রচনা : জীবনচরিত পাঠের উপকারিতা

↬ জীবনচরিত পাঠের আবশ্যকতা

↬ জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা


ভূমিকা :
‘যাঁহাদের নাম স্মরণ আমাদের সমস্ত দিনের বিচিত্র মঙ্গলচেষ্টার
উপযুক্ত উপক্রমণিকা বালিয়া গণ্য হইতে পারে, তাঁহারাই আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়।’
                                               -রবীন্দ্রনাথ

আমরা সাধারণ মানুষ অসাধারণত্বের ঐশ্বর্য বলতে আমাদের কিছুই নেই। বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব। কিন্তু মানব-সমাজে যাঁরা অসাধারণ কিংবা অনন্যসাধারণ, যাঁদের মধ্যে আমরা দেখেছি মনুষ্যত্বের অপার বিস্ময়, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা করি। হৃদয়ের ভক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে আমরা তাঁদের উদ্দেশ্যে রচনা করি অর্ঘ-ডালা। মহাপুরুষগণের জীবনচরিত আমাদের অন্তরে সেই শ্রদ্ধা-ভক্তির অর্ঘ-ডালা রচনার প্রেরণা জাগায়। তাই আমরা তাঁদের অমূল্য জীবনচরিত পাঠ করি এবং হৃদয়কে সেভাবে বিকশিত করে তোলার চেষ্টা করি।

জীবনচরিতের বৈশিষ্ট্য : দেশে দেশে কালে কালে কত না মানুষের বিচিত্র ধারা। এরই মধ্যে কখনো কখনো জন্ম নেন এক-একজন অসাধারণ, ক্ষণজন্মা মানুষ। তাঁরা অপরাজেয় পৌরুষের অধিকারী, মনুষ্যত্বের সাধক, হৃদয়-ঐশ্বর্যে মহীয়ান, মহৈশ্বর্যে নম্র। তাঁরা মহাদৈন্যে উন্নত-মস্তক, সম্পদে কুণ্ঠিত, বিপদে নির্ভীক। তাঁরা আমাদের শুভ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, পরবর্তী প্রজন্মের নতুন ঠিকানা। তাঁরা যুগে যুগে স্মরণীয়, বন্দিত মহাপুরুষ। তাঁদের উদ্দেশ্যে আমরা নিবেদন করি ভক্তির অর্ঘ্য। তাঁদের মহৎ জীবনকথা স্মরণ করে আমরা সংগ্রহ করি চলার পাথেয়। তাঁদের জীবনের কাহিনী অবলম্বন করেই রচিত হয় জীবনচরিত। যে জীবনচরিত পরবর্তীকালের মানুষের কাছে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। যে জীবনচরিতের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আশার আলো, শোকের মধ্যেই পাই সান্ত্বনা।

জীবনচরিত পাঠের উপকারিতা : নানা মহৎজীবনী পাঠের উপকারিত গভীর ও ব্যাপক। জীবনচরিত পাঠ দু’দিক থেকে কল্যাণজনক। একদিকে যেমন তা সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে পাঠককে আনন্দ প্রদান করে, তেমনি অপরদিকে তা থেকে বিপুল শিক্ষালাভ করা যায়। জীবনচরিতকে একটি আদর্শ দর্পণ বলে অভিহিত করা চলে। এতে পাঠক নিজ চরিত্রের প্রতিফলন দেখতে পায়। শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনচরিতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, সত্যকে আবিষ্কার করে। উদ্বুদ্ধ হয় নবতর চেতনায়। তাছাড়া মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, সৎ কর্মে প্রবুদ্ধ হয়, জীবনকে একটি উদ্দেশ্যময় ও সুনিয়ন্ত্রিত পথে পরিচালিত করতে তৎপর হয়। মানব জীবনের বিচিত্র রহস্য জীবনচরিতে প্রতিফলিত হয় বলে মানবহৃদয়ের অতলান্ত রহস্যের যে অভিব্যক্তি জীবনচরিতে দেখা যায় তা পাঠকের মন আকর্ষণ করে। জীবনচরিত পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষ মানবমনের বিচিত্র সমস্যার সমাধান ঘটায়।

মানুষের অনাগত ভবিষ্যতের অন্ধকার পথে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন একটি আলোক-বর্তিকার প্রয়োজন পড়ে। জীবনচরিত সে দায়িত্ব পালন করে থাকে। জীবনকে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায় জীবনচরিতের মধ্যে। জীবনচরিতে প্রতিফলিত আদর্শকে অনুসরণ করে মানুষ তার নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে। জীবনের এই বিশেষ প্রয়োজনেই জীবনচরিত পাঠ একান্ত প্রয়োজন।

দুঃখ জয়ের অমৃত-বাণী, স্পর্শমণি স্বরূপ : মহাপুরুষগণের জীবনচরিত আমাদের সম্মুখে এঁকে দেয় আলোকিত পথ-রেখা, আমাদের প্রাণে ঢেলে দেয দুঃখ জয়ের অমৃতবাণী। তা মৃত্যু-জয়ের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে আমাদের যথার্থ মানুষ করে, রক্ষা করে অনিবার্য নৈরাশ্যের হাত থেকে। মহাপুরুষের জীবনীর মধ্যে আছে এক অমোঘ শক্তি। আছে স্পর্শমণির আশ্চর্য মাহাত্ম। এর ছোঁয়ায় অসুন্দরও সুন্দর হয়ে ওঠে, ক্ষুদ্রও মহৎ হয়। জীবনপাঠ আমাদের মধ্যে বপন করে এক মহৎ আদর্শের বীজ। কালে কালে সেই বীজই অঙ্কুরিত, পল্লবিত হয়ে পরিণত হয় মাহীরূহে। তখন আমাদেরও হয় নবজন্ম। ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিকতার মাহাত্ম অনুভব করতে পারি। পারি ক্ষণকালের জীবনকে নানা মহনীয় কাজে উৎসর্গ করতে। দুঃকের মধ্যেই খুঁজে পাই দুঃখ জয়ের উপায়। মহৎ জীবন আমাদের সেই চিরন্তন সত্যের দিকেই আকর্ষণ করে। অজস্র কল্যাণকর্মের মধ্যেই তাঁরা রেখে যান তাঁদের অমলিন পরিচয়।

