ভূমিকা :
‘যখনি চিত্ত জেগেছে / শুনেছ বাণী
তখনি এসেছে প্রভাত / যাও তোমার ব্রতপালনে’
এই মহাব্রত উদ্যাপনে যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, মানবতার বেদীমূলে যাঁদের জীবন অর্ঘ্য-রূপে নিত্য নিবেদিত, যাঁরা ক্ষুধাক্লিষ্ট, আর্ত, দারিদ্র্য-জর্জর, অসহায় মানুষের আশ্রয়, তাপিত-প্রাণে শান্তির শীতল বারি, সন্তাপে সান্ত্বনা, রুক্ষ ধূসর প্রেমহীন মরু-জীবনে যাঁরা করুণা-উৎস, তাঁদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নামও স্বরণীয়। পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাবের চিরবিদায়ী কাণ্ডারী, সহস্রাব্দের তূর্যবাদক, শতাব্দীর বার্তাবহক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
'Some are born great,
Some achieve greatness, and
some have greatness thrust
upon them.'
... William Shakespeare
জন্ম ও শিক্ষাজীবন : ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর জন্ম ১৯৪০ সালে, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বথুয়া গ্রামে। তাঁর পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ও মাতা সুফিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন ১৪ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। ভাইবোনদের পাঁচজনই মারা যায় শৈশবে। ১৯৪৭ সালে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। প্রথম পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই। এরপর লামাবাজার প্রাইমারি স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছেন। এখান থেকেই এস. এস. সি. পাস করেন মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান নিয়ে। স্কুল জীবনে স্কাউট ছিলেন। ১৯৫৫ সালে কানাডার ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বোরিতে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনার সময় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অংশ নেন। নাটক অভিনয়ের জন্য পুরস্কৃত হন। ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। সেখান থেকেই ১৯৬০ সালে বি.এ. ও ১৯৬১ সালে নেন এম.এ. ডিগ্রি। গ্র্যাজুয়েশনের পর যোগ দেন অর্থনীতি ব্যুরোতে এবং গবেষণা সহকারি হিসেবে কাজ করেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের অধীনে।
কর্মজীবন : ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এরপর চলে যান আমেরিকা। ১৯৬৯ সালে ভ্যানডার বিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন। ১৯৬৯ থেকে ’৭২ পর্যন্ত মিডল টেনিসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। এরপর বাংলাদেশে এসে অর্থনীতির প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৪ সালে প্রথম ক্ষুদ্র ঋণ প্রবর্তন করেন। একই বছর প্রতিষ্ঠা করেন তেভাগা খামার এবং গ্রামীণ ব্যাংক।
মৃক্তিযুদ্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস : ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন আমেরিকায় পড়াশোনা করতেন গরিবের এই ব্যাংকার। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়তে সুদূর আমেরিকায় নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি। সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের অধিকারী এই বাংলাদেশি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশি নাগরিক কমিটি। চালু করেন বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র। আমেরিকার তৎকালীন পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশি অফিসারদের সেখান থেকে বের হবার জন্য সাহায্য করেন। সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগেরও। এ দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতা দিতো।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর জীবনাদর্শ : খুব সাধারণ ও সাদাসিধে মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাগ কম। অহঙ্কার তার কাছে ঘেঁষতে পারে নি। কথা বলেন গুছিয়ে। তাঁর হাসিতে দ্যুতি খেলে। যে হাসিতে গরিব মানুষ তার কষ্ট ভুলে যান। তিনি ছুটে যান গ্রাম থেকে গ্রামে। মানুষের জন্য জামানত ছাড়া ঋণ নিয়ে। জোবরা গ্রাম তেভাগা সমিতি থেকে আজকের গ্রামীণ ব্যাংক। কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান। তাঁর আলাদা কোন দামি গাড়ি-বাড়ি নেই। তিনি কখনো কখনো অফিসের মাইক্রো অথবা জিপ ব্যবহার করেন। অফিস ঘরে তার বিশেষ গদি আঁটা চেয়ার নেই। কাঠের চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করেন তিনি। গ্রামীণ চেকের ফতুয়া পারেন তিনি। গ্যাবাডিন কাপড়ের নরমাল-কাট প্যান্ট পরেন সঙ্গে। বাসায় লুঙ্গি পরেন। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেলই ব্যবহার করেন। এ পোশাকেই তিনি দেশ থেকে দেশে, গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। বিশ্বের দেশে দেশে সবখানেই একই পোশাকে ইউনূস হাজির হন। এতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিঃসঙ্কোচে সব মানুষের সঙ্গে মেশেন। কোনো কৃত্রিমতা নেই। প্রাণখুলে কথা বলেন। মানুষের কথা শোনেন। মানুষকে আশার কথা শোনান।
ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক : ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর খ্যাতি দারিদ্র্য-দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণকে ব্যাংকিং জগতে প্রবর্তক হিসেবে। তাঁর এ ক্ষুদ্র ঋণ দেশের সবচেয়ে অভাবী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও যারা দুর্বল, সবচেয়ে অসহায়, সেই নারীর জন্য। পুরুষরাও পেতে পারেন এ ঋণ, তবে অগ্রাধিকার নারীদের। দারিদ্র্য তার ধারণায় একটি অস্বাভাবিক পঙ্গুত্ব। তুলনা করেছেন বনসাই বৃক্ষের সঙ্গে। যে গাছটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে নির্দিষ্ট আকার আয়তন লাভ করত, সেটাকে কৃত্রিম উপায়ে খর্ব করা হয়েছে। তাকে বাড়বার সুযোগ দেওয়া হয় নি। গ্রামীণব্যাংক এনজিও নয়, দাতা নীর্ভরশীলও নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের মাত্রা প্রায় শতভাগ। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং-এ এক কল্পনাতীত ব্যাপার। দেশে যত বড় ঋণ গ্রহীতা, তত বড় ঋণ খেলাপী। সাধারণ ব্যাংকিং-এর পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের এসব বৈশিষ্ট্য, গ্রামের নরনারীদের দরোজায় পৌঁছে দেয়া, দেশের দরিদ্র নারীদের জীবনে, তাদের চিন্তায়, তাদের স্বপ্নে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। নারীর ক্ষমতায়নে এ দেশে যতো কাজ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে সার্থক কাজের স্বীকৃতি লাভ করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর গ্রামীণ ব্যাংক।
নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন : ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক। যেটি ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের অভাবমুক্ত করার ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে।
বাঙালী হিসেবে তৃতীয় এবং বাংলাদেশি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গৌরবান্বিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তি একটি বড় ঘটনা। এই-ই প্রথম একজন অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
যে ছয়টি বিষয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়, তার মধ্যে মান্তি পুরস্কার ছাড়া সব ক’টি স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিশ সায়েন্স একাডেমি থেকে দেয়া হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয় নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে। অসলো সিটি হলে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত ১৩ অক্টোবর, ২০০৬ শুক্রবার নোবেল কমিটির ঘোষণাপত্রে বলা হয়, তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ড. মুহাম্মদ ইউনূসও গ্রামীণ ব্যাংককে সমান দুইভাগে ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নোবেল কমিটি। ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, বিশাল জনগোষ্ঠী যদি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ না পায় তাহলে টেকসই শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য বিরাট মডেল ও আদর্শের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ড. মুহম্মাদ ইউনূসের এ বিশাল প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের ১৫ কোটি জনতা আনন্দে আত্মহারা। অভিনন্দন আবারো ড. ইউনূসকে এবং এদেশের লক্ষ কোটি সৎ এবং পরিশ্রমী নারীদেরকে। তাঁর এ প্রাপ্তি পুরো বাংলাদেশের প্রাপ্তি। এ বিজয় পুরো বাংলাদেশের বিজয়। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। সমাদৃত পুরো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরিচয় হচ্ছে- বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ। এখন থেকে এ পরিচয়ের সঙ্গে আরও যুক্ত হবে ইউনূসের বাংলাদেশ এবং দারিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের সততার বাংলাদেশ।
উপসংহার : যারা দরিদ্র চিরজীবনের জন্য দরিদ্র থাকবে, যারা বঞ্চিত তারা চিরকালই অবহেলার শিকার হবে- এটা হতে পারে না। এজন্যই বঞ্চিত মানুষকে তাদের অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে দিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মহন ব্যক্তি দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছেন। এই কাজ এই মহান ব্যক্তিকে অনুসরণ করে হৃদয়বান ব্যক্তিরা এগিয়ে এলেই হবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সার্থকতা।
Fine
ReplyDelete