রচনা : অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা

↬ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা


ভূমিকা : দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি দক্ষ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনের উপকরণের সুষম বণ্টন, উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ, দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং দ্রুত শিল্পায়নের জন্য একটি সুসমন্বিত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অত্যাবশ্যকীয় ভৌত অবকাঠামো হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি, বর্তমান বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ স্থাপন একান্ত জরুরি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের ফলেই বিশ্বের দেশগুলো আজ খুব কাছাকাছি এসে গেছে।

সড়ক যোগাযোগ : সড়ক যোগাযোগ বাংলাদেশের জনপরিবহনের প্রধান মাধ্যম। দেশের প্রতিটি জেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। যমুনা সেতু, রূপসা সেতু, মেঘনা সেতু, বুড়িগঙ্গা সেতু, ধরলা সেতু প্রভৃতির কল্যাণে বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০০৫ সালের জরিপ অনুযায়ী পাকা ও কাঁচা মিলিয়ে বাংলাদেশে মোট ২ লাখ ৪১ হাজার ২৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও জনপথ রয়েছে। সড়ক পথে বাস, মিনিবাজ, ট্রাক, লরি, মোটরগাড়ি, টেম্পুসহ অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল করে। তাছাড়া রিকশা ও অন্যান্য মনুষ্যচালিত যান শহর ও গ্রাম-গঙ্গে চলাচল করে। দ্রুত গমনাগমন ও পণ্য পরিবহনের আদর্শ মাধ্যম হচ্ছে সড়ক পথ।

সড়ক পরিবহন : স্বাধীনতার পর বিগত ৪৭ বছরে বাংলাদেশে দুই লক্ষ একচল্লিশ হাজার কিলোমিটারের (কিমি) অধিক বিস্তীর্ণ এক সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যা ছিল মাত্র ৪ হাজার কিমি। পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
সড়ক পরিবহন খাতের এ সম্প্রসারণের ফলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অন্যান্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় এর অবদান দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রেলপথ : বিগত শতকের শুরুতে বাংলাদেশে রেলপথ গড়ে ওঠে। দেশের কয়েকটি জেলা বাদে সব জেলা রেল যোগাযোগের নেটওয়ার্কভুক্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ২৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ৬৬০ কিলোমিটার ব্রডগেজ, ৪১০ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ও ১৮০৮ কিমি মিটারগেজ রেলপথ। যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে জামতৈল থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ বসানোর কারণে উত্তরবঙ্গের সাথে রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকায় সরাসরি রেল যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। রেলপথে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহন আরামদায়ক, নিরাপদ ও তুলনামূলকভাবে কম বয়সাপেক্ষ। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারের একটি অন্যতম প্রাচীন সেবাধর্মী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যা দেশের আর্থ-সামাজিক তথা শিল্পোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি পরিবেশ বান্ধব, নিরাপদ এবং সুলভে মালামাল পরিবহনে সক্ষম একটি নির্ভরশীল মাধ্যম।

নৌপথ : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সব মিলিয়ে এদেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী যোগাযোগ মাধ্যম হলো নৌপথ। দুই ধরনের নৌপথ এদেশে বিদ্যমান। যথা- ১. সমুদ্র পথ তথা আন্তর্জাতিক নৌপথ ও ২. নদী তথা অভ্যন্তরীণ নৌপথ। সমুদ্র পথে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন করা হয়। সমুদ্র পথে যোগাযোগের মাধ্যম হলো চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রবন্দর ও মংলা সমুদ্রবন্দর। অপরদিকে, রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৬টি জেলাসহ শরিয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীর যোগাযোগের সহজতম মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। বাংলাদেশের প্রধান নদীবন্দরগুলো হচ্ছে ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঝালকাঠি, ভৈরব ইত্যাদি। নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় খুব কম বলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে ট্রলার ও বার্জ যোগে ভারী পণ্য পরিবহন করা হয়ে থাকে।

