ভূমিকা : মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি- এদের প্রতিটির সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত আমাদের জীবন ও আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের প্রত্যেকের রক্ত, মাংস ও সত্তার পরতে পরতে মিশে আছে মা। আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রকাশের ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। আর জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আমাদের পরম আশ্রয় আমাদের মাতৃভূমি। তাই মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির কথা ভাবলে আমাদের মন উথলে ওঠে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা নত হয়ে আসে। মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমির যে কোনো গৌরবে মন হয় আনন্দে উদ্ভাসিত।
মমতাময়ী মা : সন্তানের কাছে মায়ের আসন অতুলনীয়। মায়ের কাছে সন্তানের ঋণও অপরিশোধ্য। মায়ের দেহসম্পদে ভাগ রসিয়ে মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে মানব শিশু। পৃথিবীর মুখ দেখার পর থেকেই সে লালিত-পালিত হয় মায়ের কোলে, তাঁর স্নেহচ্ছায়ায়। সন্তানকে লালন-পালন করতে গিয়ে মা যে কত ত্যাগ স্বীকার করেন তা কে না জানে। সম্ভাব্য সব বিপদ থেকে তিনি সন্তানকে আগলে রাখেন। সন্তানের অমঙ্গলের আশঙ্কায় সদা-সর্বদা থাকেন উদ্বিগ্ন। তার সামান্যতম বিপদেও হন বিচলিত। কোনো কারণে সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়লে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় মায়ের ঘুম হারিয়ে যায়। সন্তানের শিয়রে বসে দিনরাত চলে নিরলস সেবাযত্ন। সন্তানের অমঙ্গলের কারণ ঘটলে মা হয়ে পড়ে পাগলপ্রায়। অভাবী মা নিজে না খেয়ে তা তুলে দেন সন্তানের মুখে। সন্তানকে দুটো ভালো খাওয়াতে কিংবা পরাতে পারলে তার সুখের সীমা থাকে না। সন্তান বড় হলে, নিজের পায়ে দাঁড়ালে, সুখী হলে মাতৃত্বের সার্থকতায় মায়ের মন ভরে ওঠে। সন্তানের শিক্ষা, দীক্ষা, জীবন ও আচরণ গড়ে ওঠে প্রধানত মায়ের প্রতি সন্তানের মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অবধি থাকে না। সন্তানের কাছে মা তাই সদাসর্বদা স্নেহময়ী, মঙ্গলময়ী জননীমূর্তিতে মহিমাময়ী হয়ে বিরাজ করেন।
মায়ের কাছে সন্তানের কোনো ভেদ নেই। দুঃখ ও যন্ত্রণা সয়ে, দৈন্য ও তুচ্ছতাকে বরণ করে মা হন সর্বংসহা। মায়ের কাছ থেকে আমরা যেমন পাই অনির্বনচীয় ভালোবাসা তেমনি প্রীতি দিয়ে অন্যকে ভালোবাসতে শিখি আমরা। মায়ের ভালোবাসা পেয়ে যেমন আমাদের মনপ্রাণ আনন্দে ভরে ওঠে তেমনি ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীকেও আমরা আনন্দভুবনে পরিণত করতে পারি।
প্রাণের ভাষা মাতৃভাষা : মানুষের অস্তিত্বের আর এক অপরিহার্য ভিত্তি তার মাতৃভাষা। এই ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার শৈশব থেকে ভাব-বিনিময় করতে শেখে। এই ভাষার মাধ্যমেই মাতৃভাষাভাষী সমাজ-পরিমণ্ডলে মানুষ জ্ঞান, শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করে। আবার এই ভাষার মাধ্যমেই সে তার নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়। মানুষের জীবনে ভাষা তথা মাতৃভাষার অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জার্মান মনীষী ভিলহেল্ম্ হুমবোল্ট বলেছেন,
“মানুষের ভাষা হলো তার আত্মা, আর আত্মাই হলো তার ভাষা।”
এ জন্যেই আমাদের দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও মনীষীরা বাঙালি হিসেবে আমাদের জীবনে মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ও বিকাশের দিককে যে-কোনো ভাষার তুলনায় প্রধান গুরুত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালির জাতিগত বিকাশের ধারাকে নস্যাৎ করার জন্যে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলেছিল। উর্দুকে করা হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা। মাতৃভাষার বিরুদ্ধে এ হীন ষড়যন্ত্রকে তখন বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফ্রেব্রুয়ারিতে রক্ত ও আত্মাহুতির বিনিময়ে অর্জন করেছে বিজয়। এমনিভাবে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম প্রদেশের শিলচর স্টেশনে অসমিয়া ও বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে শহীদ হয়েছে ১১ জন বাঙালি। পৃথিবীতে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে এ দুটি আত্মত্যাগের ঘটনা অনন্য ইতিহাস হয়ে আছে।
