রচনা : শিশুর অধিকার

ভূমিকা : শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুরা একদিন বড় হয়ে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করবে তখন যাতে সে দায়িত্ব যোগ্যতার সাথে পালন করতে পারে সেজন্য শিশুকাল থেকে তার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সে দায়িত্ব শিশুদের নয় -সে দায়িত্ব হবে শিশুর পিতা-মাতার, অভিভাবকের, আত্মীয়-স্বজনের, পাড়া-প্রতিবেশীর তথা সমগ্র জাতির। জাতি যদি তার সন্তানদের প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে তাহলেই শিশুরা সঠিকভাবে গড়ে উঠবে -আগামী দিনের জন্য সুনাগরিক হতে পারবে।

দায়িত্ব : শিশুদের প্রতি তাদের অভিভাবকেরা যথার্থ সচেতন না থাকার ফলে তারা ঠিকমত গড়ে উঠতে পারে না। বিশেষত দরিদ্র ও অশিক্ষিত সমাজে শিশুর প্রতি কর্তব্য পালনে অধিকাংশ লোকই সচেতন নয়। ফলে শিশুরা অবহেলিত থাকছে। তাদের যথার্থ মানুষ করে তোলা যাচ্ছে না। শিশুদের প্রতি এই অবহেলার ক্ষতিকর দিকটি বিবেচনা করে শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন বিশ্ব সমাজ তৎপর হয়ে উঠেছে। শিশুদের সঠিক পন্থায় গড়ে তোলার জন্য তাদের প্রতি কি ধরনের কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে তা ঘোষিত হয়েছে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সংক্রান্ত সনদে। শিশুর জীবন গঠনের সাথে যারা সম্পৃক্ত সবারই কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি সুনিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের বিপুল সংখ্যক শিশু অবহেলার শিকার। বাংলাদেশের শিশুরা হাজার সমস্যায় জর্জরিত। সকল সমস্যার অবসান ঘটিয়ে শিশুদের কল্যাণ সাধন করতে হবে।

শিশু অধিকার সনদ : সারা বিশ্বের শিশুদের কল্যাণের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক যে শিশু অধিকার সনদ ঘোষিত হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই সনদ বাস্তবায়নের ফলে শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে এবং জাতির জন্য তারা কল্যাণকর বিবেচিত হবে। শিশু অধিকার সনদ নিম্নরূপ :

শিশু অধিকার সনদটি ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয়। ইতিহাসে এটি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত মানব অধিকার চুক্তি; জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৮৭টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। প্রথম যেসব দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এই সনদের ৫৪টি ধারার সকল কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষার বিধান রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও পিতা-মাতার মধ্যকার সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নাগরিক অধিকার, শিশু শোষণ এবং আইনের সাথে বিরোধে জড়িত শিশুসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

শিশুদের অধিকারসমূহ সমুন্নত রাখার দায়িত্ব কেবল সরকারের একার নয়, এ দায়িত্ব শিশুদের কাজে কোন না কোনভাবে জাড়িত প্রত্যেকেরই। এদের মধ্যে রয়েছেন পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, বড় ভাই ও বোন, শিক্ষক ও দাপ্তরিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে শিশুদের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ।

শিশু অধিকার গুচ্ছ : সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ সাধারণত চারটি গুচ্ছে ভাগ করা হয়।

১. বেঁচে থাকার অধিকার : এর মধ্যে রয়েছে জীবন ধারণে সহায়ক মৌলিক বিষয়াদির অধিকার, যেমন- স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টিকর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ।

২. বিকাশের অধিকার : এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার অধিকার, শিশুর গড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত একটি জীবনযাত্রার মান ভোগের অধিকার, অবকাশ যাপন, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার।

৩. সুরক্ষার অধিকার : এই শ্রেণিতে রয়েছে উচ্চ ঝুঁকির পরিস্থিতিতে শিশুদের অধিকারসমূহ : যেমন- উদ্বাস্তু শিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু এবং শোষণ, নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হবার সম্ভাবনা রয়েছে এমন শিশু।

