ভূমিকা :
মাতৃভাষায় কথা বলে কিংবা মনের ভাব প্রকাশ করা যত সহজ অন্য ভাষায় সেটা তত সহজ নয়। মাতৃভাষা যেমন প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অবলম্বন, তেমনি চিন্তা চেতনা, জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনার মাধ্যম হিসেবেও এর কোনো বিকল্প নেই। তাই দেখা যায় মাতৃভাষায় জ্ঞানানুশীলন ব্যতীত বিশ্বে কোনো জাতিই উন্নতি লাভ করতে পারে নি।
বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা : মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই প্রকৃতপক্ষে দেশের মানুষের চিৎশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, সৃষ্টি-শক্তি ও কল্পনা-শক্তির যথার্থ বিকাশ সম্ভব। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য- ‘আমাদের মন তেরো চৌদ্দ বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে, সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশি ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্ত বিদ্যার শিলাবৃষ্টি বর্ষণ হইতে থাকে, তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কী করিয়া।’ তাই শিক্ষা যেখানে মানুষের সহজাত অধিকার, সভ্যতার ক্রমাগ্রগতির অনিবার্য অঙ্গীকার, সেখানে কৃত্রিমতার কোনো অবকাশ নেই। ‘কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে হইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চির পরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়।’ নানা কারণে অন্য যে কোনো ভাষার চেয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজন স্বীকৃত :
১। প্রতিদিনের ভাবের আলাপ, সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, আনন্দ-বেদনার প্রকাশ মাতৃভাষায়। তাই মাতৃভাষা মনোভাব প্রকাশে যত উপযোগী অন্য ভাষা তত নয়।
২। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা সহজেই যে বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারে। মাতৃভাষায় কোনো ভাব যত সহজে বোঝা যায়, তা আর কোনো ভাষায় সম্ভব নয়, অপরপক্ষে, মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার সহজবোধ্যতার ভিত্তি নেই। পরভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক শক্তির যথেষ্ট অপচয় হয়।
৩। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় জ্ঞানার্জন করতে গেলে বিষয় ও বাহন উভয়ের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করতে দিয়ে বিদ্যার্জনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বিনা পরিশ্রমে কোনো ভাষা শুদ্ধভাবে বলা বা লেখা কোনোটাই সম্ভব নয়। বিদ্যার মাধ্যম আয়ত্তের জন্য সময়েরও অপচয় হয় প্রচুর। যে ব্যক্তিক, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে ক্ষতিকর।
৪। দেশ-কালের সঙ্গে ইতিহাস ঐতিহ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে যোগ রয়েছে তার সঙ্গে গভীর মেলবন্ধন রচনা করতে পারে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা।
৫। স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা গড়ে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে। বিদেশি ভাষার আধিপত্য মনোজগতে বিদেশমুখিতা ও পরানুকরণ প্রবৃত্তির জন্ম দেয়।
৬। মায়ের সাথে, মাটির সাথে, দেশের সাথে, প্রকৃতির সাথে যোগসূত্র গড়তে হলে প্রয়োজন মাতৃভাষার।
৭। দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য তথা সমৃদ্ধশালী করতে হলে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
৮। সবচেয়ে বড় কথা মাতৃভাষা মায়ের ভাষা, স্বদেশী ভাষা- মাতৃভাষার চেয়ে সহজ অন্য কোনো ভাষা হতে পারে না, কারণ জন্মের পর থেকে এই ভাষার আশ্রয়ে ও পরিমণ্ডলেই একজন বড় হয়ে ওঠে। সুতরাং মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই।
তাই সাম্প্রতিকালে কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই মাতৃভাষার ব্যাপক ব্যবহারের প্রচেষ্টা চলছে। বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হউক এটা সকলেরই কাম্য। কিন্তু ইচ্ছা করলেই যে তা সফল করার পথটি অত্যন্ত দুরূহ। তাই বাংলার মাধ্যমে আমাদের দেশে শিক্ষাদীক্ষা সম্প্রসারিত হোক বলে আমরা যতই দাবি করি না কেন তার মতো একটা দুরূহ বিষয়কে বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া ততটা সহজ নয়।
বিদেশি ভাষার অসুবিধা :
মাতৃভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করা যত সহজ অন্য ভাষায় সেটা তত সহজ নয়। মাতৃভাষা সহজাত আপন ভাষা অন্য ভাষা পরের ভাষা। বিদেশি ভাষা শেখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মাতৃভাষা যেমন প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অবলম্বন, তেমনি চিন্তা- চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার মাধ্যমে হিসেবেও এর কোনো বিকল্প নেই। তাই দেখা যায় মাতৃভাষায় জ্ঞানানুশীলন ব্যতীত বিশ্বে কোনো জাতিই উন্নতি লাভ করতে পারে নি। ইংরেজরা যেদিন ফরাসি ভাষাকে মাতৃভাষার ওপরে স্থান দিয়েছিল তখন সে দেশের সাহিত্যের স্ফুরণ হয় নি। স্ফুরণ হয়েছিল যেদিন জেম্স্ মাতৃভাষায় পবিত্র বাইবেলের অনুবাদ করে দেশের মানুষের বাইবেল ও মাতৃভাষা উভয়কেই অসীম মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করলেন। রাশিয়াও মাতৃভাষাকে স্বীকার করেই জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্যের গৌরবময় অগ্রগতির পথে বিশিষ্ট মর্যাদায় চিহ্নিত হয়েছে। প্রাচ্যের জাপানও একদিন প্রতীচ্যের শিক্ষা-ধারাকে গ্রহণ করেছিল। সেদিন তার অগ্রগতি ছিল কুণ্ঠিত। তারপর মাতৃভাষার মাধ্যমেই তারা গৌরবময় অগ্রগতির পথে এগিয়ে গেছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা : বর্তমান বিশ্বে ইংরেজি ভাষা ছাড়া আরও বহু ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছে এবং তাতে অপরিসীম সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের অনেকগুলো উন্নত দেশ মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা করে যে সাফল্য অর্জন করেছে তাতে আমাদেরও উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, ড. কুদরত-ই-খুদা, ড. আবদুল্লাহ-আল মুতী প্রমুখ অনেকেই বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিষয় রূপ দিয়েছেন। বাংলা একাডেমী ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ বাংলায় প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হওয়ার ফলে বাংলায় শিক্ষাদানের যে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তার পরিণতিতেই যথেষ্ট সংখ্যক বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ বাংলায় রচিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সমস্যা : এক কথায় বলা চলে পরিভাষার অভাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রধান অন্তরায়। কারণ বিজ্ঞানবিষয়ে এমন অনেক শব্দ রয়েছে যার বাংলায় অর্থ করা কঠিন এবং আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষায় বিজ্ঞান চর্চা হওয়ায় সে সব শব্দের বাংলারূপ লিখতে গেলে শিক্ষার্থীরা হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারবে না। তবে উপযুক্ত পরিভাষা সৃষ্টি করে নিতে পারলেই এই অসুবিধার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। পরিভাষা সৃষ্টির কাজ দুরূহ কিছু নয়। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কিছুটা কাজ হয়েছে। তবে পরিভাষা সৃষ্টির নামে বিলম্ব করা অনুচিত। এমন সময় একদিন আসবে যখন বহুল ব্যবহারের ফলে পরিভাষার একটা রূপ দাঁড়িয়ে যাবে। বিদেশি ভাষার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের শিক্ষার ফলে যে মানুষিকতার সৃষ্টি হয়েছে, তাও পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলা ভাষাও যে এর উপযোগী একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। শুধু বিশ্বাস করলে চলবে না ব্যবহার ও প্রয়োগে তার সার্থকতা ফুটিয়ে তুলতে হবে। সে যাই হউক এতকাল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা ভাবাও হয় নি, চর্চাও হয় নি। এখন এ দেশের বিজ্ঞজনেরা এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে এবং এর ফলও তাঁরা পাচ্ছেন।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা : মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এখন আর কারো দ্বিমত নেই। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা করলে সহজেই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি স্বল্পশিক্ষিত লোকেরাও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সহজেই আয়ত্ত করতে পারবে এবং এর সুফল কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবে। এর জন্য প্রয়োজন স্কুল, কলেজে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা করা। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা করতে হলে উপযুক্ত বইয়েরও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান-বিষয়ক গ্রন্থ তেমন রচিত হয় নি। এই ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে এই অসুবিধে দূর করতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে বাংলা ভাষা দীনহীন নয় এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনও তেমন কঠিন নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে তার সাথে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বিদেশি ভাষায় লব্ধ জ্ঞান যদি বাংলায় প্রচার করা না যায়, তাহলে জাতীয় জীবনে দীনতা দেখা দিবে।
উপসংহার : জীবন ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করার একমাত্র পথ হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান। শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ দান হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ সাধন। আর এ জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানই হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি।
Fatafati
ReplyDeletejust wow !
ReplyDelete