↬ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
ভূমিকা : বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ বাংলা ভাষাতেই গড়ে উঠেছে হাজার বছরেরও পুরনো বাংলা সাহিত্য। হাজার বছরে বাংলা সাহিত্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিয়েছে। ফলে এ সাহিত্যে এসেছে বৈচিত্র। আরও অনেক শতক টিকে থাকবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। হয়তো তখন আরও নতুন কোনো সাহিত্য ধারা সৃষ্টি হবে।
সাহিত্য কী? : সাহিত্য সম্পর্কে শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেছেন, “সাহিত্যিক যখন আত্মপ্রকাশ করেন, তখন তিনি হয়তো নিজের অন্তর পুরুষকে প্রকাশ করেন বা বাহ্যজগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দকে আত্মগত অনুভূতি বসে স্নিগ্ধ করিয়া প্রকাশ করেন, অথবা তাহার ব্যক্তি অনুভূতি নিরপেক্ষ বিশ্বজগতের বস্তু সত্তাকে প্রকাশ করেন। নিজের কথা, পরের কথা বা বাহ্যজগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীপায় যে সুর ঝংকৃত হয়, তাহার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “বিচিত্র ফুলে ফলে, পল্লবে, শাখায়, কাণ্ডে, ভাবের এবং রূপের সমবায় সমগ্রতায় সে আপনার অস্তিত্বের চরণ গৌরব ঘোষণা করতে থাকে স্থায়ী কালের বৃহৎ ক্ষেত্রে। একেই আমরা বলে থাকি সাহিত্য।”
বাংলা সাহিত্য ও যুগবিভাগ :
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের সূচনা থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক- এই তিন যুগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন যুগ ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, মধ্যযুগ ১২০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্যন্ত এবং আধুনিক যুগ ১৮০১ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত। আবার কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন ১২০০ থেকে ১৩৫০ এ সময় হলো অন্ধকার যুগ।
নিচে যুগ বিভাগ অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ক. প্রাচীন যুগ : বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো চর্যাপদ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে ১৯০৭ সালে এটি আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে তা প্রকাশিত হয়। এটি বৌদ্ধ সহজিয়াগণের রচনা। চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪। পদসংখ্যা ৫০টি, কারও মতে ৫১টি। চর্যাপদ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নয়, রচিত হয়েছিল ধর্মচর্চার জন্য, গান হিসেবে। তবু এখানে ধর্মচর্চার জন্য চিত্রকল্পের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। চর্যাপদ বাঙালি সমাজের বিশ্বস্ত দলিল। এতে সে সময়ের জীবনযাত্রা, সমাজের নিচু স্তরের মানুষের কথা প্রতিফলিত হয়েছে। ২৮নং চর্যায় বলা হয়েছে-
“উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।।”
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহান সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।”
অর্থাৎ উঁচু উঁচু পর্বত সেখানে বাস করে শবরী বালিকা। ময়ূরের পুচ্ছ পরিধান করে শবরী, গলায় গুঞ্জার মালা।
চর্যাপদে কাপালিক, ব্রাহ্মণ, যোগী, ডোম্বী ইত্যাদি নানা বর্ণের এবং মাঝি, শিকারি, নেয়ে প্রভৃতি পেশার মানুষের উল্লেখ আছে। চর্যাপদের যুগে নারীরা খুব স্বাধীন ছিল। চর্যাপদের উল্লেখযোগ্য পদকর্তা হলেন কাহ্নপা, লুইপ, ভুসুকু পা, শবর পা, প্রমুখ।
খ. মধ্যযুগ : ১২০০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত মধ্যযুগ। মধ্যযুগের সাহিত্যে ধর্মকেন্দ্রিকতাই মুখ্য, মানবতাসহ সবকিছুই গৌণ। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের প্রথম কাব্য হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন স্বীকৃত। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাকিলা গ্রামের দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়ালঘরে এটি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় এটি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কবির ভণিতায় চণ্ডীদাস এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড়ু চন্ডীদাস, পাওয়া যাওয়ার এই গ্রন্থের কবি হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাসকে গ্রহণ করা হয়। এটি মোট ১৩টি কাণ্ডে বিভক্ত।
বাংলা ভাষায় শ্রী চৈতন্যদেবের প্রথম জীবনীগ্রন্থ বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্য ভাগবত মধ্যযুগের সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন। এটি তিন খণ্ডে রচিত। শ্রীচৈতন্যের বাল্যকাল থেকে গয়াধাম প্রত্যাগমন পর্যন্ত এতে মোট পনেরটি অধ্যায় রয়েছে।
বাংলা ভাষায় অদ্বিতীয় ও সর্বাপেক্ষা তথ্যবহুল চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ বলো কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য-চরিতামৃত (১৬১৫)। মধ্যযুগের সাহিত্যের আরেকটি ধারা হলো মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যের প্রধান তিনটি হলো মনসামঙগল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল।
সাপের দেবী মনসার স্তব, স্তুতি, কাহিনি ইত্যাদি নিয়ে রচিত কাব্য ‘মনসামঙ্গল’। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের প্রধান চরিত্র চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, লখিন্দর। এই কাব্যের কাহিনি চৈতন্যপূর্ব যুগ থেকে নদনদী পরিবেষ্টিত গ্রামবাংলার সর্পভয়ে ভীত সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কানা হরিদত্ত। এছাড়াও বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকা দাস, ক্ষেমানন্দ প্রমুখ মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য চণ্ডী নামক লৌকিক-পৌরাণিক দেবীর পূজা প্রচারের কাহিনি অবলম্বনে রচিত।