৪. অংশগ্রহণের অধিকার : এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের তাদের কথা শোনার অধিকার, অন্যদের সাথে অবাধে সম্পর্ক গড়ে তোলার অধিকার এবং তথ্য ও ধারণা চাওয়া-পাওয়া ও প্রকাশের অধিকার।

চারটি মূলনীতি : এই সনদে চারটি মূলনীতি রয়েছে, যা এর বিধানগুলো ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বৈষম্যহীনতা : সকল শিশুর লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম, ভাষা, গোত্র, বর্ণ, অক্ষমতা অথবা জন্মের ভিত্তিতে কোনরকম বৈষম্য ছাড়াই সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ ভোগের অধিকার রয়েছে।

শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ : পিতা-মাতা, সংসদ, আদারত এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষমূহ শিশু সম্পর্কিত যে কোন কর্মকাণ্ডে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিশু বা শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থে পরিচালিত হবেন।

শিশুদের অধিকার সমুন্নত রাখাই পিতা-মাতর দায়িত্ব : সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ প্রয়োগে শিশুদের সঠিকভাবে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। শিশুদের বয়স এবং পরিপক্কতা অনুসারে তাকে পরিচারিত করতে হবে। শিশুদের পিতা-মাতা কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার ঐতিহ্য বাংলাদেশে বেশ জোরালো। এই নীতিতে যে ধারণাটি তুলে ধরা হয়েছে, তা হচ্ছে শিশুদের কিছু অধিকার আছে এবং শিশুদের পরিচালনার সময় এসব অধিকার তারা কিভাবে প্রয়োগ করবে তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন : নিজেদের মতামত গঠনের উপযোগী বয়সের শিশুদের তাদের সম্পর্কিত সকল বিষয়ে অবাধে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। শিশুর মতামত কতটা গুরুত্ব পাবে তা নির্ভর করবে শিশুর বয়স ও পরিপক্কতার ওপর। ঘরে ও বিদ্যালয়ে প্রতিদিন যে সব অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তার সকল ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযোজ্য।

মৌলিক অধিকারসমূহ : সনদে শিশুদের ব্যাপক ভিত্তিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে মৌলিক অধিকারগুলো নিচে বর্ণনা করা হল :

জীবন, বেঁচে থাকা ও বিকাশের অধিকার : সকল শিশুরই জীবনের মৌলিক অধিকার আছে এবং যে সকল দেশ সনদটি অনুমোদন করেছে, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুদের বেঁচে থাকা ও তাদের বিকাশ নিশ্চিত করা।

শিক্ষার অধিকার : প্রত্যেক শিশুরই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর পর্যায়ে শিক্ষালাভের অধিকার আছে। শিক্ষা পদ্ধতির ভিত্তি হতে হবে ইতিবাচক ও উন্নত একটি নীতিমালা, যার মধ্যে থাকবে শিক্ষাদানে শিশুকেন্দ্রিক উদ্যোগ এবং একটি মুক্ত সমাজে দায়িত্বশীল জীবন ধারণের জন্য শিশুদের প্রস্তুত করে তোলা।

ভাল স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সেবা অধিকার : শিশুদের যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ মানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সেবা লাভের অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে সনদ অনুমোদনকারী দেশসমূহের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, পরিবার-পরিকল্পণা, শিক্ষা ও সেবা গড়ে তোলা। মায়েদের জন্য প্রসব-পূর্ব ও প্রসবোত্তর সেবার ব্যবস্থা করা, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা গড়ে তোলা, ব্যাপকভিত্তিক স্বাস্থ্য শিক্ষা নিশ্চিত করা, রোগ ও অপুষ্টি মোকাবেলা এবং শিশু মৃত্যু হ্রাস করা। অপুষ্টি ও রোগ মোকাবেলা করতে হলে প্রত্যেক শিশুর স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সুযোগ থাকতে হবে।

