রচনা : স্কুল-জীবনের স্মৃতি

↬ স্কুল জীবনের সুখ-দুঃখ


ভূমিকা :
‘হিজলের তাল বুনো ঘাস গুল্ম লতার ঝোপে, 
কাশ বন, বাঁশ ঝাড় ভরা ভাদরের নদী কূলে 
ফেলে এসেছি শৈশব আনমনে কোন এক কালে 
হারিয়ে ফেলেছি গোধূলি লগ্ন মঙ্গল ধূপে। 
ফিরে পাব কি শিশির ভেজা সোনালী দিন?’ 
দূর অতীতকে জীবন্ত করে বর্তমানকে ভুলিয়ে দিতে চায় স্মৃতি। গতিময় জীবনে সামনে ক্রমাগত এগিয়ে চলার সময় পেছন ফিরে তাকাতে ভাল লাগে। ভাল লাগে অতীতের স্মৃতিচারণ করতে। স্মৃতিচারণে যে অধ্যায়টি আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তা হল আমার স্কুলজীবন। স্কুলজীবনের স্মৃতি আমার জীবনের অনেক খানি জায়গা জুড়ে আছে। স্মৃতিটুকু আছে আনন্দের উৎস হয়ে। তাই সব ভোলা যায়, স্কুলজীবনের স্মৃতি ভোলা যায় না, সে বড় মধুর চির স্মরণীয়। 

জীবনের বৈশিষ্ট্য : জীবনের দিনগুলো কখনও এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকে না। এগিয়ে যাওয়াই জীবনের বৈশিষ্ট্য। সেই কোন অতীতে একদিন দুরু দুরু বুকে প্রকৃতির বিচিত্র লীলানিকেতন হিজলতলী গ্রামের এক অখ্যাত বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম, আজ তা স্মৃতি হয়ে মনের কোণে ভেসে আছে। তারপর আনন্দ বেদনায় মুখরিত কত শত দিন চলে গেছে, তবু মনে হয় বুঝি এই সেদিন বাড়ি থেকে স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। 

স্কুলের কথা : স্মৃতিতে অস্পষ্ট হলেও আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে ‘বৃহৎ ধারাপাত’, ‘আদর্শলিপি ও বানান শিক্ষা’র সঙ্গে সদ্য কেনা শ্লেট নিয়ে আব্বার সঙ্গে স্কুলে গিয়েছি। ভর্তি করে দিয়ে স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত আব্বা বসে ছিলেন স্কুল লাইব্রেরিতে। ছুটি শেষে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন, কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে গেলেন। সে কি মধুর স্মৃতি তা কি কখনো ভুলা যায়? 

বাড়িতে প্রথম পাঠের স্মৃতি আমার এখনও মনে আছে। অ-তে অজগর : অজগরটি আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে ইত্যাদি। দাদা-দাদী, নানা-নানু আদর আর মায়ের আদরমাখা বকুনি কিংবা মুখে মুখে ছড়া কেটেছি আর সহপাঠীদের নিয়ে খেলার আসর জমিয়েছি, 
‘ওপেনটি বায়স্কোপ 
রায়টেনে টেলেস্কোপ 
চুলটানা বিবিয়ানা 
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা......’ 
এসব স্মৃতির কথা বলে শেষ করা যায় না। 

হাই স্কুলে ভর্তি : একদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে আবার হিজলতলী হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। নতুন স্কুলে বৃহত্তর পরিবেশে এসে আমি যেন এক বড় জগৎ দেখতে পেলাম। শ্রেণীর বিন্যাসের প্রেক্ষিতে ছোট বড় শিক্ষার্থীর কলকাকলিতে মুখরিত শিক্ষাঙ্গন যেন আমাদের নিয়ে এসেছে বৃহত্তর পরিবেশে। এখানে শৃঙ্খলা, নিয়মকানুন, নিয়মিত ক্লাস, ঘন ঘন পরীক্ষা, সহপাঠ্যক্রম কার্যক্রম যেন এক নতুন জীবনের সন্ধান দিল। প্রথম প্রথম নতুন পরিবেশে অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। পরে এর কল্যাণকর দিক আমাকে অভিভূত করতে থাকে। পরিণতিতে আমার মনে হয়েছে বাড়ি থেকে স্কুলই আমার জন্য বেশি আনন্দের। 

শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা : হাই স্কুল জীবনের শুরু থেকেই প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা দেখাতে সমর্থ হয়েছিলাম। এ দুটি গুণের জন্য বিদ্যালয়ের মধ্যে অচিরেই আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেক শিক্ষকের স্নেহ ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টির কথা আজও আমার মনে পড়ে। আমার স্কুল জীবন যে কত সুখের, কত গৌরবের ছিল, তা আজ স্কুল ছেড়ে এসে বুঝতে পারছি। 

স্কুলের পরিবেশ ও লেখাপড়ার স্বাধীনতা : আমাদের বিদ্যালয়টি ছিল অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা। একটা মুক্ত ও প্রকৃতির আনন্দময় পরিবেশে আমরা লেখাপড়া করতে পেরেছি। লম্বা স্কুল ভবন, বিশাল মাঠ, মাঠের পাশ দিয়ে বাঁধানো সড়ক চলে গেছে শহরের দিকে। একটা উন্মুক্ত পরিবেশ আমাদের সব সময় উৎফুল্ল করে রাখত। আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণ যে যত্নশীলতায় পাঠ দিতেন তা ছিল আমাদের জন্য পরমানন্দের। শিক্ষকগণ সংখ্যায় ছিলেন অনেক। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক হিসেবে তাঁরা আমাদের প্রত্যেকের নাম জানতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এখানে যেন একটি বৃহৎ পরিবার জীবন গঠনে নিয়োজিত। পাঁচ বছর এখানে আমার অতিবাহিত হয়েছে। শিক্ষকদের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি, ছাত্রদেরও না। তবে বছরের শেষে ব্যর্থতার জন্য যারা বিদায় নিয়ে গেছে তারা আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষককে আমরা খুবিই ভয় করতাম। তাঁর কক্ষের কাছাকাছি যেতে আমাদের সাহস হত না। শ্রেণী শিক্ষকরা ছিলেন খুব যত্নশীল। প্রত্যেকটি বিষয় তাঁরা এমন মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন যে, ক্লাসের পর আমাদের কোন কোচিং সেন্টারে ছুটতে হত না। কারও বুঝতে অসুবিধে হলে অনেক সময় শিক্ষকগণ পৃথকভাবে পড়াবার ব্যবস্থা করাতেন। গৃহশিক্ষকতার বাহুল্য অত্যাচার থেকে আমরা ছিলাম মুক্ত। বাড়িতেও আমার কোন বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। স্কুলের কাজগুলো শেষ করাই আমার একমাত্র কর্তব্য ছিল। এতে আমি প্রচুর আনন্দ পেতাম। 

মেলামেশায় স্বাধীনতা : আমার স্কুল জীবনে গৃহে যতটুকু স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তাতে আমার যথেষ্ট উপকার হয়েছে। আজাকাল আমরা ঘরে-বাইরে তাড়া খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি। ষষ্ঠ শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আমি ঐ একই স্কুলে পড়েছি। এ পাঁচ বছরের মধ্যে আমি অনেকের সাথে মিশেছি। বাঙালি, অবাঙালি বহু ছাত্রের সাথে প্রাণ খুলে কথাও বলেছি। তাদের চালচলন, রীতিনীতি ও মনোভাব শিক্ষা করেছি। আমার ঐ স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতাই আমাকে উন্নতির পথে এগিয়ে দিয়েছে। তখন ইচ্ছা ছিল, প্রবৃত্তি ছিল। অনুসন্ধিৎসু ও জিজ্ঞাসু মনে যখন যা উদিত হয়েছে, তাই জেনেছি; তার ফলে আজ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের সাথে মিশতে অসুবিধা বোধ করি না। 

পুরস্কার বিতরণী : স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উৎসবের উদ্যোগ আয়োজনে আমরা যোগ দিয়েছি পরম উৎসাহে। আবৃত্তি-অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছি। সেদিনটা কাটত আনন্দ-কোলাহলে, আমোদ-কৌতুকে। এ দিনটিতে বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্যও পুরস্কার দেয়া হত। আবার আচরণে সর্বোত্তম ছাত্রের জন্যও পুরস্কার থাকতো। আমি তেমন কোন পুরস্কার না পেলেও অন্তত সর্বোত্তম ভাল আচরণের জন্য পুরস্কার পেতাম। তার সাথে ভাল ফলাফলের পুরস্কারটিও আমার হাত ছাড়া হত না। 

বিদ্যালয়ের স্মৃতি : যেদিন শেষ পরীক্ষা দিযে স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম, মনটা ভারি হয়ে উঠল। মনে হল-জীবনের এক অধ্যায় সমাপ্ত করে দ্বিতীয় অধ্যায়ে পা দিতে চলেছি; কিন্তু স্কুল জীবনের স্মৃতি সারাজীবন আনন্দের উৎস হয়ে থাকে। জীবনের বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র সামনে পড়ে আছে। কত না বিচিত্র অভিজ্ঞতা জীবনে ভীড় করবে। কিন্তু হিজলতলী বিদ্যালয়ের সেই স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো কখনও ভুলবার নয়- 
‘মনে পড়ে যায় 
কত স্মৃতি হায় 
মধুর জীবন’ 

উপসংহার : স্কুল জীবনের হাসি-কান্না সবই মাধূর্যমণ্ডিত। পরিণত বয়সে সকলে এ জীবনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দ লাভ করে। বাল্যজীবনের অনাবিল আনন্দ অতুলনীয়। আমার স্কুল জীবন বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল। ঐ জীবনে নবীন প্রাণে কত আঘাত পেয়েছি। অভাবের তাড়না, শোকের আঘাত, ব্যাধিক আক্রমণ জীবনকে নিরানন্দ করে তুলেছে। তথাপি আমার নিকট সেগুলো তুচ্ছ বলে মনে হয়েছে। শত আঘাত, অভাব-অভিযোগ কাটিয়ে জীবনে কত আনন্দই না আমি উপভোগ করেছি। তাই আজ স্কুল জীবনের কথা স্মরণ করলে হৃদয়ে-বেদনার অনেক ছায়া জেড়ে ওঠে- 
‘বিস্মৃতির অতলে স্মৃতিভাণ্ডার রইবে অম্লান চিরদিন।’



আরো দেখুন :

3 Comments

  1. খুব সুন্দর লিখেছেন

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো

    ReplyDelete
  3. Nijer school jiboner kotha mone pore galo 😌

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post