অন্নদামঙ্গল কাব্যধারার প্রধান কবি ভারতচন্দ্র রায়। অন্নদামঙ্গল, শিবনারায়ণ, বালিকামঙ্গল, মানসিংহ-ভবানন্দ খণ্ড কাব্য। এই তিন খণ্ডে বিভক্ত অন্নদামঙ্গলের উল্লেখযোগ্য চরিত্র- মানসিংহ, ভবানন্দ, বিদ্যাসুন্দর, মালিনী ইত্যাদি। মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- রামায়ণ ও মহাভারত। মহাভারত প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর। কাব্যটি ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত।
মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কালীরাম দাস। তিনি গ্রন্থ রচনা শেষ করে যেতে পারেননি। মহাভারতের আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্ব রচনার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁর পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র ও শিষ্য স্থানীয় অনেকে এটি সমাপ্ত করেন। চৈতন্য পূর্ববর্তী অন্য তিনজন মহাভারত অনুবাদক হলেন শ্রীকর নন্দী, বিজয় পণ্ডিত, সঞ্জয়।
সংস্কৃত কবি বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেন। রামায়ণের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস ওঝা। এই যুগে শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’; দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী-মজনু’, মুহম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেন।
মধ্যযুগেই মর্সিয়া সাহিত্য ‘জয়নালের চৌতিশা’ (১৫৭০), নাথ সাহিত্য প্রভৃতি বিকাশ লাভ করে।
গ. আধুনিক যুগ : ১৮০০ সাল থেকে শুরু হয়েছে আধুনিক সাহিত্যের যুগ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই সাহিত্যের উদ্ভব নগরকেন্দ্রিক, ইংরেজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ও বিকাশের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বাংলা সাহিত্যে মূলগত যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা হলো-
১. গদ্য সাহিত্যের উদ্ভব,
২. সাময়িকপত্রের আবির্ভাব,
৩. নাট্যসাহিত্যের জন্ম ও
৪. প্রবন্ধ সাহিত্যের সৃষ্টি।
নিম্নে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. বাংলা প্রবন্ধ : ঊনিশ শতকের প্রথম থেকেই বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের সূত্রপাত হলেও দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই এর যথার্থ বিকাশ ঘটেছে। প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রবর্তন করেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩)। তিনি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ‘বেদান্তগ্রন্থ’, ‘বেদান্তসার’, ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’, ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’, ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ প্রভৃতি গ্রন্থে চিন্তার বলিষ্ঠতা ও নৈয়ায়িক সুস্পষ্টতা বিদ্যমান। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) প্রবন্ধগ্রন্থগুলো মৌলিক প্রতিভার সার্থক নিদর্শন হিসেবে গ্রহণযোগ্য। সমসাময়িককালে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), কাজী আবদুল ওদুদ, মোহিতলাল মজুমদার, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ বাংলা প্রবন্ধ ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
২. বাংলা উপন্যাস : বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮)। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫)। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজসিংহ’, ‘আনন্দমঠ’ প্রভৃতি।
বাংলা উপন্যাসের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গোরা’ তাঁর মধ্যবর্তী যুগের উপন্যাস। রবীন্দ্র জীবনের শেষ পর্যায়ের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’, ‘মালঞ্চ’, ’দুই বোন’ প্রভৃতি প্রধানত গীতিধর্মী উপন্যাস।
পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। বাঙালি জীবনের উপেক্ষিত দিকগুলো তাঁর উপন্যাসে চিত্রিত করে অপরাজেয় কথাসাহিত্যিকের মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো ‘পল্লীসমাজ’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘দেবদাস’, ‘চরিত্রহীন’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’ ইত্যাদি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণের সূত্র অনুসরণ করে উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘জননী’, ‘শহরতলী’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রভৃতি।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) ‘পথের পাঁচারী’ ও ‘অপরাজিত’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে স্বকীয়তার পরিচয় বহন করে।
