↬ নারী স্বাধীনতা ও পণপ্রথা
↬ পণপ্রথার অভিশাপ
ভূমিকা :
‘যাব না বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিনী’ -রবীন্দ্রনাথ।
কেন নারীর বধূজীবনের প্রতি এই অনাসক্তি? কেন তার হৃদয়মথিত এই অভিমান? কেনই বা নারীজীবনের চিরন্তন স্বপ্ন ও সার্থকতা বধূজীবন এমন ধিক্কার ধ্বনিতে মন্ত্রিত হয়? কেন তার স্বপ্ন-সাধ সমাজের নিষ্করুণ নির্যাতনে অকালে বিলীন হয়ে যায়? কেন নারী তার আপন সগৌরব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়? যে নারী গৃহের সৌন্দর্য ও শান্তির চির উৎস, কেন সেই নারীর জীবনে নেমে আসে অকাল মৃত্যুর অভিশাপ? কেন নারী পরিণত হয় বিকিকিনির সহজ পণ্যে? নির্মম, নিষ্ঠুর কোন সামাজিক প্রথা যুগে যুগে নারীজীবনকে অশ্রুময়ী করেছে? পণপ্রথাই হল হৃদয়হীন সমাজের সেই নির্লজ্জ নারীপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার। এই নির্মম প্রথার পাষাণ ফলকে লেখা আছে কত নারীর অশ্রুত করুণ কাহিনী, কত বেদনার নিষ্ঠুর ইতিহাস, কত দীর্ঘশ্বাস আর অশ্রুপাত। এরই নির্দয় অত্যাচারে কত জীবন মৃত্যুর মধ্যে পেয়েছে চিরশান্তি। কত নারীর সুখের সংসার হয়েছে ছারখার। বর্তমানের বিজ্ঞান-উজ্জ্বল দিনে সর্বপ্রকার মানবতা-বিরোধী বন্ধন মুক্তির আলোকিত বিশাল প্রান্তরে আজও কত নিরুপমাদের চিতা জ্বলছে। এখনও কত স্নেহলতারা আত্মাহুতি দেয় সেই আগুনে।
পণপ্রথার ইতিহাস : মনুষ্য-জীবনে বিবাহ একটি সামাজিক বিধান। ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়নে বৃহত্তর সমাজের কল্যাণ-সাধনই এর মূল উদ্দেশ্য। আর পণপ্রথা হল হৃদয়হীন সমাজের নির্লজ্জ নারীপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার। নারীর এই অধিকার হরণের চিত্র সর্বযুগের নয়। এই ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় আছে ঋকবেদে কক্ষীবানের কন্যা-সম্প্রদানের ঘটনায়, মহাভারতে সুভ্রুত উপাখ্যানে। আমাদের বঙ্গভূমিতে রাজা বল্লাল সেনের আমল থেকে কৌলিন্য প্রথার ফলে কুলীন পাত্রের চাহিদা বিয়ের বাজারে বেড়েছিল অস্বাভাবিক রকম। কন্যা অরক্ষণীয়া হওয়ার আগে পাত্রস্ত করে সামাজিক নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইতেন পিত-মাতা। মোটা অর্থ প্রাপ্তির চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ছাতনা তলায় টোপর মাথায় দাঁড়াতেন কুলীন বংশীয় তনয়। এ হল আমাদের পণ ও যৌতুক প্রথার ইতিহাস।
শ্রেণী ও ধর্মভেদে পণপ্রথার পার্থক্য : পণপ্রথা আমাদের দেশে বহুদিন আগে থেকেই প্রচলিত। সমাজে শ্রেণী ও ধর্মের মতপার্থক্য অনুযায়ী পণপ্রথা লক্ষণীয়। আমাদের মুসলমান সমাজে শরীয়ত অনুযায়ী ‘তালাক’ বা বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় কন্যাপক্ষকে পণ বা ‘মোহরানা’ হিসেবে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। হিন্দুদের মধ্যে পণপ্রথা খুবই প্রকট। কন্যার পিতাকে পণ না দিয়ে পাত্র বিয়ে করে বাড়িতে আনতে পারে না। হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে বর-পণপ্রথা প্রচলিত। সেখানে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে বর-পণ মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়। অর্থঙ্গতি না থাকলে সে সমাজে বিবাহ নিষিদ্ধ। আবার, অনেকক্ষেত্রে পণের অর্থ সংগ্রহ সময়সাপেক্ষ হলে অধিকাংশ পাত্রকে সঙ্গতি-অর্জনের পর অধিক বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হতে হয়। এর ফলে সর্বশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে বর-কণের বয়সের তারতম্য অনেক সময় বিসদৃশ মনে হয়।