সারাংশ (১ থেকে ৫০)
সারাংশ (৫১ থেকে ১০০)
সারাংশ (১০১ থেকে ১৫০)
সারাংশ (১৫১ থেকে ২০০)
১০১
বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা মায়াচ্ছন্ন নবমানবের অভিনব জয়যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ;শতাব্দীর নবযাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণস্তুপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা নব-অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বাররুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে।
সারাংশ : বয়স কম বা বেশি যা-ই হোক না কেন যারা রক্ষণশীল তারাই বৃদ্ধ। সমাজের প্রগতিকে তারা গ্রহণ করতে চায় না। সমাজের কল্যাণকে যে এরা শুধু ভয় পায় তা-ই নয়, সমাজের কল্যাণের পথে তারা নিজেরাও এক বিরাট বাধা।
১০২
বাল্যকাল হইতেই আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা নিতান্ত আবশ্যক, তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনো মতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না। আহারাদি রীতিমতো হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার। তেমনি একটা শিক্ষা পুস্তককে রীতিমতো হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্য আবশ্যক। আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিতে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। গ্রহণশক্তি, চিন্তা বেশ সহজ স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি পায়।
সারাংশ : শিক্ষার সাথে আনন্দের সংস্পর্শ না থাকলে সে শিক্ষা হৃদয়কে বিকশিত করতে পারে না। তাই হৃদয়ের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য পাঠ্য-পুস্তকের পাশাপাশি চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিকারী ও আনন্দদায়ক পুস্তক পাঠ করা অত্যাবশ্যক।
১০৩
বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষায় সামান্যতা বা উচ্চতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা এবং স্পষ্টতা। যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে এবং পড়িবামাত্র যাহার অর্থ বুঝা যায়, অর্থগৌরব থাকলে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা। তাহার পর ভাষার সৌন্দর্য। সরলতা এবং স্পষ্টতার সহিত সৌন্দর্য মিশাইতে হইবে। অনেক রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দর্য, সে স্থলে সৌন্দর্যের অনুরোধে শব্দের একটু অসাধারণতা সহ্য করিতে হয়। প্রথমে দেখিবে তুমি যাহা বলিতে চাও, কোন ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হয়। যদি সরল প্রচলিত কথাবার্তার ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট ও সুন্দর হয় তবে কেন উচ্চ ভাষার আশ্রয় লইবে? যদি সে পক্ষে টেকচাঁদী বা হুতোমী ভাষায় সকলের অপেক্ষা কার্য-সুসিদ্ধ হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিবে। যদি তদপেক্ষা বিদ্যাসাগর বা ভুদেববাবু প্রদর্শিত সংস্কৃতবহুল ভাষায় ভাবের অধিক স্পষ্টতা ও সৌন্দর্য হয়, তবে সামান্য ভাষা ছাড়িয়া সেই ভাষার আশ্রয় লইবে। যতি তাহাতেও কার্যসিদ্ধ না হয়, আরও ওপরে উঠিবে, প্রয়োজন হইলে তাহাতেও আপত্তি নাই, নি®প্রয়োজনেই আপত্তি।
সারাংশ : স্পষ্টতা, সরলতা এবং অর্থময়তা রচনার অন্যতম প্রধান গুণ। এগুলোর পরই গুরুত্ব দিতে হয় ভাষার সৌন্দর্যের ওপর। যে ভাষায় মনের ভাব সহজে ব্যক্ত হয় সে ভাষাই রচনায় ব্যবহার করা উচিত। ভাষার আড়ষ্ঠর নয়, বিষয় উপযোগী ভাষাই রচনাকে সার্থক করে তোলে।
১০৪