বাংলা উপন্যাস ধারায় মুসলমান ঔপন্যাসিকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২) ‘বিষাদসিন্দু’, শওকত ওসমানের ‘জননী’, ‘বনি আদম’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’; দৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’; আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’; শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’; শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’; জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’; হুমায়ুন আহমেদের ‘জোসনা ও জননীর গল্প’; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোটার সিপাই’, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৩. বাংলা ছোটগল্প : বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে তা সার্থকতা লাভ করেছে। তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’ ভারতী পত্রিকায় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’-এ মোট ছোটগল্পের সংখ্যা আশিটি। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ ছোটগল্পকার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
এদেশের ছোটগল্পে একদিকে যেমন গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে তেমনি অন্যদিকে শহরকেন্দ্রিক জীবনের চিত্রও ফুটে উঠেছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে ছোটগল্পকার হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, শাহেদ আলী, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন।
৪. বাংলা কবিতা : বাংলা আধুনিক কবিতার সূত্রপাতের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-১৮৮৬) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা কাব্যসহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক মহাকাব্য। তিনিই বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ও সনেটের প্রবর্তক, ‘বীরাঙ্গনা’, ’ব্রজাঙ্গনা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
বাংলা সাহিত্যে গীকবিতার ধারাটি প্রবর্তন করেন বিহারীলাল চক্রবর্তী এবং পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে তা সমৃদ্ধি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য রচনা মাধ্যমে বাংলা কাব্যসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ‘বলাকা’, ‘পুনশ্চ’, ’গীতাঞ্জলি’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘সোনার তরী’, ’মানসী’, ’চিত্রা’, ‘চৈতালী’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
রবীন্দ্রযুগে বেশ কজন কবি স্বকীয়তা নিয়ে কাব্য রচনা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। জীবনানন্দ এবং কালসচেতন কবি। তাঁদের কাব্যে জীবনের দুঃখ, পঙ্কিলতা, প্রেম বিদ্রোহ, সাম্যবাদ প্রভৃতি বিষয় স্থান পেয়েছে।
পল্লির মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে কাব্য চয়না করে খ্যাতি অর্জন করেন জসীমউদ্দীন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘বালুচর’, ’ধানক্ষেত’, ’রাখালী’ প্রভৃতি।
ফররুখ আহমদ ইসলামি ভাবধারা ও ঐতিহ্যসচেতন কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
সুফিয়া কামাল মহিলা কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এছাড়া আবদুল কাদির, আ.ন.ম. বজলুল রশীদ, আহসান হাবীব, শামসুর রহমান, সানাউল হক, আশরাফ সিদ্দিকী, আহমদ রফিক, আলাউদ্দিন আল আদাজ, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
৫. বাংলা নাটক : বাংলা মৌলিক নাটক রচনার সূত্রপাত হয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়। বাংলা নাটকের ইতিহাসে অস্থিরচিত্ততা কাটিয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক সৃষ্টি করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-৮৬)। সামাজিক নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পুরাণকাহিনি অবলম্বন করে ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বনে ‘কৃষ্ণকুমারী’, সামাজিক বিষয় অবলম্বনে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। নাটক ও প্রহসন রচনা করেন।
দীনবন্ধু মিত্রের ( ১৮২১-১৮৭৩) ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) এদেশে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার চিত্রিত হয়েছে।
মীর মশাররফ হোসেন ‘জমীদার দর্পণ’, ‘বসন্তকুমারী’ প্রভৃতি রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন।
বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, সাংকেতিক নাটক, সামাজিক নাটক, নৃত্যনাট্য ইত্যাদি ধারায় তিনি ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘বিসর্জন’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘রাজা’, ‘তাদের ঘর’ প্রভৃতি নাটক রচনা করেন।
রবীন্দ্রোত্তর নাট্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- জলধর চট্টোপাধ্যায়, মন্মথ রায়, কাজী নজরুল ইসলাম।
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ, আবুল ফজল, ইব্রাহীম খাঁ, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আনিস চৌধুরী প্রমুখ। স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলাদেশে আবদুল্লাহ্ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদ্দীন আহমদ, সেলিম আল-দ্বীন, রশীদ হায়দার প্রমুখ নাট্যকার নাটক রচনা করে বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
উপসংহার : বাংলাসাহিত্যে আছে লোকসাহিত্য, আছে শিশুসাহিত্যের মতো সমৃদ্ধ ধারা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাংলাসাহিত্যে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা। এই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য। সেগুলোতে আমাদের হাজার বছরের পুরনো বাংলাসাহিত্যকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করে, সাহিত্য ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা, চেতনা, যোগ হচ্ছে। ফলে নতুনকে গ্রহণ করে, নতুন-পুরাতনের সংমিশ্রণে আমাদের সাহিত্যাকাশ হয়ে উঠেছে আরও বৈচিত্র্যময়।