ভূমিকা : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। পৃথিবীর যে জাতি যতো বেশি শিক্ষিত সে জাতি ততো বেশি উন্নত। শিক্ষাই পারে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত মানুষ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। আর এ জন্য চাই মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা। কারণ মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই আমরা কেবল শিক্ষার ভালো মান আশা করতে পারি।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা : বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ। এ যুগে পৃথিবী তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রযুক্তি নির্ভর বা কারিগরি মাধ্যমে নয়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। যেমন-
ক. বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা
খ. ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা
গ. মাদ্রাসা মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা (আলীয়া মাদ্রাসা ও কাওমী মাদ্রাসা)
পক্ষান্তরে, আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখব সেখানে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। আর আমাদের দেশে হরেক রকম শিক্ষা ব্যবস্থা। যার কারণে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা ও অসঙ্গতি : বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক আলোচনা হয়েছে এবং শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক দেখা দেয়। তবে সার্বিকভাবে দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করলে এতে অসংখ্য সমস্যা ও অসঙ্গতি চোখে পড়ে। আর এ কারণেই অব্যাহত প্রচেষ্টা আর কর্মসূচির পরও আমরা শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না। দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক এখনো নিরক্ষর। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই শিক্ষার নীতি, পদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা, পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে রয়েছে অসংখ্য সমস্যা আর অসঙ্গতি। তাছাড়া সরকার একমুখী মাধ্যমিক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়ায় এ নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। নিচে বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কতিপয় সমস্যা ও এর সমাধান সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হলো :
১. প্রাথমিক স্তরে সমস্যা ও অসঙ্গতি : যে কোনো জাতির শিক্ষাব্যবস্থার মূলভিত্তি হলো শিশুশিক্ষা। শিশুদের যদি যথাযথ নীতি ও পদ্ধতির আলোকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে জাতি অবশ্যই লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হবে। এক্ষেত্রে জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশের কথা প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের শিশুশিক্ষার নীতি, পদ্ধতি, কৌশল ও ব্যবস্থাপনাসহ সকল ক্ষেত্রেই অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে।
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের অভাব, জরাজীর্ণ বিদ্যালয় ভবন, শিক্ষকদের উদাসীনতা, পাঠ্যবইয়ের সংকটসহ অজস্র সমস্যা লেগেই আছে। আবার কিন্ডারগার্টেনের নামে দেশে যে বিপুল সংখ্যক স্কুল গজিয়েছে এগুলোর সিলেবাস, শিক্ষকদের যোগ্যতা প্রভৃতি আদৌ মানসম্মত ও শিশুশিক্ষার উপযোগী কি-না তা খতিয়ে দেখার যেন কেউ নেই। সুতরাং সমন্বিত শিশু শিক্ষানীতি না থাকায় শিশুরা ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা, বিশ্বাস ও যোগ্যতায় বড় হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় ঐক্য ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করছে।
২. পাঠ্যসূচির সমন্বয়হীনতা : শিক্ষা একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা হয়। এতে শিশু থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার্থীর মননশীলতা, জাতীয় অগ্রাধিকার ও সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনায় সিলেবাস প্রণয়ন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সিলেবাস প্রণয়নে আমরা এখনো ঔপনিবেশিকতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমাদের শিশুদের বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুলে এখনো পশ্চিমা গল্প কাহিনী পড়ানো হয়। আমাদের জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের বিষয়সমূহ যেখানে খুব কম গুরুত্ব পায়। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির দুষ্টচক্র আমাদের শিশুর মস্তিষ্ককেও নানাভাবে বিকারগ্রস্ত করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও ঘন ঘন সিলেবাস পরিবর্তন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কাছে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের কোনো সমন্বিত রূপ তুলে ধরা যাচ্ছে না। ফলে এরা এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর অস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বড় হচ্ছে, যা জাতীয় সংহতি ও উন্নতির সমন্বিত প্রচেষ্টাকে ভণ্ডুল করার ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ভূমিকা পালন করছে।
