নেতারা চমৎকার ধরনের যোগাযোগকারী। যোগাযোগের যোগ্যতা নেতৃত্বের একটি মৌলিক গুণ । সেকারণে নেতা হিসেবে আপনার সফলতার শতকরা ৮৫ ভাগ নির্ধারিত হয় অন্যান্যদের সাথে আপনার কার্যকর যোগাযোগের উপর। সর্বোপরি একজন নেতা হওয়ার মানেই হলো অন্যদের সাথে যোগাযোগ করা- তাদের সফলতাই আপনার সফলতা। আপনি যদি যোগাযোগ করতে না পারেন, আপনি নেতা হতে পারবেন না ।
যোগাযোগ একটি দক্ষতা যেটি শিখতে হয়। প্রথম ধাপ হলো পাঁচটি লক্ষ্যকে বোঝা, যেগুলো আপনি যোগাযোগ দক্ষতার মাধ্যমে অর্জন করতে চান।
১. আপনি চান লোকেরা আপনাকে পছন্দ ও সম্মান করুক. নেতৃত্ব বন্ধু তৈরি করার নাম নয় কিন্তু আপনি যদি অন্যদের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় ও সম্মানিত হন, লোকজন আপনার কথা শোনার জন্য অধিক আগ্রহী হবে।
২. আপনি চান লোকেরা আপনার কদর ও গুরুত্ব স্বীকার করুক। আপনাকে তাদের সামনে কারণ উপস্থাপন করতে হবে, যে কারণে তারা আপনার কথা শুনবে।
৩. আপনি অন্যদের আপনার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি প্রভাবিত করার যোগ্যতা চান, আজকের দিনে নেতৃত্ব হলো আদেশ না করে প্রভাবিতকরণ। আপনার মধ্যে অন্যদের প্রভাবিত করার যোগ্যতা থাকতে হবে।তাদেরকে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের সাথে সহমত পোষণ করানোর ব্যাপারে প্রভাবিত করতে হবে।
৪. আপনি চান লোকেরা তাদের মনমানসিকতা পরিবর্তন করুক ও আপনার কাজে সহযোগিতা করুক, আপনি সফল নেতা হতে পারবেন না যদি আপনার লোকেরা আপনার বিরুদ্ধে থাকে বা তারা তাদের পূর্বের অবস্থান বা মতামত পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানায়। নেতারা প্রায়ই প্রতিনিধি পরিবর্তন করেন এবং পরিবর্তনের চাবি হলো কার্যকর যোগাযোগ।
৫. আপনাকে আপনার সম্পর্কগুলোতে সামগ্রিকভাবে অধিক প্রভাবশালী হতে হবে। নেতৃত্ব হলো ক্ষমতা ও প্রভাব সম্পর্কিত বিষয় এবং যথাযথ যোগাযোগের মাধ্যমে সেরা অর্জিত বিষয় হলো ক্ষমতা ও প্রভাব ।
স্পষ্টবাদী হউন
নেতারা স্পষ্টভাবে তাদের মতামত, কলা-কৌশল ও দর্শন প্রকাশ করেন। আপনি যেখানে দেখবেন কোনো প্রতিষ্ঠান ধুঁকে ধুঁকে চলছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই প্রতিষ্ঠান তৈরির পেছনে অস্পষ্ট বোঝাপড়া রয়েছে। একটি সফল প্রতিষ্ঠানে সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা পরিষ্কার, স্পষ্টভাবে জানেন যে তারা কোন কাজ সম্পাদনের জন্য চেষ্টা করছেন, তাদের গন্তব্য কোথায় এবং তাদের ভবিষ্যত কী। তারা স্পষ্টভাবে নিজেদের কর্মক্ষমতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানেন ।
আপনি যদি একজন বিখ্যাত নেতা হতে চান, তাহলে কীভাবে নিজের মতামত, ধারণা এবং লক্ষ্যসমূহ অন্য লোকদের কাছে পৌঁছাবেন তা শিখুন এবং নিশ্চিত করুন যে যেসব লোক আপনাকে সাহায্য করতে চায়, তারা জানে তারা কী ভূমিকা পালন করবে।
প্রত্যাশা নির্ধারণ করুন