বিদ্যা মঙ্গলের নিদান সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু অল্প বিদ্যা মারাত্মক। সংসারে প্রত্যেক ব্যক্তিরই আপনার যথার্থ মূল্য বুঝিয়া চলা উচিত। যে ব্যক্তি যে বিষয়ে বিশেষরূপে দক্ষ নহে, তাহার পক্ষে সেই কার্যে হস্তক্ষেপ অবিধেয়। যে ব্যক্তি অর্ধশিক্ষিত, সুশিক্ষিতের ভান করা তাহার অনুচিত। কেননা ইহাতে সে যে কেবল আপনার ক্ষতি করে তাহা নহে; তাহার এইরূপ আচরণের দ্বারা সমাজেরও বিষম অনিষ্ট সাধিত হয়। হাতুড়িয়া বৈদ্যগণ প্রকৃত চিকিৎসক নহে, চিকিৎসাশাস্ত্রে তাহাদের অতি অল্প জ্ঞানই থাকে। কিন্তু তাহা তাহারা নিজেরাও বুঝে না বা বুঝিলেও অপরের নিকট স্বীকার করে না। সুতরাং তাহারা কোনো সুচিকিৎসকের ভান করিয়া যদি সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসার ভার গ্রহণ করে তবে ঐ রোগীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাহারা সমাজের অজ্ঞ লোকদিগকে প্রতারিত করিয়া উহাদের ভীষণ ক্ষতিসাধন করে। তাহাদের এই কার্যের জন্যে চিকিৎসাবিদ্যা দায়ী নহে, দায়ী তাহাদের চিকিৎসাবিদ্যার অল্প জ্ঞান।
সারাংশ : বিদ্যা মুল্যবান এবং মঙ্গলজনক হলেও অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। অল্প বিদ্যা নিয়ে কোনো কাজে হাত দেওয়া উচিত নয়। কেননা, এতে বড় ধরনের ক্ষতি সাধিত হতে পারে।
১০৫
বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন, মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা, সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই।
সারাংশ : মানব অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত থাকে না। জগৎ, জীবন ও জাতির কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন সার্থক হয়ে ওঠে।
১০৬
বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু চরিত্র তদপেক্ষাও মূল্যবান। অতএব, কেবল বিদ্বান বলিয়াই কোনো লোক সমাদর লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। চরিত্রহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় আপনার জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করিয়াও থাকে, তথাপি তাহার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। প্রবাদ আছে যে, কোনো কোনো বিষধর সর্পের মস্তকে মণি থাকে। মণি মহামূল্যবান পদার্থ বটে, কিন্তু তাই বলিয়া যেমন মণিলাভের নিমিত্ত বিষধর সর্পের সাহচর্য লাভ করা বুদ্ধিমানের কার্য নহে, সেইরূপ বিদ্যা আদরণীয় হইলেও বিদ্যালাভের নিমিত্ত বিদ্বান দুর্জনের নিকট গমন বিধেয় নহে।
সারাংশ : বিদ্যা মূল্যবান সম্পদ হলেও চরিত্রের মূল্য তার থেকে বেশি। চরিত্রহীন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তার সঙ্গ পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ তার সংস্পর্শে সাধু ব্যক্তির চরিত্রও নষ্ট হতে পারে।
১০৭
ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই হলো জ্ঞানীর কাজ। পিঁপড়ে-মৌমাছি পর্যন্ত যখন ভবিষ্যতের জন্যে ব্যতিব্যস্ত, তখন মানুষের কথা বলাই বাহুল্য। ফকির-সন্ন্যাসী যে ঘরবাড়ি ছেড়ে, আহার-নিন্দ্রা ভুলে, পাহাড়-জঙ্গলে চোখ বুজে বসে থাকে, সেটা যদি নিতান্ত পঞ্জিকার কৃপায় না হয়, তবে বলতে হবে ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে কোনো লাভ নেই। সমস্ত জীব-জন্তুর দুটো চোখ সামনে থাকবার মানে হলো ভবিষ্যতের দিকে যেন নজর থাকে। অতীতের ভাবনা ভেবে লাভ নেই। পন্ডিতেরা তো বলে গেছেন, ‘গতস্য শোচনা নাস্তি।’ আর বর্তমান সে তো নেই বললেও হয়। এটা যেটা বর্তমান সেই-এই কথা বলতে বলতে অতীত হয়ে গেল। কাজেই নদীর তরঙ্গ গণনা আর বর্তমানের চিন্তা করা সমানই অনর্থক। ভবিষ্যতের মানব কেমন হবে সেটা একবার ভেবে দেখা উচিত।
সারাংশ : ভবিষ্যতের ভাবনাই জীবনে সুফল বয়ে আনে, অতীত অথবা বর্তমানের ভাবনা নয়। আর এই ভবিষ্যতকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার জন্য প্রয়োজন নিখুