয়াম রদেনস্টাইন প্রমুখ মনীষীগণ অভিভূত হয়েছিলেন।
বাংলা ভাষার গুণাবলি ছিল বলেই বরাবরই বিদেশীরা এই ভাষার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ দেখিয়েছেন। এই ভাষার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে মধ্যযুগে বিদেশাগত মুসলমান শাসকগণ উদার পৃষ্ঠপোষকতা দেখিয়েছেন। পর্তুগিজরা রোমান হরফে বাংলা ভাষা রূপায়িত করে এর বিচিত্র ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলেন। ইংরেজ পাদ্রিরা নিজেরা বাংলা শিক্ষা করে গদ্যের ব্যবহার সম্প্রসারণে সহায়তা করেছেন। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। বাংলা ব্যাকরণের রূপটি বিদেশীদের হাতেই প্রথম স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বাংলা ভাষার যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তা আগে কখনও সম্ভব হয়নি। শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বাংলা ভাষা আজ জাতীয় জীবনে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে। ভাষার মর্যাদার জন্য রক্তদান একে ঐতিহ্যমণ্ডিত ও শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে, আর এর বর্তমান সম্ভাবনাও বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দান করেছিলেন। সে ঐতিহ্য উজ্জ্বলতর করা হয় শেখ হাসিনার অনুরূপ ভাষণের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার নাম বিশ্ববাসীর কাছে মাতৃভাষার জন্য বলিষ্ঠ সংগ্রামেরই নাম।
একটি স্বাধীন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্ববাসীর কাছে দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাড়িয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আজ বাংলার আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং এর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জাতি আজ এ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অনেকে আজ বাংলা ভাষা শিখে এর আধুনিক সাহিত্য সম্ভারের রসাস্বাদনের এবং এর গবেষনার ফল সম্পর্কে অবহিত হওযার জন্য আগ্রহশীল। বিদেশীদের এখন আর বাংলা শেখা বিচিত্র কিছু নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যেবিদেশে বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রচেষ্টা এখন সহজেই লক্ষণীয়। রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ে বাংলা ভাষা বিদেশে উচ্চারিত হচ্ছে, অনুবাদের মাধ্যমে এখানকার সাহিত্য বিদেশীদের কাছে রস পরিবেশন করছে। ফলে বাংলা ভাষা এখন আর কোন সংকীর্ণতায় আবদ্ধ নয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণাটি অমর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলা যে একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ভাষা এবং একমাত্র এ ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে কিছু মাতৃভাষা-প্রেমিক- এই সগৌরব ঐতিহ্য আজ সারা বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত। আজকের প্রজন্মের বাঙালিকে উপলব্ধি করতে হবে যে, মহান একুশের অনির্বাণ চেতনার পথ ধরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সুমহান গৌরব সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে বাংলা ভাষা। তাই বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আন্তরিকভাবে বাঙালিকে অনুরাগী হতে হবে। জীবনের সকল কাজে যেমন বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম হিসেবে রূপ দিতে হবে বাংলা ভাষাকে। বাংলা ভাষার সাহিত্য সম্পদ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রূপান্তরিত করে বিশ্ববাসীকে আরও আগ্রহী করে তুলতে হবে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা ব্যাপকতর করার জন্য প্রত্যেক বাঙালিকে তৎপর হতে হবে।