আজকের দিনে কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের প্রথম অভিযোগ হলো কর্মচারীদের চাহিদা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের কিছু না জানা। বিষয়টি বিস্ময়কর যে প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত বহুসংখ্যক কর্মচারীদের নিকট থেকে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা পালনের আশা করা হয় কিন্তু তাদের কী করা উচিত সে ব্যাপারে তারা অনিশ্চিত থাকে। যেসকল লোক পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে না যে তাদের কী করতে হবে তারা নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন ও কঠোর হয়ে যায়, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, নিরুৎসাহিত হয়ে ওঠে ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের সর্বোচ্চ ভূমিকা পালনে অসমর্থ হয়ে যায়।
(কী) শব্দের সঙ্গে নেতারা (কেন) শব্দটিরও সংযোগ স্থাপন করেন। অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের সাথে নেতারা লোকদের কাজের ব্যাপারে নিশ্চিত করেন যে তারা কী করছে এবং কেন করছে। বর্তমানে কাজের জন্য নিযুক্ত কর্মীদলে সবাই জানে যে আমরা কেন একটি কাজ করছি। আমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে আমরা শুধু জানবো কাজটি আমাদের করতে হবে; সেই সাথে আমরা কাজ করার কারণও জানতে চাই। আমরা জানতে চাই কাজটি কীভাবে আমাদের প্রভাবিত করবে। আমরা জানতে চাই কীভাবে কাজটি আমাদের গ্রাহক এবং অন্যান্য লোকদের প্রভাবিত করবে। নিজছে (Nietzche) লিখেছিলেন, “একজন মানুষ যেকোনো কাজ (কী) বহন করতে পারে যদি তার কাছে বড় কোনো কারণ (কেন) থাকে।”
বেশ কয়েক বছর আমি লক্ষ্য করে দেখেছি কারো কাছে কোন কারণ দর্শানো ছাড়া আমার জন্য কাজ করতে বলেছি। এবং আমি লক্ষ্য করেছি আপনি লোকদের তাদের কাজের ব্যাপারে যত কারণ দর্শাবেন, তারা তত নিজেদের কাজে অনুপ্রাণিত, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সৎ, নিবেদিতপ্রাণ এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত হবে। তারা যত কাজের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কম জানবে, তারা তত কাজের প্রতি উদাসীন থাকবে।
আপনি শুধু কাজের কারণ দর্শানোর মধ্যে দিয়ে অন্যদের মাঝে কর্মক্ষমতা ছড়িয়ে দিতে পারেন। এমনকি সেটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ না হলেও হবে, শুধু তাদের সামনে কাজ করার জন্য একটি কারণ দরকার।
সর্বদা দৃশ্যমান থাকুন
অন্যদের সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করা। আপনি যদি বিখ্যাত জেনারেল ও অন্যান্য নেতাদের দিকে দৃষ্টি দেন, আপনি দেখবেন যে তারা সবসময়ই নিজ কর্মক্ষেত্রে সরব থাকতেন। খুব কম সময়ই তারা নিজেদের ডেস্কের আড়ালে রাখতেন। ফলস্বরূপ আপনি যতই পরিচালনা পর্ষদের উপরের দিকে যাবেন, প্রত্যেক স্বতন্ত্র নেতাকে নিজ ক্ষেত্রে অধিক সময় লোকদের সাথে কথা বলতে দেখবেন।
যাহোক, একজন্য ব্যবস্থাপকের কাজ হলো তার নিজের রুম থেকে বের হওয়া, চারিদিকে ঘুরেফিরে দেখা এবং লোকদের সাথে তাদের কাজ নিয়ে কথা বলা। নিজেকে দৃশ্যমান এবং সহজলভ্য বানান যাতে করে লোকজন আপনার কাছে আসতে পারে এবং তাদের সমস্যা ও তাদের বিভাগে কী ঘটছে সেসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে। আপনি আপনার কর্মচারী ও গ্রাহকদের থেকে তাৎক্ষণিক ও সময়মত অধিক তথ্য পাবেন যা আপনি পূর্বে নিজ রুমে থেকে ঘন্টা, দিন এমনকি সপ্তাহ অতিবাহিত করে পেতেন। সবচেয়ে ভালো নেতারা অফিস রুমের বাইরে ঘুরাঘুরিতে লিপ্ত থেকে অফিস সময়ের প্রায় পঞ্চাশ ভাগ নিজেদের দৃশ্যমান, সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করে রাখেন। দৃশ্যমান হওয়া গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ এবং তাদের কাছ থেকে শেখার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নেতাদের নিজ নিজ সময়ের মধ্যে থেকে কমপক্ষে শতকরা ২৫ ভাগ তাদের গ্রাহকদের সাথে কাটানো উচিত- ডেস্কের পাশে বসে থেকে বা গ্রাহক সংখ্যা এবং পরিসংখ্যানের দিকে না তাকিয়ে থেকে বরং কর্মক্ষেত্রে বের হয়ে গ্রাহকদের যত্ন নেওয়া উচিত।
কিছুদিন পূর্বেও ভিসিআর বেশ জনপ্রিয় ছিল। একবার একজন ভদ্রলোকের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর দোকানে ভিসিআর কিনতে গেলেন। একজন জাপানি বৃদ্ধ লোক কাউন্টারে সেবা দিচ্ছিলেন। তাঁর ইংলিশ ছিল বেশ নিম্নমানের। যখন ক্রেতাটি তার ক্রয়কৃত পণ্য নিয়ে দোকান ত্যাগ করছিলো, তার এক বন্ধু লোকটিকে একপাশে টেনে নিয়ে বললো, “তুমি কি জানো কাউন্টারে বসে থাকা লোকটি কে?” লোকটি উত্তর দিলো, “না।” তার বন্ধু জানালো, “তিনি হলেন সনি কর্পোরেশনের প্রধান আকিও মোরিতা (Akio Morita)।” মোরিতা সেসময় যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তাদের বিভিন্ন স্টোরগুলো পরিদর্শন করছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে গ্রাহকদের কাছ থেকে মতামত পাওয়ার জন্য নিজেই পণ্য বিক্রি করছিলেন।
সর্বদা বিক্রয়বান্ধব হউন
যোগাযোগ সম্পর্কিত শেষ বিষয়টি হলো, লিডার হলো ঠান্ডা মাথার উৎকৃষ্ট বিক্রয় প্রতিনিধি। লিডাররা সবসময় মার্কেটিং করেন। তারা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, নিজ দর্শনের প্রচারে, লক্ষ্য অর্জনে এবং যৌক্তিক কারণ প্রচার করেন করেন। তারা লম্বা সময়ের কাজে, কঠিন সময়ে, অধিক মূল্যবান ভূমিকা পালনে, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন পরিষদে এবং বৃহত্তর দায়িত্ব গ্রহণে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন করেন। সকল Great Leader-রা মার্কেটিং করতে পারেন। বিক্রয়ের কাজে যোগ্য হওয়ার সাথে সাথে নেতারা দর কষাকষি এবং ব্যবসায়িক আপোষ করেন। তাদের সন্তোষজনক সমাধান খুঁজে বের করার সামর্থ্য আছে। এটি নেতৃত্বের মৌলিক অংশ যা বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন চাহিদার এবং বিভিন্ন আচরণের লোকজনকে গ্রহণ করতে এবং বিভিন্ন ধরনের মতামতগুলোকে সম্বন্বয় করতে কাজে লাগে, যাতে করে তারা প্রত্যেকের সহযোগিতার সাথে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে পারেন ।