ভাবসম্প্রসারণ : সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর।

সে কহে বিস্তর মিছা,
যে কহে বিস্তর।

মূলভাব : যে ব্যক্তি বেশি কাজ করে তার কাজের মধ্যে যেমন ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তেমনি যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে তার কথার মধ্যেও ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ কথার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহনই হলো ভাষা বা কথা। এ কথার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ তার চাহিদার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু এ কথায় এক সময় ‘কথার কথাতে পরিণত হয়, আবার অন্য সময় অকথা হিসাবে প্রাণ পায়।’ বাস্তব জীবনে লক্ষ করলে দেখা যায়, সমাজে যে সব শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং জ্ঞানী লোক আছে তারা প্রত্যেকেই কম কথা বলেন। কম কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘যতটা না পড়বে তার চেয়ে অধিক বেশি চিন্তা করবে।’ কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে তার সুফল পাওয়া যায় কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ না করলে সে কথাটিই আবার অকথায় পরিণত হয়। পরিমিত কথার মধ্যে বাস্তবতার পরিচয় বহন করে। কিন্তু এ কথাকেই দীর্ঘায়িত ও শ্রুতিমধুর করে উপস্থাপন করতে গিয়ে কথার মৌলিকতা হারিয়ে ফেলে এবং মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। 

অতিরিক্ত কিছুই ভাল নয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা ব্যবহার না করে সংক্ষিপ্ত আকারে মূলভাব উপস্থাপনই শ্রেয়।


এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


ভাব-সম্প্রসারণ : পৃথিবীতে যাা ধ্রুব সত্য তা কখনো বার বার বলে, বিশ্লেষণ করে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। যেসব বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে, যা সত্য নয় সে সব বিষয়েই বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে। অসত্যকে সত্যতে রূপায়নের জন্যে, একটি মিথ্যাকে সত্যতে পরিণত করার জন্যে অনেকগুলো মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। বস্তুত কারো মুখের কথায় অভিভূত না হয়ে তার অন্তরস্থ সত্য উপলব্ধিতেই আছে সার্থকতা। এই পৃথিবীতে যাঁরা প্রকৃত মহৎ তাঁদের সুকৃতি আত্মপ্রচারের অপেক্ষা রাখে না। তাঁদের প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত।

সমাজে কিছু কিছু ব্যক্তি এভাবে নিজেদের গুণ গেয়ে এবং শারীরিক ও আর্থিক বিশালতা দেখিয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করেন। এমনকি প্রচারসর্বস্ব পন্থায় সমাজের কাছ থেকে নাম কেনার চেষ্টা করেন। তাদের আত্মপ্রচারের মধ্য দিয়ে তারা যে প্রকৃত ছোট তা ধরা পড়ে যায়। সত্যের মধ্যে কোন গোপণীয়তা নেই। যা ঘটে তা বিকৃত না করে অকপটভাবে প্রকাশ করলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় না। কিন্তু আসল জিনিস লুকিয়ে কিংবা কোন বিষয়ের ভাব-সত্যকে আড়াল করে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। আর অতিরিক্ত কথা বলতে গেলেই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। স্বার্থান্ধ মানুষ অনেক সময় নিজের সুবিধার জন্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং ছোট্ট একটি বিষয়কে অতি রঞ্জিত করে বর্ণনা করে তাকে সত্যে পরিণত করার চেষ্টা করে। নানাভাবে ছলচাতুরি করে নিজেকে অপরের কাছে জাহির করে স্বার্থ উদ্ধার করে। বস্তুত যে কোনো বিষয়ে খুব বেশি কথা বললে তার অন্তঃসারশন্য রূপটিই প্রকট হয়ে ওঠে। কর্মের ভাণ্ডার যাদের শূন্য; নিষ্ঠা, সাধনা, শ্রমে যারা বিমুখ; যাদের জ্ঞ্যন কম, -তারাই যে-কোনো বিষয়কে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করে। এতে করে মানুষের মধ্যে সন্দেহেরই উদ্রেক হয়। কেননা সত্যকে কখনো বাড়িয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। যে প্রকৃতই গুণী তাঁর প্রকাশ হয় বিনীত, পরিমিত ও রুচিশীল। সে কখনো বেশি কথা বলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে না। শূন্য কলসি যেমন সামান্য আঘাতেই বেশ শব্দ করে, গুণহীন অসার ব্যক্তিরাও তেমনি কারণে-অকারণে নিজের ঢোল নিজে বাজাতে গিয়ে তার অসারতাকেই প্রকাশ করে।

বস্তুত যাদের কর্মের ভাণ্ডার শুন্য; নিষ্ঠা, সাধনা ও শ্রমে যারা বিমুখ; মনের দিক থেকে যারা নিকৃষ্ট, চিন্তায় যারা তরল, তারাই আত্মপ্রচারসর্বস্ব হয়। প্রকৃত গুণীব্যক্তিগণ কখনোই অহেতুক আত্মপ্রচারের কৌশল অবলম্বন করেন না। প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষের মুখের কথায় নয়, মিথ্যাতেও নয়, তার আভ্যন্তরীণ গুণধর্মে। অন্তরস্থ সৌন্দর্যে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post