জীবনচরিত নির্বাচন : বর্তমানে পৃথিবীতে অনেকেরই জীবনচরিত রচিত হয়। কিন্তু যে জীবনচরিত আমাদের দুঃখ জয়ের প্রেরণা দেয় না, যে জীবনচরিত আমাদের মহতের মহত্তে অনুপ্রাণিত করে না, যে জীবনচরিত আমাদের মানবতার বৃহত্তর আকাশে উত্তীর্ণ করে দেয় না বা জীবনের সঠিক পথ নির্দেশ করে না, সেরূপ জীবনচরিত পাঠের সার্থকতা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন,
‘যে নাচে তাহার জীবনচরিত, যে গান করে তাহার জীবনচরিত, যে হাসাইতে পারে তাহার জীবনচরিত। কিন্তু যে মাহাত্মা জীবন-যাত্রার আদর্শ দেখাইয়াছেন, তাঁহারই জীবনচরিত সার্থক। যাঁহারা সমস্ত জীবনের দ্বারা কোন কাজ করিয়াছেন তাঁহাদেরই জীবন আলোচ্য।’

বর্তমানকালে প্রকাশিত জীবনচরিতের ভিড়ে প্রকৃত মহাপুরুষের জীবনচরিতের নির্বাচন এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এক্ষেত্রে নির্বাচন অপরিহার্য। চরিতগ্রন্থের এই ভিড়ে আমাদের খুঁজে নিতে হবে সেই পরম বাঞ্ছিত জীবনকে। যে জীবনচরিত আমাদের কর্মপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে, যেখানে থাকে দুঃখ জয়ের বলিষ্ঠ-অঙ্গিকার, যে মহাজীবন সঙ্কীর্ণ ক্ষুদ্র স্বার্থমগ্ন জীবনের আবেষ্টনী থেকে আমাদের এক বৃহৎ জীবনের বেদীতলে নিয়ে আসে। অনুপ্রাণিত করে আত্মবিসর্জনে। যাঁদের স্মরণ করলে আমাদের জীবন মহত্ত্বের পথে আকৃষ্ট হয়, সেই জীবনচরিতই আমাদের অবশ্যপাঠ্য। যে জীবন সাধুতা বা বীরত্বে মহিমাময়, ত্যাগ ও মহত্বে প্রোজ্জ্বল, যাঁরা আমাদের নিয়ে যান অন্ধকার থেকে আলোতে, যাঁরা মুক্তির দূত, সভ্যতার প্রাণপুরুষ, অগ্রগতির পথ-নির্দেশক, অকৃত্রিমতা ধ্রুবতায় যাঁরা সংযত সমাহিত, যাঁরা বুক পেতে সয়েছেন সংসারের অশেষ নির্যাতন, স্বর্গ থেকে এনেছেন অমৃতপাত্র, এনেছেন বিশ্বাসের ছবি, পান করেছেন সংসার-সমুদ্র-মন্থনের সুতীব্র গরল, যুগ যুগ ধরে তাঁদেরই জীবনচরিত আদর্শ, প্রত্যেকের প্রত্যহ স্মরণযোগ্য।

মহাপুরুষের জীবনীতে দেশ-কালের চিত্র : সমাজ বহতা জীবনের প্রতিচ্ছবি। সেখানে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নানা উত্থান-পতন। রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় নানা তরঙ্গ-বিক্ষোভে সে জীবন সর্বদাই অস্থির। মহাপুরুষের জীবন তো দেশ-কাল-বিচ্ছিন্ন কোন একক ব্যক্তিত্ব মাত্র নয়। বরং নানা ঘটনার তরঙ্গে আন্দোলিত সে-মহাজীবন। তাই মনীষীর জীবনীপাঠে আমরা সেই দেশের সমাজ-সভ্যতা, রাজনীতি-ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ ইত্যাদির নানা তথ্য জানতে পারি। জীবনীগ্রন্থ তাই অলক্ষ্যে হয়ে ওঠে ইতিহাসের অন্যতম উপাদান। জীবনীগ্রন্থ এক অর্থে ঐতিহাসিক দলিলও।

উপসংহার : জীবনচরিতের মধ্যে আদর্শ মানুষের জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়। তাঁর জীবনের নানা ঘটনা প্রবাহের বিবরণ রূপায়িত হয়ে ওঠে। জীবনচরিত থেকে পাঠক যদি যথার্থ শিক্ষা অর্জন করতে পারে তবেই জীবনচরিত পাঠ সার্থক হয়। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই আজ মানুষ দিশেহারা, বিভ্রান্ত। চারপাশে আত্মকেন্দ্রিক, বিবেকহীন প্রতিযোগিতার মত্ততা। বর্তমানের এই হিংস্র দুঃসময়ে বিভীষিকার পথ উত্তরণের জন্যে তাই প্রয়েঅজন আত্মশুদ্ধির, প্রয়োজন দুর্নীতি-পঙ্কিল হৃদয়ের অন্ধকার অপসারণ। মানুষ তো চিরকালই অমৃত পথের যাত্রী। বর্তমানের এই সংকট মুহূর্তে জীবনচরিত পাঠই দেবে আমাদের সেই অমৃতের সন্ধান।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post