বিগত ২০০০ সাল থেকে মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এ ঘটনা বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসহ সবার মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক মাইল ফলক।
মাতৃভাষা ও বিদেশিয়ানা : দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের এক শ্রেণির লোকের মনপ্রাণ বিদেশিয়ানায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। মাতৃভাষাকে এরা হেয় জ্ঞান করেন, বিদেশী ভাষাই এঁদের ধ্যান-জ্ঞান। এঁরা মা বলতে লজ্জা পান। মামি, ড্যাডি, আংকল বলাকেই এঁরা অভিজাত্যের লক্ষণ মনে করেন। এঁরা জানেন না যে, বিদেশী ভাষা কখনো তাদের মন ও প্রাণের মুক্তি আনতে পারে না। বিদেশী ভাষায় বড় কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি মধুসূদন। সেই বৃথা স্বপ্নে ব্যর্থতার জন্যে মাইকেলের যে বুকভরা আক্ষেপ ও বেদনা সে ইতিহাস হয়ত এই সব বিদেশ-পাগলরা জানেন না। এরা হয়ত এও জানেন না যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যখন থেকে বিদেশী ভাষার মোহাঞ্জন ও দাসত্ব ঝেড়ে ফেলে মাতৃভাষার চর্চা করেছিল সেদিন থেকেই তাদের জাতীয় জীবনে উন্নতির মুক্ত দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। আসলে এদের জন্যে দুঃখ হয়। কারণ, এঁরা জানেন না যে, দুঃখে-সুখে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। মানি, আধুনিক বিশ্বে নানা কারণে মাতৃভাষা ছাড়াও একাধিক ভাষা শেখার দরকার পড়ে। কিন্তু তা মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া জাতীয় মানসের উন্নতি হতে পারে না- একথা ভুলে গেলে জাতির অকল্যাণ অবধারিত।
জীবন-মরণের আশ্রয় মাতৃভূমি : মা ও মাতৃভাষার মতো মাতৃভূমিও আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য ভিত্তি। মাতৃজঠর থেকে বের হয়ে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখার মুহূর্ত থেকেই মাতৃভূমির মাটিতে আমাদের বেড়ে ওঠা। মাতৃভূমির জল-বাতাসে আমাদের জীবন বাঁচে। মাতৃভূমির নিসর্গ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে আমরা ধারণ করি। ফলে মাতৃভূমির জন্যে আমাদের যে ভালোবাসা তা সহজাত ও স্বাভাবিক। এ ভালোবাসা কোনো কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। এ কেবল ভালোবাসা নয়, এ অন্য রকমের এক বিশ্বাস- ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।’ শুধু কি তাই? ভাবতে আরও ভালো লাগে : ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী।’ অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও গৌরবময়।
মাতৃভূমি বলতে কেবল ভূখণ্ডকে বোঝায় না, তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার প্রাণীগৎ ও তার মানুষকে নিয়েই মাতৃভূমি। তাই মাতৃভূমিকে ভালোবাসার অর্থ তার প্রকৃতি ও জীব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং তার জনসম্পদের উন্নতি সাধন। এ জন্যে চাই মাতৃভূমি যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের অঙ্গ তার প্রতি গভীর আনুগত্য, চাই মাতৃভূমির ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আস্থা ও মমতা, চাই দেশ ও জাতির কল্যাণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও বিধিনিষেধ মান্য করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নাগরিক ভূমিকা পালন। এমন কি চাই দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থে প্রয়োজন হলে আত্মদানের মতো দৃঢ় মনোবল।
উপসংহার : ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুমাত্রই যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সাহায্যে। আমাদের জীবনে এদের দান অপরিসীম, এদের ঋণ অপরিশোধ্য। কৃতজ্ঞ মানুষ কখনো ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এদের অবদানকে ভুলতে পারে না। যে ভোলে তার মতো অকৃতজ্ঞ আর নেই। সত্যিকারের মানুষ মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই ক্ষান্ত হয় না, তার চিন্তা ও কর্মে সর্বদাই স্থান পায় মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির কল্যাণচিন্তা। শ্রম ও মেধা দিয়ে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সেবা করার মাধ্যমেই মানুষ কিছুটা হলেও এদের ঋণ শোধ করতে পারে। তখনই মানুষের জীবন হয়ে ওঠে সার্থক।
nice.
ReplyDelete