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের চিত্র : আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজে পণপ্রথাকে ঘিরে নারী-নির্যাতনই নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীর মর্যাদা সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে রক্ষিত হয় নি। হিন্দু সমাজে নারী উপেক্ষিত হতো। তারা বহু-বিবাহ প্রথায় প্রশ্রয় দিয়ে নারী-নির্যাতনে ইন্ধন যুগিয়েছিল। বস্তুত নারীর এভাবে মর্যাদাহানির মধ্য দিয়েই পণ-প্রথার উদ্ভব। বল্লাল সেনের সময়ে কৌলিন্য-প্রথার সৃষ্ট নারী-নির্যাতনে সাহায্য করে; বরপণ দিতে বাধ্য পাত্রীর অভিভাবকরা অতিদ্রুত সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। অপর চুক্তিতে বরপণ দিতে অপারগ অভিভাবকদের কন্যারা শ্বশুর বাড়িতে অপরিসীম নির্যাতন ভোগ করতে থাকত। মধ্যযুগে মুসলমান আমল থেকে নারীকে ক্রমশ পর্দার অন্তরালে প্রবেশ করতে হয়। এর ফলে শিক্ষার প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ে। যৌতুকই ধীরে ধীরে পরিণত হয় প্রথাচারে। শুরু হল পণপ্রথার ব্যভিচার। নারী হল বিকিকিনির পণ্যসামগ্রী। অন্ধকারে ছেয়ে গেল সে-জীবন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারী-মুক্তি আন্দোলন : ঊনবিংশ শতাব্দিতে ও উপমহাদেশে কতিপয় মনীষীদের সমাজ-সংস্কার-প্রয়াস আমাদের দেশের নারী-মুক্তির আন্দোলনকে অনেকদূর এগিয়ে দেয়। এ সময়ে আমাদের জাতীয় জীবনে যে নব-জাগরণে সূচনা হয় তা কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতায় দীর্ণ মুমূর্ষু সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে নতুন যুগের নব নব অগ্রসর চিন্তাধারার মুখোমুখি হতে সাহায্য করে। ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার সংস্পর্শ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বহুলাংশে সাহায্য করে। ফলে বহুবিবাহ ও বাল্য-বিবাহ নিরোধে সমাজসেবীরা তৎপর হলে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়; রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটে। বিধবা-বিবাহ চালু করার প্রয়াস চলে এবং পণপ্রথার বিরুদ্ধে অনেকেই সোচ্চার হন। বিদ্যাসাগর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশহিতব্রতীদের অদম্য প্রয়াসে আইনসিদ্ধ হয় বিধবা বিবাহ। কিন্তু জাতির এই শুভ জাগরণের দিনেও কলঙ্কিত পণপ্রথার অবসান হল না।
আমাদের করণীয় : আজ নারী তার আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার পেয়েছে। সমাজের দিকে দিকে উড়ছে প্রগতির নিশান। নারী ছড়িয়ে পড়েছে বিচিত্র কর্ম-প্রেরণায়। নানা ক্ষেত্রে তার সাফল্যের স্বীকৃতি। তবু পণপ্রথা আজও এক সামাজিক ব্যাধি। এক কলঙ্ক-ক্ষত। আজও সমাজের এ এক লজ্জা। আসলে যা দরকার তা হল সুস্থ মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজকল্যাণমূলক প্রকৃত গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। পণপ্রথার বিরুদ্ধে এদেশের তরুণ-তরুণীদেরই সকলের আগে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা যদি চায়ের আসরে বসে সমাজ-সংস্কার উপলক্ষে রাজা-উজির মারে আর নিজ নিজ বিয়ের সময় হয়ে পড়ে দুর্বল ও অসহায় বশংবদ, তবে আরো শতবার পণপ্রথা নিবারণী আইন পাস করলেও আসল রোগের উপশম কিছুই হবে না। তরুণীরাও পণ্যসামগ্রী হিসেবে নিজেদের না ভেবে আন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটালে সমাজে পুরুষদের দৌরাত্মা বহুলাংশে কমে যেতে বাধ্য। প্রয়োজনে দিকে দিকে নারীমুক্তি আন্দোলনের ডাক ছড়িয়ে দিতে হবে এবং লেখাপড়া শিখে নিজেদের সামাজিক মূল্য ও মর্যাদা অর্জন করতে হবে। এভাবে আমাদের সমাজে চিহ্নিত পণপ্রথার বিষাক্ত-ক্ষতের যন্ত্রণা ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে পড়বে। আসলে যা দরকার তা হল সুস্থ মানসিতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজকল্যাণমূলক প্রকৃত গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
