বিশ শতকের চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
“আজও আশা করে আছি পরিত্রাণ কর্তা আসবে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে চরম আশ্বাসের কথা শোনাবে পূর্ব দিগন্ত থেকেই। ”
বাংলার ভাগ্যাকাশে সেই ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু। আজীবন মাতৃভাষা প্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্যদৃষ্টান্ত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে।
৬-৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এ সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন,
“পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া ইউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।”
এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন। তিনি এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহুকাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্বদান করেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদ সহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারের দ্বিতীয় দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’। পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার মাসের মধ্যেই পুস্তিকাটির প্রকাশনা ও প্রচার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য পাকিস্তান নামের স্বপ্ন সম্পৃক্ত মােহভঙ্গের সূচনার প্রমাণ বহন করে।
১৫০নং মােগলটুলীর 'ওয়ার্কার্স ক্যাম্প' ছিল সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনকেন্দ্র। ওয়ার্কার্স ক্যাম্প কর্মীরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিকগুলাে জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষের কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়েত হতাে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হতাে। শেখ মুজিব, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও মােগলটুলী বিরােধী রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিব, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতাে নেতারা প্রথমে মােগলটুলীতেই জমায়েত হতেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ােগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। তিনি সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আন্দোলনে শরিক হন। ২ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলাের সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দুজন করে প্রতিনিধি দান করে। এ পরিষদের আহ্বায়ক মনােনীত হন শামসুল আলম। এ পরিষদ গঠনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ছিলেন।
১১ মার্চ ১৯৪৮ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মুজিব নেতৃত্বদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচিতে তিনি এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে, এ হরতাল ও কর্মসূচি তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে। ১১ মার্চের হরতাল সফল করতে ১ মার্চ ১৯৪৮ প্রচার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিবৃতিতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ বিবৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। ১১ মার্চের গ্রেপ্তার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ১১ মার্চের গুরুত্ব এবং গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন,
“রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি গ্রেপ্তার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে।”
১৫ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনকর্মী ও রাজবন্দিদের চুক্তিটি দেখানাে ও অনুমােদন নেওয়া হয়। অনুমােদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিব চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমােদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসি চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মােতাবেক শেখ মুজিব অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। এই চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার এ দেশবাসীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করে। এতে বঙ্গবন্ধু ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
১৬ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন। ১৭ তারিখে দেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ঐ দিনের ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয়সম্পন্ন এবং অসমসাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্রসমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রােত সম্পর্কে যাঁরা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্র নেতাদের মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার বেলায় অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং প্রয়ােজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামারুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী একুশকে নিয়ে ‘কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন:
“শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে। ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।”
জাতীয় নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ভাষা-আন্দোলনের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। তার এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারতাে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর সমর্থন আদায় করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন,
“সে সময় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাঁকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।”
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সােহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিটি ২৯ জুন ১৯৫২ ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ (ইত্তেফাক ১৯৪৯-৫৩ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে থাকলেও ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে এই পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন,
“বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তাে।”
বঙ্গবন্ধুর মতাে দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লেখা ভাষণ পাঠ করেন কামরুদ্দীন আহমদ। এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সে দিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরােভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘােষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও তিনি বাংলা ভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলাে আরাে বার্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
“সে সময় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাঁকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।”
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সােহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিটি ২৯ জুন ১৯৫২ ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ (ইত্তেফাক ১৯৪৯-৫৩ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে থাকলেও ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে এই পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন,
“বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তাে।”
বঙ্গবন্ধুর মতাে দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লেখা ভাষণ পাঠ করেন কামরুদ্দীন আহমদ। এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সে দিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরােভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘােষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও তিনি বাংলা ভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলাে আরাে বার্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন বিকাশে ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সফল, সাধক ও যােগ্য নেতা ছিলেন বলেই ভাষা সমস্যার ভার তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল। এই মহান নেতা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ।
১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬ অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। একই সালের ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে বলেছিলেন,
“পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে।”
পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লােকই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
“রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনাে ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হােক।”
১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়,
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না।”
১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন,
“বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফল।”
এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মহান সুপতির ভূমিকা পালন করে আমাদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশের সুযােগ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদান ঐতিহাসিক প্রয়োজন স্বীকার করতে হবে।
আরো দেখুন :
রচনা : বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন (20 পয়েন্ট) - (Visit eNS)
রচানার পয়েন্ট কোথায়?পয়েন্ট দিলে ভালো হতো
ReplyDeleteএই রচনার কি কোন পয়েন্ট নেই...? থাকলে অবশ্যই জানানোর জন্য অনুরোধ করা গেল
ReplyDeleteei roconar poin takle onek vlo hoto.
ReplyDeleteরচনা কত word এর??
ReplyDelete