বিমান পথ : বাংলাদেশের জাতীয় বিমান সংস্থার নাম ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’। হযরত শাহজালাল (রহ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দর। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং ৮টি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর পরিচালনা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট হলো দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দর বর্তমানে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের ১৮টি এয়ারলাইন্স এর বিমান পরিচালনা করছে। সরকারি বিমান সংস্থা ছাড়াও ৪টি বেসরকারি বিমান সংস্থা অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর, কক্সবাজার, বরিশাল প্রভৃতি অন্যতম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স দেশের অভ্যন্তরে ও বর্হিবিশ্বের সাথে আকাশ পথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সীমিত সম্পদ নিয়ে বিমান তার ১৫টি উড়োজাহাজের মাধ্যমে তার কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। ২০১৯ সালে ‘গাঙচিল’‘রাজহংস’ নামে দুটি ড্রিমলাইনার বিমান বহরে যুক্ত হয়। ২০১৮ সালেও এমন দুটি বিমান যুক্ত হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ২টি এবং আন্তর্জাতিক ২৬টি গন্তব্যে সার্ভিস পরিচালনা করছে। আন্তর্জাতিক গন্তব্যের মধ্যে বিমান সার্কভুক্ত দেশে ২টি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৪টি, মধ্যপ্রাচ্যে ৮টি, ইউরোপে ২টি এবং গন্তব্যে সার্ভিস পরিচালনা করছে। বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ ও অপারেশনাল সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রুট পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের যাত্রীদের সুবিধার জন্য চট্টগ্রাম/সিলেটকে যুক্ত করে মধ্যপ্রাচ্যে কতিপয় ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।

টেলিযোগাযোগ : আধুনিক বিশ্বে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বিস্ময়কর বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মূলত টেলিযোগাযোগ তথা তথ্যপ্রযুক্তির অব্যাহত সম্প্রসারণে সারা পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফ্যাক্স, টেলেক্স প্রভৃতির মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশের সাথে বাংলাদেশ থেকে স্বল্পতম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। বাংলাদেশ অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের সাথে যুক্ত হয়ে তথ্য মহাসরণির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলার মধ্যে ডিজিটাল টেলিফোন সংযোগ রয়েছে। অধিকাংশ উপজেলাতেই ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়েছে। সারাদেশে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে গেছে সরকার টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও সার্ভিসের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বেশ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ : ডাক বিভাগ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে ৯৮৮৬টি (জানুয়ারি, ২০১৯ অনুযায়ী) পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ডাক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।

ডাক বিভাগের নিজস্ব সার্ভিস সমূহ নিম্নরূপ :
জিইপি সার্ভিস, ইএমএস সার্ভিস, ই-পোস্ট, ইন্টেল পোস্ট, মানি অর্ডার সার্ভিস, রেজিস্টর্ড সংবাদপত্র, বুক পোস্ট, পার্সেল সার্ভিস, বীমা সার্ভিস, ভ্যালুপেয়েবল সার্ভিস, রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস, ডাক দ্রব্যাদি (দেশীয় ও আন্তর্জাতিক) গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি।

তথ্যপ্রযুক্তি : যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বব্যপী বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বর্তমান বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এখাতে অগ্রগতি ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ খাতকে ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা’ মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে এবং এ নীতিমালার আলোকে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি বিভিন্নভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট অবদান রাখছে। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য। পণ্য চলাচল, ব্যবসায় সংক্রান্ত উপকরণের গতিশীলতা, কাঁচামাল ক্রয় ও পণ্য বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি : বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প আয়তনের দেশ। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার সব ধরনের মাধ্যম থাকলেও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে তা ব্যাপক ও উন্নত করা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজও হয়নি। যমুনা সেতু নির্মাণ হলেও রেল যোগাযোগ বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। বরং তা সীমিত হয়ে পড়ছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিককালে দেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং এর সুফল অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে এ দেশ সম্পৃক্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক অবদান রাখছে।

উপসংহার : জাতীয় জীবনকে সবদিক থেকে গতিশীল করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশে উন্নত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে জাতীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যার অবসান ঘটবে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাথে শহরের সরাসরি সংযোগ ঘটবে। অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে গ্রামীণ সমাজের মানুষের। সেজন্য অনুৎপাদনশীল খাত থেকে অর্থ সাশ্রয় করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা দরকার। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে অগ্রগতি ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে বৈদেশিক বিনিয়োগ নির্ভরশীল। এ গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতি বছরই এ খাতে বরাদ্দ যেমন বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং তেমনি নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এ খাতকে সমৃদ্ধ ও যুগোপযোগী করার প্রয়াস চালানো হয়েছে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা : আধুনিক যুগে পৃথিবীতে সভ্যতা বিস্তার ও অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে যাতায়াত ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে কোন দেশের প্রভূত উন্নয়নের মূলে রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া কোন দেশই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নতি করতে পারে না। কোন একটি দেশের সম্ভাব্য উৎপাদন, বণ্টন, মূল্য নির্ধারণ, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা-
(ক) জলপথ
(খ) স্থল পথ এবং
(গ) আকাশ পথ।

(ক) জলপথ : বাংলাদেশে দুই ধরনের জলপথ রয়েছে। যথা-
(১) নদী ও খালপথ এবং
(২) উপকূলীয় সমুদ্রপথ।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নদীপথের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। নদীপথে সাধারণত নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করে। বাংলাদেশে প্রায় ৮,৪০০ কি. মি. দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ নাব্য জলপথ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫,৪০০ কি. মি. সারাবছর নৌ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। অবশিষ্ট প্রায় ৩,০০০ কি. মি. কেবল বর্ষাকালে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে নদীপথে ছোট ছোট নৌকা থেকে শুরু করে লঞ্চ-স্টিমার, সী-ট্রাক, ট্যাঙ্কার, কোস্টার, ফেরী, কার্গো, ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রভৃতি চলাচল করে।

বাংলাদেশের ‍গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরগুলো হচ্ছে- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি ও খুলনা। অন্যান্য নদীবন্দরের মধ্যে ভৈরব বাজার, আশুগঞ্জ, মীরকাদিম, গোয়ালন্দ ও সিরাজগঞ্জের নাম উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের নদীপথগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নদীপথের গুরুত্ব ব্যাপক। নদীমাতৃক এদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি বড় ও ছোট নদীগুলো সারাবছর নাব্য থাকে যার ফলে নৌ পথেই যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হয়। পরিবহণ ব্যবস্থার মধ্যে নৌপথ খুবই সুলভ। ভারী পণ্য পরিবহণে নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নৌপথে খুব সহজেই খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসল শহরাঞ্চলে প্রেরণ করা যায়। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ আহরণে নদীপথের গুরুত্ব রয়েছে। নৌপরিবহণের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত থেকে বহু লোক জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

(খ) স্থলপথ : স্থলপথ বলতে বোঝায় সড়কপথ ও রেলপথ। সড়কপথে যাতায়তের যানবাহন হল বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি, মোটর সাইকেল, রিক্সা, সাইকেল, অটোরিক্সা ইত্যাদি। রেলপথে রেলগাড়িই একমাত্র বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সড়ক পথের পরিমাণ ছিল ৩৮,৬২৩.৪৫ কিলোমিটার। ১৯৯৬-৯৭ সালের তথ্যানুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে মোট সড়ক পথের দৈর্ঘ্য ১,৭৮,৮৫৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে- পাকা রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ১১,৩৯৩ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তার দৈর্ঘ্য ১,৬৭,৪৬৬ কিলোমিটার (উৎস : পরিসংখ্যান পকেট বই, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সারণি ৮.০৩)

রেলপথ : বাংলাদেশে রেলপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রেলপথের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশে রেলপথের পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৮৫৭ কিলোমিটার। ১৯৯৫-৯৬ সালে ২,৭০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ ছিল। ১৯৯৮-৯৯ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ২,৭৩৩.৫১ কিলোমিটার রেলপথ আছে। (উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০০, সারণি ৩৭, পৃ: ১৬৭) এটি ‘বাংলাদেশ রেলপথ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে দুইপ্রকার রেলপথ রয়েছে। যথা- (ক) ব্রডগেজ ও (খ) মিটারগেজ

বাংলাদেশে ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রায় ৮৮৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ ছিল। ১৯৯৮-৯৯ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ৯০১.০৯ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ আছে। এ প্রকারের রেলপথ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। তবে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর ও রাজবাড়ি জেলায় সামান্য ব্রডগেজ রেলপথ আছে।

১৯৯৫-৯৬ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১,৮২২ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ ছিল। ১৯৯৮-৯৯ সালোর তথ্যানুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশে ১,৮৩২.৪২ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ আছে। যা যমুনা নদী দ্বারা দুইভাগে বিভক্ত। পূর্বভাগে সম্পূর্ণ মিটারগেজ রেলপথ, পশ্চিমভাগে ৯০১.০৯ কি. মি. ব্রডগেজ এবং অবশিষ্টাংশ মিটারগেজ। বাংলাদেশ রেলপথের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে যমুনা নদীর ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে তিস্তামুখ ঘাটে বা বাহাদুরাবাদ এবং সিরাজগঞ্জ ও জগন্নাথজঞ্জের মধ্যে দুটি রেলওয়ে ফেরী চালু আছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, টাঙ্গাইল, বরিশাল, পটুয়াখালি এবং বরগুনা ব্যতীত দেশের সব জেলাতেই রেলপথ আছে।

রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে রেলপথে যাতায়াত করা যায়। বাংলাদেশ রেলপথে সর্বমোট ৪৮৯টি রেলস্টেশন আছে। এর মধ্যে লাকসাম, আখাউড়া, ময়মনসিংহ, ভৈরব বাজার, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, শান্তাহার, বোনাপাড়া, কাউনিয়া এবং ঢাকার কমলাপুর জংশনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(গ) আকাশ পথ : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর দুটি শাখায় মোটামুটি উন্নয়ন ঘটলেও আকাশপথের তেমন কোন উন্নয়ন হয় নি। দেশের অর্থনৈতিক সহায়তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ বিমানপথ মূলত যাত্রী পরিবহণ করে আসছে। আকাশ পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী, যশোর, ঈশ্বরদী, সৈয়দপুর ও ঠাকুরগাঁও যাতায়া করা যায়। কুর্মিটোলায় অবস্থিত ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ দেশের প্রধান বিমান বন্দর। চট্টগ্রাম শাহ আমানত ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরকে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান সংস্থা আন্তর্জাতিক পথে বর্তমানে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার তাৎপর্য : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট অবদান রাখছে। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নে ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ কার্যকর। পণ্য আমদানি-রপ্তানী, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন উপকরণের গতিশীলতা, কাঁচামাল ক্রয় ও পণ্য বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পণ্যের বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর সরাসরি নির্ভরশীল। পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাতকরণ ও বীদেশে রপ্তানীর জন্য বন্দরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে। সুষম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অব্যাহত রাখার বিষয়টিও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। দেশের খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলার জন্য এবং দ্রুত পণ্যসামগ্রী পরিবহণের জন্য উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মূল্যবান সম্পদ আহরণের সুযোগ ঘটে উত্তম পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্যও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ সহায়ক।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় শিল্পকারখানার বিকাশ : শিল্প নীতির শিল্পে উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে স্থলপথ, জলপথ ও বিমান পথের উন্নয়ন ও সংস্কার হবার ফলে এবং বিশ্বের মুক্ত বাজার অর্থনীতির জোয়ারে দেশী ও বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিল্পকারাখানা প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ঢাকা অদূরে জয়দেবপুর, টুঙ্গি, গাজীপুর, তেজগাঁও, কেরাণীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন অঞ্চল দ্রুত শিল্প নগরীতে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম নৌবন্দর, চালনাবন্দরসহ দেশের ছোট ছোট বন্দরগুলো ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলেই। তাই যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি : বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প আয়তনের দেশ। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার সব ধরনের মাধ্যম থাকলেও অর্থনৈতিক অসচ্চলতার কারণে তা এখনো ব্যাপকভিত্তিক প্রসার লাভ করে নি। এছাড়া ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এদেশে জালের মতো নদী ছড়িয়ে আছে বলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দ্রুত সম্ভব নয়। অধুনা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে দেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং এর সুফল অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে এ দেশ সম্পৃক্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

উপসংহার : জাতীয় জীবনকে আরও গতিশীল ও স্বচ্চল করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এদেশে উন্নত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে জাতীয় জীবনে এর বহুবিধ সুফল পাওয়া সম্ভব এবং অর্থনৈতিক মুক্তিও ঘটবে দ্রুত। মোটকথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলেই দেশ ও জাতির উন্নয়ন হবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post