ভূমিকা : খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। খাদ্য না পেলে মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই সবার আগে চাই খাদ্য। প্রবাদে বলা হয়, পেটে খেলে পিঠে সয়। পেটে ভাত থাকলেই মাথায় বুদ্ধি আসে, দেহে শক্তি সঞ্চারিত হয়। তখন বাহুতে বল সঞ্চারিত হয়ে জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের রূপায়ণ সম্ভবপর হয়ে থাকে। সেজন্য মানুষ সবার আগে খাবারের চিন্তা করেছে। আহার্য সন্ধানের পথ ধরেই মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। তেমনি ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদে কেঁপে উঠেছে মানব সভ্যতার ভিত। তাই খাদ্য সমস্যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সে সমস্যা মিটিয়ে সবার জন্য খাদ্যের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বের মানুষের উদয়াস্ত শ্রমদানের সমাপ্তি নেই।
খাদ্য লাভে সমস্যা : খাদ্য লাভের উপায় বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সমানভাবে বিন্যস্ত হয়নি। বিশ্বের কোন দেশে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হলেও বিশ্বের বহু দেশে খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং সে ঘাটতি পূরণের জন্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে অন্য দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। তবু সকল দেশের সামর্থ্য ও পরিস্থিতি অনুকূল থাকে না। পরিণতিতে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পড়ে অগণিত মানুষের জীবনাবসান ঘটে। খাদ্য ঘাটতির এ জটিল সমস্যা থেকে বিশ্বে মানুষের জন্য খাদ্য সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। সমস্যার কারণও অনেক। আমাদের দেশে খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য সাম্প্রতিককালে প্রতি বছর কম পক্ষে দশ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। এর জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় এবং তা দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। দেশে প্রাচীন ধরনের চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন স্বল্প পরিমাণে হয়ে থাকে। ভূমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, ভাল বীজ ও প্রয়োজনীয় সারের অভাব, সেচের সুবিধাহীনতা, কীট-পতঙ্গের আক্রমণ এবং তা নিবারণের জন্য উপযুক্ত কীটনাশকের অভাব ইত্যাদি কারণে দেশে খাদ্যের ফলন কম হয়। সেই সঙ্গে আরও কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিদ্যমান থেকে দেশে সবার জন্য খাদ্য সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে দিচ্ছে। শিক্ষার অভাবের জন্য আধুনিক কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে কৃষক পরিচিত হতে পারছে না। দেশের অধিকাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। মূলধনের অভাবে দরিদ্র কৃষক তার জমিতে ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত মূলধন নিয়োগ করতে পারে না। ফলে দেশের জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে না। এর ওপর প্রায় প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশের সকল মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য থাকে না, অনাহারে অর্ধাহারে অধিকাংশ মানুষকে জীবন কাটাতে হচ্ছে। আজকের দিনে সরকারের পক্ষে সবার জন্য খাদ্য সংকুলান একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
দেশে গৃহীত উদ্যোগ : দেশের সকল মানুষের জন্য খদ্য সরবরাহ করা সরকারের প্রধান কর্তব্য। খাদ্যের এ মৌলিক চাহিদা মিটানো সম্ভব না হলে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এ সমস্যা প্রতিদিন প্রকট হয়ে উঠেছে। সেজন্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমস্যা মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সবুজ বিপ্লবের কথা উল্লেখযোগ্য। খাদ্য ঘাটতির মত জটিল সমস্যা দূর করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য যে কর্সূচি গ্রহণ করা হয়েছে তা সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে ইরি ধানের বীজ প্রবর্তনের ফলে এদেশে সবুজ বিপ্লবের শুরু। প্রচলিত চাষ পদ্ধতির পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল ধান, গম ও আলুর বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, উন্নত সেব ব্যবস্থা ও নিবিড় চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে দুই বা ততোধিক ফসল উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে এ সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে। স্বনির্ভর আন্দোলনও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্বনির্ভর আন্দোলনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে সম্পর্কে নানারকম গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাতে কৃষিকাজে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সবার জন্য খাদ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তাতে দেশের মানুষের জন্য ডাল-ভাতের ব্যবস্থার সম্ভাবনা রয়েছে। তাবে দেশে যে হারে মানুষ পড়ছে তার প্রেক্ষিতে উদ্যোগ যত ব্যাপকভাবেই গ্রহণ করা হোক না কেন এ সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ হবে না।
সবার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থার উপায় : বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতির দেশ এই বাংলাদেশ। দারিদ্র্য আর অশিক্ষা এদেশের জনজীবনকে নিষ্পেষিত করছে। এ অবস্থায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তবে সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সবার জন্য খাদ্যের প্রত্যাশা সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক তা এখানে উল্লেখ করা হল:
উন্নত তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে খাদ্যশস্যের ফলন বাড়াতে হবে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে উপযোগী সার ব্যবহার করতে হবে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করে সকল আবাদী জমিকে সেচের আওতায় আনতে হবে। উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে ফসলকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। জমিতে বছরে একাধিক ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করা দরকার। আর উৎপাদিত ফসল মজুতকালে যাতে বিনষ্ট না হয়, সেজন্য ফসল সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করলে চালের ওপর থেকে চাপ কমবে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির যে সুযোগ রয়েছে তা থেকে যথাযথভাবে উপকৃত হওয়ার জন্য দরকার শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা। দেশের সকল লোককে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। তবে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর যত রকম উদ্যোদ নেওয়া হোক না কেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান প্রবল চাপ সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে দিবে, সেজন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা আরও সম্প্রসারণ করা না হলে সবার জন্য খাদ্য সরবরাহ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
উপসংহার : দেশের সকল মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে সরকার বিশেষ তৎপর। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করলে তা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষতিসাধন করবে। অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সরবরাহের কাজেও জোর দিতে হবে। সরকার কিছু পরিমাণ কৃষি ঋণ মওকুফ করে দরিদ্র কৃষকদের দুঃখের ভার কিছু পরিমাণ লাঘব করলেও কৃষকদের আর্থিক সামর্থ্য দৃঢ় করার জন্য কৃষিঋণের অধিকতর সুযোগ দিতে হবে। সবার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার জন্য দেশবাসী সবার নিরলস সাধনা করতে হবে। সকলের সম্মিলিত সহযোগিতার ফলেই এ প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হবে। বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।