ভূমিকা : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড – একথা যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে। কিন্তু শিক্ষাকে সর্বজনীন করা হয়নি এবং শিক্ষাহীনতা জাতীয় জীবনে দুর্বিষহ হয়ে দুর্ভোগের বোঝা বাড়াচ্ছে। শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিতর্কের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কারণ শিক্ষা ছাড়া মানব সন্তান যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে না। আর আজকের বিশ্বের যারা শিক্ষিত জাতি তারা শুধু মানুষই নয়- উন্নত ও সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে গৌরবজনক স্থান লাভ করেছে। সে জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বরাবরই অনুভূত হয়েছে এবং অনুন্নত দেশগুলো শিক্ষার হার বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আমাদের দেশের অবস্থা : সাক্ষরতার দিক থেকে আমাদের দেশের অবস্থা নিতান্তই শোচনীয়। পরাধীনতার আমলে শিক্ষার সম্প্রসারণে তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থপরতার কারণে শিক্ষার হার বৃদ্ধির দিকে তেমন কোন দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের সগৌরব অভ্যুধয়ের পরও শিক্ষার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা ভাবা হয়েছিল এমন প্রমাণ মিলে না। বলা যেতে পারে অতি সাম্প্রতিককালে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতা দেখা যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। সরকারি হিসাব মতে বর্তমানে দেশের সাক্ষরতার হার শতকরা বায়ান্ন জন। তবে লেখাপড়া জানে, বই পত্রিকা পড়ে বুঝতে পারে এমন লোকের সংখ্যা যে কত কম তা অনুমান করা কঠিন। দেশের সাক্ষর ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে এমন দাবি করা বেশ কঠিন। সেজন্য আমাদের সাক্ষরতার হার যা দাবি করা হচ্ছে তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও কার্যকারিতা সম্পর্কি সন্দেহ আছে।
সাক্ষরতার অভাবে ক্ষতি : সাক্ষরতার হার নৈরাশ্যজনক হওয়ার প্রেক্ষিতে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। দেশ এগিয়ে যায় না, দেশকে এগিয়ে নিতে হয়। আর এই এগিয়ে নেওয়ার শক্তি যোগায় সাক্ষরতা। সাক্ষরতা না থাকায় সকল সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে- মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে নিরক্ষর মানুষের কোন ভূমিকা নেই। নিরক্ষর লোকেরা জানে না, বুঝে না কোন শুক্তি নিয়ে সমস্যার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। লেখাপড়ার অভাবে আধুনিক ধ্যান ধারণা তথ্য সংবাদ অধিকাংশ জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। মানুষ শিক্ষার অভাবে জানে না কীভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সারা বিশ্বের অঘ্রগতির বাণী আমাদের দেশের মানুষের কাছে নীরব হয়ে আছে। শিক্ষার অভাবে অন্যান্য মৌলিক চাহিদা সম্পর্কে নিরক্ষর মানুষ অজ্ঞ হয়ে আছে। আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির চাবিকাঠি তো শিক্ষা যা দেশের অধিকাংশ লোকের হাতে নেই। বিশ্বের মধ্যে এশিয়ার বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিরক্ষর লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের আশে পাশের দেশগুলোতে সাক্ষরতার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এখানে তেমন সচেতনতা এখনও দেখা দেয়নি।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস : প্রতিবছর সারা বিশ্ব জুড়ে আটই সেপ্টেম্বর দিনটি আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়। শিক্ষার হার যেসব দেশে কম সে সব দেশে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কি সচেতন করে তোলার জন্য এই দিবসটি উদ্যাপনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের মাধ্যমে সমগ্র জাতির মধ্যে শিক্ষা সম্পর্কে তৎপরতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়। এতে জনগণের মধ্যে শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা আসে এবং আগামী প্রজন্ম নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়।
সাক্ষরতা কর্মসূচি : বিলম্বে হলেও আমাদের দেশে সাক্ষরতা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। দেশে বয়স্কশিক্ষার সরকারি উদ্যোগ ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছিল। বর্তমানে একই উদ্দেশ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে বছর পাঁচেকের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেই সাথে এমন কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশে নিরক্ষরতা না থাকে। আমাদের দেশে নিরক্ষরতা সমস্যা দূরীকরণের জন্য দ্বিমুখী কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী সব শিশুই বিদ্যালয়ে আসবে। ঝরে পড়া রোধ করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি এবং এ ধরনের আরও উন্নয়নমূলক কাজের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এতে আগামী দিনের সব শিশু যদি বিদ্যালয়ে আসে তাহলে এক সময়ে নিরক্ষর শিশু থাকবে না। দ্বিতীয়ত বয়স্ক শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমানে যেসব বয়স্ক নিরক্ষর আছে তাদের সাক্ষর করে তুললে দেশে নিরক্ষরতার হার একেবারেই কমে যাবে। এনজিওগুলো এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে কাজে নেমেছে।
উপসংহার : সরকারি উদ্যোগে সাক্ষরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বেসরকারি উদ্যোগও তৎপরতা দেখাচ্ছে। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা অসম্ভব হবে না। সেজন্য সবার আন্তরিক সহযোগীতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন।