একাক্তরের পর আরও এক গণজোয়ার দেখল বাংলাদেশ। এ জোয়ারের মূল উদ্দেশ্য স্বাদীন দেশটির সংস্কার। দেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের রাষ্ট্র মেরামতের আগ্রহ ও দেশপ্রেমের আকুতি চোখে পড়ার মতো। এদেশের ছাত্ররা অন্যায়ের প্রশ্নে যেমন আপসহীন, দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলা রক্ষায়ও তেমনি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের অনেক প্রাপ্তির ভেতর একটা বড় অপ্রাপ্তি হচ্ছে সুশাসন।
সুশাসন
সুশাসন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Good Governance গ্রিক শব্দ kubernan থেকে ইংরেজি Governance শব্দের উৎপত্তি। দার্শনিক প্লেটো Kubernao শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। সু অর্থ হলো ভালো, উত্তম, উৎকৃষ্ট, সুন্দর, মধুর, শুভ ইত্যাদি। অতএব সুশাসন হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র শাসন। সুশাসন ধারণাটির উদ্ভাবন করে বিশ্বব্যাংক। সুশাসন হলো এক ধরনের শাসন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ক্ষমতার সুষ্ঠু চর্চা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়। এ শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণ স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত থাকে এবং নারী-পুরুষ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে। বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির মতে সুশাসনের সংজ্ঞা-
সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন। ---বিশ্বব্যাংক
সুশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, মৌলিক স্বাধীনতার উন্নয়ন। ---জতিসংঘ
সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সুশীল সমাজের, সরকারের সঙ্গে শাসিত জনগণের, শাসকের সঙ্গে শাসিতের সম্পর্ক বোঝায়। ---ম্যাককরণী
সুশাসনের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান
সুশাসন বা Good Governance একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে শাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসনের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করে। সুশাসনের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা। সুশাসন একটি আধুনিক ধারণা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠী সুশাসনের ব্যাখ্যায় এর ভিন্ন ভিন্ন উপাদান উল্লেখ করেছে-
জাতিসংঘ সুশাসনের ৮টি মূল উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-
১. অংশগ্রহণ,
২. আইনের শাসন,
৩. স্বচ্ছতা,
৪. সহানুভূতিশীলতা,
৫. ঐকমত্যভিত্তিক,
৬. ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিকরণ,
৭. কার্যকারিতা ও দক্ষতা এবং
৮. জবাবদিহিতা।
UNDP (United Nation Development Programe) সুশাসন নিশ্চিত করতে ৯টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-
১. অংশগ্রহণ,
২. আইনের শাসন,
৩. স্বচ্ছতা, ৪. সহানুভূতিশীলতা,
৫. ঐক্যমত্য অভিযোজন,
৬. ন্যায়পরায়ণতা,
৭. কার্যকারিতা ও দক্ষতা,
৮. জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা এবং
৯. কৌশলগত দৃষ্টি।
বিশ্বব্যাংক সুশাসনের ৪টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে। যথা-
১. সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থাপনা,
২. দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা,
৩. উন্নয়নের বৈধ কাঠামো এবং
৪. স্বচ্ছতা এবং তথ্যপ্রবাহ।
সুশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
সুশাসনের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো দুর্নীতি হ্রাস করা, সংখ্যালঘুদের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা এবং জনগণের প্রয়োজনে সক্রিয়ভাবে সাড়া দেওয়া। প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশের আইনশৃঙ্খলাকে সমুন্নত করা। প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে এর যথাযথ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। জাতিসংঘের অভিমত অনুসারে সুশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ‘মৌলিক স্বাধীনতার উন্নয়ন’।
সুশাসনের গুরুত্ব
একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসন প্রয়োজন। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক সক্ষমতা দৃঢ় করা, রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে দৃশ্যমান করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জরুরি। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সুশাসন অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। সুশাসন সরকার ও নাগরিকের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। সুশাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি স্থাপন করে। সুশাসনের গুরুত্বকে নিম্নোক্ত উপায়ে তুলে ধরা হলো-
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : সুশাসন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে যোগসূত্র অনস্বীকার্য। যে দেশগুলো শাসনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে তারাই উচ্চতর অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসন কাঠামো বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করে, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ করে এবং ব্যবসায়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এসবই অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে চালিত করে।
