বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ।
মূলভাব : এ পৃথিবীতে একদল মানুষ আছেন যারা মনে করেন সমাজ-সংসার ছেড়ে, ইন্দ্রিয় দমন করে নির্জনে সাধনা করলে বুঝি মোক্ষলাভ হয়। তাদের একমাত্র ধারণা- ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’।
সম্প্রসারিত ভাব : জ্ঞানমার্গের সাধক, যোগীরা তাই বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি খুঁজেন। কিন্তু রূপসাগরেই যে নিহিত আছেন অরূপরতন,
‘ডুব ডুব রূপ সাগরে আমার মন।
খোঁজ খোঁজ খুঁজলে পাবি হৃদয় মাঝে বৃন্দাবন।’
রূপসাগরে ডুব দিয়েই যে অরূপ রতন মেলে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
‘পথের দুই ধারে যে ছায়া, যে সবুজের ঐশ্বর্য, যে ফুল পাতা, যে পাখির গান, সেই রসের জোগান দিতেই আমরা আছি। যে বিচিত্র বহু হয়ে খেলে বেড়ান দিকে দিকে, সুরে, গানে, নৃত্যে, চিত্তে, বর্ণে বর্ণে, রূপে, সুখ-দুঃখের আঘাতে-সংঘাতে, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বে-তাঁর বিচিত্র রসের বাহনের কাজ আমি গ্রহণ করেছি। তাঁর রঙ্গশালার বিচিত্র রূপকগুলোকে সাজিয়ে তোলার ভার পড়েছে আমার উপর, এ আমার একমাত্র পরিচয়।’
এ রূপনিকেতন থেকে মন ও দৃষ্টি সরিয়ে গাম্ভীর্যে নিজেকে গড়খাই করে তোলার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন প’রে
বাঁধা সবার কাছে।’
সুতরাং, অসংখ্য বন্ধন মাঝেই মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ লাভ করা সম্ভব। পঞ্চাইন্দ্রিয় যার সজীব ও পুলকিত তিনিই হতে পারেন জিতেন্দ্রিয়। তার মধ্যে অলীক কিছু নেই, অলৌকিকও নেই এক ফোঁটা। দর্শন যাকে দর্শন করেনি, উপাসনালয়ে দর্শনী দিয়ে যার দেখা পাওয়া যায় নি কোন কালে বিশ্বের মধ্যেই সেই বিশ্বেশ্বরের আসন। জগতের প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্টি-ক্রিয়াশীল ঈশ্বরের অস্তিত্ব-মহিমা প্রকাশ করছে। তাঁর প্রকাশ পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ ও শব্দের মধ্যেই।
কাজেই পৃথিবী যার চোখে সুন্দর হয়ে উঠে ঈশ্বর তার উপরই সন্তুষ্ট হন। সংসারে থেকেই, আপন কর্তব্য সাধনেই প্রেমসুন্দর ঈশ্বরকে লাভ করা যায়।