জন্ম নিবন্ধিকরণ : শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, জন্মের পরপরই প্রত্যেক শিশুর নিবন্ধিকরণ করতে হবে। বাংলাদেশে জন্ম নিবন্ধিকরণের দায়িত্ব হচ্ছে পল্লী অঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদের এবং শহরে অঞ্চলে পৌরসভার। জন্ম নিবন্ধিকরণের হার অবশ্যই খুব কম। শিশুদের অধিকারসমূহ রক্ষার জন্য জন্ম নিবন্ধিকরণ একান্তই জরুরি। এর প্রধান সুবিধা এই যে, এতে শিশুর বয়স সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়, যা সনদ এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিসমূহের প্রেক্ষিতে শিশুর অবস্থা নির্ণয় সহজ করে তোলে। অন্যান্য নির্দিষ্ট সুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে :
  • শিশুদের জাতীয়তার অধিকার নিশ্চিত করা;
  • অল্প বয়সে বিয়ে রোধ করা, বিশেষ করে মেয়েদের;
  • সঠিক বয়সে সকল শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নিশ্চিত করা;
  • অল্পবয়সী শিশুদের কাজে নিযুক্ত না হওয়া নিশ্চিত করা (বিশেষ করে নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক পরিদর্শকদের শিশুর বয়সের প্রমাণপত্র সরবরাহের মাধ্যমে);
  • কিশোর বিচার ব্যবস্থায় বিশেষ আচরণ নিশ্চিত করা;
  • সঠিক জনমিতিক উপাত্ত তৈরি করা, যা বিভিন্ন পরিকল্পনা কাজে, যেমন -স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যবহার করা যায় এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বয়স কমানো বাড়ানো রোধ করা।
জন্ম নিবন্ধিকরণ পদ্ধতি আরও কার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। নিবন্ধিকরণ সম্পর্কিত বর্তমান রীতি নিরূপণের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি একটি জরিপ চালানো হয়েছে। পিতা-মাতাদের তাদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধিকরণে সমবেত করা এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে জন্ম সার্টিফিকেট সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিপজ্জনক এবং পোষণমূরক শিশু শ্রমের বিলেপ সাধন : শিশুদের অর্থনৈতিক শোষণ এবং ক্ষতিকর কাজ করা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। যে কাজগুলো শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ তার মধ্যে রয়েছে বিপজ্জনক ধরনের কাজ, শিশুদের শিক্ষার বাধা সৃষ্টি করে- এমন ধরনের কাজ অথবা তাদের স্বাস্থ্য বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কোন কাজ। সার্ক-এর সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০০ সাল নাগাদ বিপজ্জনক পেশায় শিশু শ্রমের বিলোপ সাধনের লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশে শিশু শ্রম সম্পর্কিত আইন বিশেষভাবে বিপজ্জনক কাজের ব্যাপারে প্রণীত। উদাহরণস্বরূপ ১৯৬৫ সনের ফ্যাক্টরি আইনে আঠারো বছরের কম বয়সীদের যথাযথ নির্দেশনা, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষণ/তত্ত্বাবধান ছাড়া বিপজ্জনক মেশিনে কাজ করা নিষিদ্ধ এবং ১৯৩৮ সালের শিশু নিয়োগ আইন ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের ওয়ার্কশপে কাজ করা নিষিদ্ধ, যেখানে বিপজ্জনক কাজ হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বয়ন কাজ, চামড়া পাকা করা কাজ এবং বিড়ি, সাবান, কার্পিট, ম্যাচ, বিস্ফোরক অথবা আতশবাজি তৈরির কাজ।

বিপজ্জনক অথবা শোষণমূলক কাজে নিযুক্ত শিশুরা প্রায় অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের শিক্ষা এবং বিশ্রাম অথবা অবকাশের জড়িয়ে পড়া বন্ধ করার অন্যতম কার্যকর উপায় হচ্ছে বিদ্যালয় ব্যবস্থা আরও সম্প্রসারিত ও উন্নত করা, যাতে শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং তাদের মৌলিক শিক্ষা সম্পন্ন করে।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post