মানব উন্নয়ন : সুশাসন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই নয়, মানব উন্নয়নকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো খাতগুলোতে উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করে।
ন্যায়ভিত্তিক সমাজ : সামাজিক বিভাগগুলিতে সুযোগ-সুবিধা এবং পরিষেবা সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে সুশাসন সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এটি দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং পক্ষপাতের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামাজিক বন্ধনকে আরও শক্ত করে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
স্থিতিশীল রাজনীতি : সুশাসনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি রাজনৈতিক দৃশ্যপটে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। এই স্থিতিশীলতা শুধু বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্যই নয়, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রায়শই অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন থেকে উদ্ভূত হয়, যেখানে জনগণ অংশগ্রহণ করে এবং তাদের সমস্যাগুলি কার্যকরভাবে সমাধান করা হয়।
সুশাসন প্রযুক্তির ভূমিকা : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সরকার তাদের প্রশাসনিক কাজগুলো আরও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারছে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রযুক্তি যেমন ইন্টারনেট অব থিংস (IoT), ব্লকচেইন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) সুশাসনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, যা দ্রুত ও কার্যকর নীতি গ্রহণে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা
সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর না হলে সুশাসনের লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন। অসংখ্য বাধা-বিপত্তিতে মোড়ানো সুশাসন অর্জনে প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো- দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল আইনের শাসন, পুরনো জটিল এবং অপ্রাসঙ্গিক আইন, দুর্বল আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, দারিদ্র্য ও অসমতা, দুর্বল নাগরিক সমাজ, অদক্ষ প্রশাসন। উক্ত বিষয়গুলোর জন্য সুশাসন সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
রাষ্ট্র পরিচালনায় সুশাসন
বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এর জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ এবং সকল স্তরের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি। দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। দেশের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বিচার বিভাগকে করতে হবে অবাধ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে আমাদের বাংলাদেশ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তারুণ্যের ভূমিকা
সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার তারুণ্যের শক্তি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধপূর্ণ। সরকারি আমলা, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনী, সরকারপন্থি ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষমতার অবৈধ ভোগদখল ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সমাজের রন্ধ্রে লন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া এ দুর্নীতির বিষবাষ্প রুখে দিতে তারুণ্যের বিকল্প নেই। তারুণ্যের এ অপ্রতিরোধ্য শক্তিই আগামীর বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত সুশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। এ ক্ষেত্রে, সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অনতিবিলম্বে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
আগামীর বাংলাদেশে সুশাসন
স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও দেশে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের চর্চা রোধ করা যায়নি। বাংলাদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এখনো অপেক্ষমাণ। এ অপেক্ষার পেছনে প্রশাসনিক অদক্ষতা, উদ্যমহীনতা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত ও উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে আগামীর বাংলাদেশে চাই মজবুত প্রশাসনিক কাঠামো, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। তারুণ্যের চিন্তাভাবনাই তৈরি করতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। সুশাসন, মানসম্মান শিক্ষা, ন্যায়বিচার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রত্যাশা। তরুণদের চোখ আগমীর বাংলাদেশ হলো একটি প্রগতিশীল দেশ, যেখানে শিক্ষা, প্রযুক্ত ও নৈতিক সমানভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং নাগরিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি। সুশাসনের মূলমন্ত্র হচ্ছে জনগণের সেবা, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি। তাই, আমাদের উচিত প্রতিটি স্তরে সুশাসনের অনুশীলন করা এবং প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে সুশাসনের লক্ষ্য অর্জন করা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সফলতা পেতে হলে, সরকার, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। একসাথে কাজ করলে আমরা একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।