↬ সহিষ্ণুতা সাফল্যের মূলমন্ত্র
ভূমিকা :
যে দুর্লভ গুণ মানুষের কণ্ঠে পরিয়েছে বিজয়ীর বরণমালা, দিয়েছে বক্ষ-বিস্তৃত সাহস, শুনিয়েছে অমরত্বের মন্ত্র এবং যা তার জীবনযুদ্ধে সংগ্রামের কবচমুণ্ডল, তা হল সহিষ্ণুতা। এই গুণই মানব-সভ্যতাকে মাহিমাময় করেছে। এই সহিষ্ণুতাই তাকে দুঃখজয়ের অভয় মন্ত্র দিয়েছে। দিয়েছে নানা সার্থকতার সন্ধান। প্রতিকূলতাকে মানুষ জয় করেছে অসীম সহনশীলতায়। শুধু মানুষ কেন, মনষ্যেতর প্রাণীও সহিষ্ণুতার গুণে জীবন-যুদ্ধে জয়ী। কত বিশালকায় শক্তিমত্ত প্রাণী বিচ্ছিন্ন থেকে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অথচ ক্ষুদ্র প্রাণীরা আজও টিকে আছে। পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা সহিষ্ণুতারই শিক্ষা। শুধু মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যেই নয়, প্রকৃতির মধ্যেও রয়েছে সহিষ্ণুতার অমৃত ছোঁয়া। স্পর্ধিত পর্বতশীর্ষ ভয়াল-ভীষণ বজ্র-বিদ্যুতের হুংকারকে মেনে নেয়। সহ্য করে উদ্যতবাহু অরণ্য, ঝড়-ঝঞ্ঝার উন্মুত্ততা। জীবধাত্রী ধরিত্রী প্রতিনিয়ত সহ্য করে কত অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প, জলস্ফীতি, মহাপ্লাবন, মহামারীর দৌরাত্ম্য।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতার প্রভাব : জীবনের সর্বস্তরেই সহিষ্ণুতার মূল্য স্বীকৃত। এই অপরিসীম শক্তিধর গুণটিই মানুষের জীবনকে নানাভাবে অর্থময় করেছে। পারিবারিক জীবনে এনেছে শান্তির প্রবাহ। ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তিই জীবনকে সার্থক করে তোলে। সংসারে নানা কাজের সংঘাত, দুঃখে-দৈন্যে, বিপদে-আপদে মানুষের জীবন নিত্য আলোড়িত। তখন স্বভাবতই চিত্ত চঞ্চল, সংক্ষুব্ধ হয়। মানুষ হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু। কিন্তু যে মানুষ এই বিক্ষোভ-অসন্তোষের মধ্যেও শান্ত-চিত্ত, ধৈর্যশীল, সেই মানুষেরই আছে জীবনযুদ্ধে জয়ের অধিকার। সহিষ্ণু ব্যক্তি অবিচলিত থাকে বলেই সিদ্ধি তার করতলগত। যে মানুষ অস্থির চিত্ত, যে মানুষ কষ্ট সহিষ্ণু নয়, সে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বরণ করে পরাভবের গ্লানি। অসহিষ্ণু মানুষ পারিবারিক জীবনে অসুখী। পারিবারিক সংহতি বিনষ্টর অন্যতম কারণ অসহিষ্ণুতার প্রশ্রয়। অন্যপক্ষে সহিষ্ণুতা গার্হস্থ্য জীবনে আনে সুন্দরের স্বপ্ন। ছেলে-মেয়ে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্প্রতির সম্পর্ক। শুধু পরিবার নয়, বৃহত্তর রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সহিষ্ণুতার ভূমিকা অনন্য। অসহিষ্ণু, বিবেকহীন মানুষ সমাজজীবনেও অবাঞ্ছিত। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই অসহিষ্ণু, উদ্ধত, অবিবেকী মানুষ ডেকে আনে নানা উপদ্রব। অকারণ উষ্মা, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব জীবনকে ঠেলে দেয় এক সর্বনাশের দিকে। এই মনোভাবই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে সৃষ্টি করে বৈরীসম্পর্ক। ছড়ায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। প্রশ্রয় দেয় দুর্নীতি, অরাজকতা।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতার প্রভাব : জীবনের সর্বস্তরেই সহিষ্ণুতার মূল্য স্বীকৃত। এই অপরিসীম শক্তিধর গুণটিই মানুষের জীবনকে নানাভাবে অর্থময় করেছে। পারিবারিক জীবনে এনেছে শান্তির প্রবাহ। ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তিই জীবনকে সার্থক করে তোলে। সংসারে নানা কাজের সংঘাত, দুঃখে-দৈন্যে, বিপদে-আপদে মানুষের জীবন নিত্য আলোড়িত। তখন স্বভাবতই চিত্ত চঞ্চল, সংক্ষুব্ধ হয়। মানুষ হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু। কিন্তু যে মানুষ এই বিক্ষোভ-অসন্তোষের মধ্যেও শান্ত-চিত্ত, ধৈর্যশীল, সেই মানুষেরই আছে জীবনযুদ্ধে জয়ের অধিকার। সহিষ্ণু ব্যক্তি অবিচলিত থাকে বলেই সিদ্ধি তার করতলগত। যে মানুষ অস্থির চিত্ত, যে মানুষ কষ্ট সহিষ্ণু নয়, সে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বরণ করে পরাভবের গ্লানি। অসহিষ্ণু মানুষ পারিবারিক জীবনে অসুখী। পারিবারিক সংহতি বিনষ্টর অন্যতম কারণ অসহিষ্ণুতার প্রশ্রয়। অন্যপক্ষে সহিষ্ণুতা গার্হস্থ্য জীবনে আনে সুন্দরের স্বপ্ন। ছেলে-মেয়ে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্প্রতির সম্পর্ক। শুধু পরিবার নয়, বৃহত্তর রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সহিষ্ণুতার ভূমিকা অনন্য। অসহিষ্ণু, বিবেকহীন মানুষ সমাজজীবনেও অবাঞ্ছিত। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই অসহিষ্ণু, উদ্ধত, অবিবেকী মানুষ ডেকে আনে নানা উপদ্রব। অকারণ উষ্মা, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব জীবনকে ঠেলে দেয় এক সর্বনাশের দিকে। এই মনোভাবই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে সৃষ্টি করে বৈরীসম্পর্ক। ছড়ায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। প্রশ্রয় দেয় দুর্নীতি, অরাজকতা।
সহিষ্ণুতা চারিত্র্য-শক্তিরই লক্ষণ ও অনুশীলনসাপেক্ষ : মানবসভ্যতার সেই অস্ফুট মুহূর্ত থেকে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, আজও তার শেষ হয় নি। এই সংগ্রামই মানুষের অভিজ্ঞানপত্র। জীবন-যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে প্রয়োজন সাহস ও সহনশীলতা। এই শক্তিই মানুষের এক মহৎ চারিত্র্যলক্ষণ। দুর্বলচিত্ত, সহিষ্ণুতা তাদেরই চরিত্রের এক মহৎ মানবিক গুণ। শান্ত চিত্তে প্রতিকূলতাকে জয় করার মূলে আছে সহিষ্ণুতা। অন্য মানবিক সদ্গুণের মতোই জীবনে সহিষ্ণুতারও সযত্নে লালন, পরিচর্যা প্রয়োজন। নিরন্তর অনুশীলনেই এই বৃত্তির বিকাশ। ছাত্রজীবনই হল এই সদ্গুণ অঙ্কুরিত করার যথার্থ ক্ষেত্র। বহু পরীক্ষা, কৃচ্ছ্রসাধনার ভেতর দিয়েই এই শ্রেয় গুণের অধিকারী হওয়া যায়। অপরের প্রতি প্রীতি, সহানুভূতি, সমবেদনা থাকলেই মানুষ সহিষ্ণু হয়। জগতের সব সহিষ্ণু মানুষই এই মানবতাগুণে দীপ্ত।
মহাপুরুষ, প্রতিভাবান, অভিযাত্রী বনাম সহিষ্ণুতা : ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তিরাই মানবজন্মকে সার্থক করে তোলেন। মহৎ জীবনে যাঁদের অধিকার, তাঁরা সহিষ্ণুতারই প্রতিমূর্তি। অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েই মনীষীরা কর্মের পথে এগিয়ে গেছেন অবিচল নিষ্ঠায়। তাঁদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কত কালবৈশাখী ঝড়। তাঁরা জীবনে পেয়েছেন কত লাঞ্ছনা। প্রবলের রক্তচক্ষু শাসনেও তাঁরা অকুতোভয়, নির্ভীক। ত্যাগে ধৈর্যে তাঁরা মানুষের কাছে তুলে দিয়েছেন অমৃতের পাত্র। নিজেরা পান করেছেন জীবনমন্থনের গরল। সেই নীলকণ্ঠ মহামানবের পুণ্য-স্পর্শে সাধারণ মানুষের জীবন ধন্য হয়েছে। যীশু কী অপরিসীম সহনশীলতার প্রতীক! রাজার দুলাল গৌতম বুদ্ধও একদিন জীবনের সভ্য সন্ধান করতে গিয়ে সুখের স্বর্ণ-সিংহাসন থেকে নেমে এলেন পথের ধুলোয়। সেদিনেও কি কপিলাবাস্তুর রাজপুরীতে কত ঝড় উঠেছিল! প্রতিকূলতাকে তিনি জয় করেছিলেন অসীম ত্যাগ আর তিতিক্ষায়। সহিষ্ণুতাই ছিল তাঁর সেদিনের মন্ত্র। এলেন আল্লাহ-প্রেরিত শেষ মুক্তির দূত হযরত মুহম্মদ। সেদিন এই মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত মহাপুরুষের জীবনেও কি দুঃখ-কষ্টের আঘাত কম ছিল! সহনশীলতা মানুষের জীবনকে যে কী পরিমাণে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করতে পারে, এঁদের জীবনই তার প্রমাণ। করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের সমুন্নত মহিমা, সহিষ্ণুতার আদর্শেই প্রোজ্জ্বল। এছাড়া সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান সাধনায়ও মানুষের সহিষ্ণুতার তুলনা নেই। মাক্সিম গোর্কি, দস্তয়েভ্স্কি জীবনে কি কম দুঃখ পেয়েছিলেন? রবীন্দ্রনাথও কি কম নিন্দা-সমালোচনার শরবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন? চরম দারিদ্র্য হতাশার মধ্যেও কত কবি-সাহিত্যিক সুন্দরের আরাধনা করে গেছেন। এমকি কত বিজ্ঞানীকেও বারবার সহিষ্ণুতার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, মাইকেল ফ্যারাডে, লুই পাস্তুর, মাদাম কুরী, নিউটন, আইনস্টাইন- এদের জীবনেও এসেছে কত প্রতিকূলতার আঘাত। মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মতো শিল্পীর জীবনও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে হয়েছে সংক্ষুব্ধ। সহিষ্ণুতার প্রদীপ্ত আদর্শই ছিল তাঁদের সৃষ্টিপ্রেরণা। যুগে যুগে অভিযাত্রীরাও মৃত্যুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন দেশ। দুর্গম পর্বতশিখরে রেখে এসেছেন জয়ের নিশান। সহিষ্ণুতাই তাঁদের অনির্বাণ দীপশিখা। বন্ধুর পথে চলার ধ্রুবতারা।
সহিষ্ণুতা ও দুর্বলতা : সহিষ্ণুতা অন্যায়কে প্রশ্রয়দানের নামান্তর নয়। সহিষ্ণুতায় দুর্বলতার স্থান নেই। চোখের সামনে মানবতার লাঞ্ছনা, অন্যায়-অবিচার প্রত্যক্ষ করেও যে ভীত-সন্ত্রস্ত, প্রতিবাদ করতেও যেখানে কেবলই কুণ্ঠা, সেখানে সহিষ্ণুতা, ভীরুতা কাপুরুষতারই নামান্তর। অন্যায় যে করে সেই শুধু অপরাধী নয়, অন্যায় যে সয় অপরাধ তারও। সহিষ্ণুতা মনুষ্যত্বকে খর্ব করে না। বরং তাকে নতুন প্রাণশক্তিতে দুর্বার করে। সবলের অত্যাচারে দুর্বলের পীড়ন যেখানে সীমাহীন, সেখানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সগর্বে অপরের স্বাধীনতা অপহরণ করে, সেক্ষেত্রে মানুষ যখন প্রতিবাদহীন, ভীরু, নতশির সেখানে সহিষ্ণুতার অর্থ নিশ্চেষ্টতা। আর মানুষের এ নিশ্চেষ্টতা কোনো গৌরব নয়, তার কলঙ্ক।
উপসংহার : সহিষ্ণুতা তাই মানবজীবনের এক দুর্লভ সম্পদ। এই সম্পদের অধিকারী হলেই মানুষের জীবন হয়ে ওঠে সার্থক, হয় পূর্ণতার দীপ্তিতে ভাস্বর। এর অভাবে অসুন্দরেরই নগ্ন প্রকাশ। মানুষ যেদিন সহিষ্ণুতার মূল্য উপলব্ধি করবে, সেদিন ধরার ধূলিতে রচিত হবে স্বর্গে নন্দনকানন। মানুষের জীবনে সত্য হয়ে উঠবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক মহামিলন তীর্থের স্বপ্ন। সহিষ্ণুতার বেদীতলেই যে মানুষের শেষ অর্ঘ্য, তার প্রণতি!