৩. যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের স্বল্পতা : শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি বহুলাংশে শিক্ষকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা আর আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালনে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও অন্যতম কারণ শিক্ষকদের যোগ্যতার অভাব। বিশেষ করে বেসরকারি কলেজ ও স্কুলগুলোতে যে নিয়োগ পদ্ধতি রয়েছে তাতে অনেক অযোগ্য লোকও ডোনেশন, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিক প্রভাব-প্রতিপত্তির বলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে। অন্যদিকে একসময় শিক্ষকতা সম্মানজনক বলে বিবেচিত হলেও বর্তমানে এর প্রতি মেধাবী ছাত্রদের আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষকদের যে বেতন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা তাতে মেধাবী লোকদের এর প্রতি আগ্রহ না থাকারই কথা। তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ইংরেজি, গণিত ইত্যাদির শিক্ষক পাওয়া যায় না।
৪. নকল প্রবণতা : পরীক্ষায় নকল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি দুরারোগ্য ব্যাধি। এ ব্যাধির ফলে ছাত্র-শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জাতি অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। বর্তমানের এ নাজুক অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রের নানা অব্যবস্থাপনা আর রাজনীতির দুষ্টচক্র এ ব্যাধিকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে রূপ দিয়েছে। সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষার প্রতি অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা মূলত নকলের ব্যাপকতার জন্য দায়ী। পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবও এক্ষেত্রে বিরাটভাবে দায়ী। এক্ষেত্রে সরকারকে প্রশাসনের বিরুদ্ধে বা রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তবে সম্প্রতি সরকার এ ব্যাপারে বেশ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং গত কয়েকটি পরীক্ষায় নকল প্রতিরোধে সরকার সফলও হয়েছে।
৫. প্রশ্নপত্র ফাঁস : প্রশ্নপত্র ফাঁস আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। গত কয়েক বছর আগেও এই সমস্যা মারাত্মক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল। একটি দুষ্টচক্র এর সাথে জড়িত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রশ্নপত্র কিছু ক্ষেত্রে উত্তর সহ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রশ্ন পত্র ছাড়াও ফাঁস হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও। কিন্তু সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপে গত কয়েকবছর কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
৬. পাঠ্যপুস্তকের স্বল্পতা : প্রয়োজনীয় বই তথা পাঠ্যপুস্তকের সংকট আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির যে সকল বই বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলোর নিম্নমান, বানান ও তথ্যগত ভুল, যথাসময়ে বিতরণ না হওয়া ইত্যাদি সমস্যা প্রতি বছরই দেখা যায়। তবে বর্তমান সরকার প্রাথমিক শ্রেণির মতো মাধ্যমিক শ্রেণির বইও বিনামূল্যে বিতরণ করছে এবং বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার সাফল্য দেখিয়েছে। অন্যদিকে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কথা বলা হলেও উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলায় মানসম্মত বই বেশ দুর্লভ। একদিকে বাংলা বইয়ের সংকট অন্যদিকে ইংরেজির দুর্বলতা- এ দ্বিবিধ কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অনেকক্ষেত্রেই ব্যাহত হয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক মান উন্নয়নে করণীয় : শিক্ষার উন্নতি ও উন্নয়নে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বহু শিক্ষা কমিশন গঠন হলেও প্রকৃতার্থে শিক্ষার উন্নয়ন হয়নি। তথাপি প্রচেষ্টা থেমে নেই। প্রতিটি সরকারই আপন আপন দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি :
১. প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সিলেবাসের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন জরুরি। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে তা অত্যাবশ্যক। হঠাৎ করে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পর্যায়ে উন্নত সিলেবাস প্রণয়ন করলেও তা ছাত্রছাত্রীরা কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারছে কিনা সে বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।
২. দেশে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সমন্বয় সাধন অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা শিক্ষার সমন্বয় সাধন জরুরি।
৩. প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ইংরেজি শিক্ষার ওপর জোর দেয়া আবশ্যক। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনাকে বাধ্যতামূলক করা উচিত।
৪. শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা আবশ্যক। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে না পারলে যত ভালো সিলেবাসই হোক না কেন তা ফলপ্রসূ হবে না।
উপসংহার : আমাদের জাতিকে শিক্ষিত করে একটি উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সচেতনতা ছাড়া কেবল পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।