বর্তমান যুগ ইন্টারনেট ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। কিছুদিন আগেও শুধু কম্পিউটারে ইন্টারনেট সুবিধা থাকায় এর ব্যবহারকারী ছিল সীমিত। পরে মুঠোফোনে ইন্টারনেট সুবিধা যোগ হওয়ায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। বিআরটিএ’র সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে রয়েছে ৬ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। সংবাদ, তথ্য, যোগাযোগ, কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, বিনোদন ইত্যাদির জন্য মানুষ এখন ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এর উপকারিতার পাশাপাশি আছে অনেক অপকারিতাও। বিশেষ করে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে এতে আসক্তি তৈরি হয়, যা সিগারেট বা মাদকের মতোই মারাত্মক।
ইন্টারনেট আসক্তির কারণ :
কৌতূহল ও উৎসাহ : ইন্টারনেট নতুন ব্যবহারকারীদের অনেকেই ব্যাপক উৎসাহের সাথে প্রায় সব লিংকে ক্লিক করে দেখে সেখানে কী আছে। সাইট থেকে ঘুরে ঘুরে নিত্য নতুন তথ্য-বিনোদনের আবিষ্কারে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়।
তথ্য নিয়ে হিমশিম খাওয়া : ইন্টারনেট এখন সব বয়স ও পেশার লোকের জন্য এক বিশাল তথ্য ভাণ্ডার। পেশার কারণেই হোক বা শখের কারণেই হোক নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহের নেশা একজন মানুষকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে সে বেশিরভাগ সময় ক্রমাগত ওয়েব পেইজ হাতড়িয়ে পার করে দেয়। আর এভাবেই সে নিজের অজান্তেই সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
সাইবার সেক্সুয়াল আসক্তি : ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নির্ধারিত চ্যাটরুম ও সাইবার পর্নো রয়েছে। এসব সাইট একজন মানুষের মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তার চিন্তা-ভাবনায় স্থান করে নেয় এ ধরনের নগ্ন ও বিকৃত রুচির সাইটগুলো। সাধারণত প্রথমদিকে এগুলোর প্রতি কৌতূহল থাকলেও অনেকেরই পরবর্তী সময়ে নেশায় পরিণত হয়।
কম্পিউটার আসক্তি : এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির কম্পিউটার গেমস, কম্পিউটার প্রোগ্রামস, কম্পিউটার সেটিং প্রভৃতির প্রতি আকর্ষণ আর নির্ভরতা এমন পর্যায়ে চলে আসে যে সারাক্ষণ সে ওগুলো নিয়েই সময় কাটাতে পছন্দ করে।
ভার্চুয়াল বন্ধুবান্ধব : ইন্টারনেটের সুবাদে দূর-দূরান্ত, দেশ-বিদেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসা। ব্লগ, ফোরাম, চ্যাটরুম, ফেইসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে একজনের সাথে আরেকজনের পরিচয় হচ্ছে, বন্ধুত্ব হচ্ছে। সে কারণে ই-মেইল, অনলাইন চ্যাটিং, ফেসবুকে বন্ধুত্ব তালিকা দিনদিন বড় হচ্ছে।
বিকল্প বিনোদন : ইন্টারনেটকে অনেকে বিকল্প বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছে। গান, ভিডিও ক্লিপ, মুভি, নাটক, গেমস, টিভি, ভিডিও, লাইভ খেলাধুলা ইত্যাদি এখন ইন্টারনেটে উপভোগ করা যায়।
বাস্তবজীবনে সমস্যা : সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা নিয়ে আমাদের জীবন। সব দুঃখ-কষ্টকে সবাই একইভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে সমস্যা আসতে পারে। অনেকে এসব দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যাকে ভুলে থাকার জন্য ইন্টারনেটকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেয়। এভাবে বাস্তব জীবনের সমস্যাকে ভুলতে গিয়ে আরও একটি সমস্যায় পতিত হয়, যার নাম ‘ইন্টারনেট আসক্তি’।
ভার্চুয়াল জগতে প্রচার ও সেলিব্রেটি : ইন্টারনেটে সহজে নিজেকে প্রচারের জন্য অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
প্রতারণা ও ধোকাবাজি : ইন্টারনেটে যেহেতু নিজের পরিচয় গোপন রেখে অনেক কিছু করা যায়, তাই এটা অনেকের কাছে ফন্দি-ফিকির ও প্রতারণার স্বর্গরাজ্য।
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে প্রতিকার :
১. চিত্ত বিনোদনের জন্য উপায়গুলোর মাঝে নিজেকে জড়ানো।
২. পরিবারের সাথে আরও বেশি সময় দেওয়া।
৩. নিজের প্রকৃত দুঃখ-কষ্ট-সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং তা দূর করার জন্য সচেষ্ট হওয়া।
৪. নিজের সমস্যাগুলো নিজের মাঝে গুটিয়ে না রেখে আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের সাথে আলোচনা করা।
৫. ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে নিজের সহায়ক কাজেই একমাত্র ব্যবহার করা, নির্ভরতা যেন পারিবারিক বা সামাজিক গণ্ডিকে অতিক্রম না করে।
৬. বাস্তবজীবনে বেশি মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা।
৭. প্রিন্ট মিডিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা।
৮. অসামাজিক, লাজুক বা ঘরকুনো স্বভাব থাকলে তা পরিবর্তন করা।
৯. প্রয়োজনে মানসিক বিশেষজ্ঞের দ্বারস্ত হয়ে চিকিৎসা নেয়া।
১০. ধাপে ধাপে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় ও গুরুত্ব কমিয়ে আনা।