ভূমিকা : কর্মই জীবন। কর্মমুখর জীবনের সফলতাই মানুষকে যথার্থ মর্যাদার
অধিকারী করে। একজন কবি মানবজীবনের কর্মফলের গুরুত্ব বিবেচনা করে লিখেছেন,
বুনিয়াদি বটবৃক্ষ, কত নাম তার,
অখাদ্য তাহার ফল, কাকের আহার।
যার ফল তেমন কোন উপকারে লাগে না তাকে কেউ মর্যাদা দেয় না। মানবজীবনের বেলায় এ
সত্য খুব ভালভাবে উপলব্ধি করা যায়। মানবজীবনের সফলতা নির্ভর করে তার কাজের মধ্যে।
কাজের অবদান বিচার করে তার গুরুত্বের দিকটির প্রমাণ পাওয়া যায়। বংশগৌরব বা
অভিজাত্যের মাপকাঠিতে মানুষের আসল পরিচয় ফুটে ওঠে না।
মর্যাদার ধারণা : আমাদের সমাজে নানা ধরনের লোক বস করে। সমাজের মধ্যে ধনী
লোক আছে, আবার গরিব লোকও আছে, ভাল মানুষও আছে, আবার মন্দ লোকেরও অভাব নেই।
সংসারের এই বিচিত্র মানুষের সত্যিকার পরিচয় সন্ধান করলে তার কাজের মধ্যে যেমন আসল
পরিচয় পাওয়া যাবে তেমন পরিচয় অন্য কোন দিক থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনেকে
বংশগৌরব বা অভিজাত্যের বড়াই করে। তাদের ধারণা কোন বিখ্যাতি বড় বংশে জন্মগ্রহণ
করলেই ভাল লোক হবে এমন ধারণা অনেকের আছে। বিত্তশালী লোকেরাও টাকার গৌরব প্রকাশ
করে নিজেদের বড় মনে করে।
বংশগৌরব : অবশ্য আমাদের সমাজের মধ্যে অর্থগৌরব বা বংশমর্যাদার স্থান
অনেকটা উপরে বলে মনে করার মত লোকের অভাব নেই। এর ফলে সমাজে এক শ্রেণীর অহঙ্কারী
লোক অপর লোকের ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে। এতে
সমাজে আসে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ, সৃষ্টি হয় অপ্রীতিকর অবস্থা।
মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নির্ণয় করতে হলে তার এই বংশগৌরবকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন
নেই। কারণ আজকের মানুষের তৈরি সমাজ ব্যবস্থায় যে ব্যবধান তা মানুষের স্বার্থে
মানুষেরই তৈরি। কিন্তু স্রষ্টা মানুষে সমান করেই সৃষ্টি করেছে। স্রষ্টার কাছে সব
মানুষই সমান। অথচ মানুষ নিজের স্বার্থ সাধনের জন্য উঁচু-নিচু পার্থক্যের সৃষ্টি
করে নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। এতে মানুষের যে পরিচয় প্রকাশ পায় তাতে
যথার্থ মনুষ্যত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় না। সে কারণে মানুষের মর্যাদা যাচাই করার
জন্য শুধু আভিজাত্যের দোহাই দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ভাল বংশে জন্মগ্রহণ করা হল
বলে আর কিছুই করার নেই এমন ধারণা ভুল। বরং যে কোন বংশে জন্মগ্রহণ করা দৈব
ঘটনামাত্র, এর ওপর মানুষের কোন হাত নেই। পরবর্তী জীবনে যে কতটুকু কাজ করেছে, সে
কাজের ফল কি হয়েছে, সে সম্পর্কে বিচার বিবেচনা করলে মানুষের জীবন মর্যাদা পরিপন্ন
হতে পারে।
কর্মই জীবন : মানুষের জীবন কাজকর্মে মুখরিত হলেই তার বৈশিষ্ট্য জনসমাজে
প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব। এই পৃথিবীতে স্রষ্টা মানুষকে পাঠিয়েছেন একটা বিশেষ
দায়িত্বের বোঝা দিয়ে। শুধু নিজের খাওয়া-পরার সাধনায় জীবন কাটাবে তা কেউ মনে করে
না। বরং সংসারে স্রষ্টার নির্দেশিত পতে চলতে গিয়ে কে কতটুকু কাজে লেগেছে সেটা
বিবেচনার দরকার। দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে পারলে সে কাজের মূল্য অনেক বেশি মনে
করা হয়। যারা নিজের জন্যই কাজ করে তাদের জীবন যে সার্থক হয়েছে এমন মনে করা হয় না
এবং তাদের জীবনের অবসানের সাথে সাথে মানুষও তাদের কথা ভুলে যায়। কিন্তু দেশ ও
জাতির বৃহত্তর কল্যাণে যাঁরা নিজেদের কর্মময় জীবন উৎসর্গ করেন তাঁদের মহান অবদানে
মানুষের বহু অপকার সাধিত হয় এবং প্রতিদানে মানুষ তাঁদের চিরদিন স্মরণ করে। কে ভাল
বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, অথবা কার জন্ম সমাজের নিচু স্তরে হয়েছিল একথা কেউ তলিয়ে
দেখে না, বরং কে তার সমাজকে ও জাতিকে কতটুকু দান করতে পেরেছে সেটাই বিবেচনার
বিষয়।
আভিজাত্য : অভিজাত লোক বলে নিছক আভিজাত্যের জন্য সম্মান পাবে এমন হতে পারে
না, তার সম্মানের জন্য তাকে ভাল কাজের নমুনা দেখাতে হবে। মাকাল ফলে রঙের কোন
গুরুত্ব নেই। কারণ তা গাব্যর হিসেবে কাজে আসে না। বইরের সৌন্দর্য আসার বলে
বিবেচিত হয় যদি তার কোন গুণ না থাকে। অন্যদিকে নিজের ভাল কাজের জন্য অনেক কৃতি
মানুষ সমাজে মর্যাদা পায়, মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে। তার বংশের কথা কেউ চিন্তাও করে
না। শুধু নিজের ভালকাজের জন্য মানুষের হৃদয়ে সে সমাদর পায়।
উপসংহার : যে গাছ ফল দেয় না তার কোন আদর নেই। মানুষের জীবনেও তেমনি। কাজের
ফল কি পাওয়া গেছে তা যাচাই করেই মানুষের সম্মান দেওয়া হয়। তাই মানুষের যদি সম্মান
লাভের ইচ্ছা থাকে তবে তাকে ভাল কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মানুষের মহান কীর্তি
হিসেবে সেসব কাজের ফল যুগ যুগ ধরে অপর মানুষের উপকারে আসে। কবি তাই লিখেছেন :
চাঁদের আলোর মত মানুষের কাজের গৌরব চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার সাধনা হওয়া উচিত। মিথ্যা
বংশগৌরব বা অহঙ্কারবোধ ভুলে গিয়ে কাজের মাঝে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে হবে। তাতেই
জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। কাজ করার জন্যই মানুষের জীবন। আভিজাত্য দেখানোর কোন
প্রয়োজন সেখানে নেই। কাজের অবদান মানুষকে বাঁচায়ে রাখে আর আভিজাত্যবোধ মানুষকে
অন্য মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।