সাম্পতিককালে পণপ্রথার রূপদান : সাম্প্রতিককালে পণপ্রথা লাগামহীনভাবে প্রচলিত। শুধু তার রূপদান হয়েছে মাত্র। ইতঃপর্বে পণের অর্থ হাতে হাতে আদায় করার ব্যবস্থা ছিল। বিয়ের আসরেই পাত্রপক্ষ সব যৌতুকসামগ্রী বুঝে নিতেন এবং দেনা-পাওনার ব্যাপারটা মিটে গেলে পাত্রকে বিয়ের আসরে আনা হতো। এছাড়া, প্রাপ্য অর্থ বুঝে নেওয়ার সময় পাত্রীপক্ষের দিক থেকে চুক্তির কোনরূপ খেলাপ গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো এবং শুধুমাত্র এই অপরাধে বিয়েবাড়ি থেকে বর উঠিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বর্তমানে আসল ব্যাপারটা প্রায় কিছুই বদলায় নি; শুধুমাত্র সবকিছুর উপর ভদ্রতার মুখোশ এঁটে দেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই শালীনতার দোহাই দিয়ে নগদ অর্থ নিতে চান না। এর পরিবর্তে প্রত্যাশা করেন রঙীন টেলিভিশন, টেপ-রেকর্ডার, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার, মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি কিংবা জমি-জায়গা ইত্যাদি। আমরা শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায় আজ অনেক এগিয়ে। কিন্তু দুঃখের কথা, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সমাজে প্রাচীন মানসিকতার অনুবর্তন চলছে অদ্যাবধি। শুভ পরিণয়ের মধুর সম্পর্ক গড়ে-ওঠার আগেই শুরু হয় দোকানদারী- দেনা- পাওনার দর-কষাকষি। ভেবে দেখুন যৌতুকের টাকার ওপর নির্ভর করে নববধূর গূনাগুণের মূল্যায়ন। আজকের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিত- অশিক্ষিত, ধনী- দরিদ্র, শাসক- শোষক নির্বিশেষে সবাই কম বেশি এই হীন কাজটির সাথে জড়িত।
পণপ্রথার বিরুদ্ধে আইন ও গৃহীত পদক্ষেপ : বর্তমানে আমাদের দেশে নারী নির্যাতন নিরসনকল্পে আইন রয়েছে- ’যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০’। এই আইনে বলা হয়েছে যে, পণ প্রদান অথবা গ্রহণ কিংবা দাবি করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এক্ষেত্রে শাস্তি হচ্ছে কারাদণ্ড কিংবা জরিমানা। কিন্তু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত যৌতুক দানের নাম করে আইনের চোখে ধূলি নিক্ষেপের যে আয়োজন হয়েছে তার বদৌলতে প্রায়শই দেখা যায় যে, ’বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। আইনে অপরাধীদের শাস্তির বিধান থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে পণপ্রথাকে ঘিরে মনুষ্যত্বের যে নিদারুণ অবমাননা দীর্ঘদিন চলছিল, তা এখনও বলবৎ রয়েছে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); দ্রুত বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট ২০০২ রয়েছে।
উপসংহার : প্রাচীন কাল যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পৃথিবীতে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে- সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের বর্বর চরিত্রের তেমন রূপবদল হয় নি। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি অত্যাচার ও অবিচার নানাভাবে বর্তমান রয়েছে। যুগে যুগে বিভিন্ন সমাজসংস্কারক, ধর্মপ্রবর্তক, মানবতাবাদী মহাপুরুষ সমাজের কল্যাণে বহু দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, সে-সব উপদেশ-নির্দেশ পালন করলে সমাজে নারীর মর্যাদা উন্নত হত।
Helpful.
ReplyDelete