প্রবন্ধ রচনা : নগরজীবন

ভূমিকা : কর্মকোলাহলে মুখরিত নগর জীবন বড়ই বেরশিক। যন্ত্র সভ্যতার এ জীবন একান্ত যান্ত্রিক। জীবনের স্বাদ এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত, অবহেলিত। রূঢ় বাস্তবতার এ জীবনে ব্যস্ততা আছে, মমতা নেই। এখানে জীবনের কোলাহল আছে, স্নেহ-প্রেম যেন নির্বাসিত। তবুও নগরজীবনই মানুষের কাম্য। আর এখানেই নগরজীবনের সার্থকতা। মানুষ গ্রামকে দিনে দিনে পেছনে ফেলে নগরমুখী হয়ে পড়ছে, সকলেই চায় একবার হলেও নাগরিক জীবনের স্বাদকে অভিজ্ঞতায় নিয়ে আসতে।

নগরজীবনের পরিচয় : মায়া-মমতাহীন নগরজীবন পল্লিজীবনের বিপরীত জীবন। নগরজীবনে মানুষ আর মানুষ। মানুষের পর্যাপ্ততা এখানকার সাধারণ দৃশ্য। ইট-পাথরের বাড়িঘর, সুউচ্চ ইমারত, দিকে দিকে নগরের পরিচিত চিত্র। অফিস, আদালত, কলকারখানা, ছোটবড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্পকরখানা সব মিলিয়ে নগর যেন দালানকোঠার অরণ্য। এখানে গ্রামের মেঠো পথ নেই, পথে চলে না গরুর গাড়ি। এখানে আছে পিচঢালা পথ, পথে ছুটে চলে মানুষ। ছুটে চলে শত সহস্র মোটর গাড়ি, গাড়ির শব্দে আর মানুষের কোলাহলে কান বন্ধ হয়ে আসে- যেন শব্দ উৎপাদন করাই নাগরিকের কাজ। নগরে পাখির কিচিরমিচির নেই, আছে খাদ্য সন্ধানী কাকের কলরব। অবিশ্রাম খাটুনি নগরের মানুষের প্রতিদিনকার স্বাভাবিক চিত্র।

নগরজীবনের সুবিধা : নাগরিক জীবনে রূঢ় কঠিন বাস্তবতা যেমন আছে তেমনি আছে জীবন ধারণের অনিবার্য চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তা। চিকিৎসা ও শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম। এ শিক্ষা ও চিকিৎসার উপযুক্ত যোগান পেতে হলে নগরজীবনের বিকল্প নেই। দেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়, নগরে বা নগরের উপকণ্ঠে অবস্থিত। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সাধ পূরণ করতে হলে নগরজীবনকে গ্রহণ না করে সম্ভব নয়। নগরজীবনে মানুষ শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক জীবিকার জন্যে তার কোনো না কোনো কাজ আছেই আছে। নগরের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত। ফলে সঠিক চিকিৎসা লাভে রোগী সুস্থ হবার আশা করতে পারেন। তা গ্রামে সম্ভব নয়। নগরজীবনের শিক্ষার মান অনেক উন্নত এবং সময়োপযোগী। ফলে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে নিজকে গড়ে তোলার সুযোগটি এখানে সুবিস্তৃত। নগরের মানুষ অধিকাংশই শিক্ষিত বলে এখানে সুশীল শ্রেণির মানুষদের নিয়ে একটি উন্নত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত।

নগরজীবনের সীমাবদ্ধতা : নগরজীবন আত্মবন্ধনহীন। তাই হাজারো সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নগরজীবনে অসংখ্য সীমাবদ্ধতাও বর্তমান। এখানে মানুষ নিরতিশয় ব্যস্ত বলে মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হয় না। এখানে মানুষের মন উপার্জনের পিছু ধাওয়া করতে করতে মানুষের প্রাণ এখানে ওষ্ঠগত প্রায়। এখানে অপরের দুঃখে নিজের মনে সহজে সহানুভূতি জাগে না। দিনে রাতে এখানে মানুষ নিজকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের সাথে তার মিতালি গড়ে ওঠা কঠিন। ইট-কাঠের বসতবাড়িতে বসবাসরত মানুষ তার জীবনে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বধূ’ কবিতায় বলেছেন-
নগরজীবনে আছে জীবিকার জন্যে, অর্থ উপার্জনের ব্যস্ততা। এখানে আনন্দ নেই, প্রাণমাতানো হাসি নেই। আর যেটুকু আছে সেটুকুও কৃত্রিমতার বাইরে নয়।

নগরজীবনের প্রয়োজনীয়তা : সভ্যতার প্রান্তর উদার না হলেও জীবনের চাহিদার জন্য নগর জীবনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নাগরিক জীবনে মায়া মমতাহীন নিষ্ঠুরতা থাকলেও এ জীবন আমাদের কাছে কাম্য হয়ে সুচিকিৎসা চাই, মানসম্মত জ্ঞান অর্জন চাই, আমরা বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে দেশকে উন্নত করতে চাই, জীবিকার উপায় চাই- অতএব, নগরজীবনকেই চাই। তাই নগরজীবনকে বাদ দিয়ে সভ্যতা, উন্নতি, আত্মবিকাশ কোনোটাই সম্ভব নয়। ফলে নগরজীবনের প্রয়োজনীয়তাও আমাদের কাছে অনস্বীকার্য।

উপসংহার : নিসর্গের স্বপ্নভূমি গ্রাম মানুষের জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হলেও যুগে-চাহিদার অনিবার্য আকর্ষণে মানুষ নগরজীবনকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর। মানুষ নগরকে তৈরি করেছে তার জীবনের অনিবার্য তাগিদ থেকে। সে তাগিদ কখনও ফুরিয়ে যাবার নয়। তাই নগরজীবনও কখনও আবেদন হারাবার নয়। জীবনের তাগিদে প্রয়োজন নগরজীবনের।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post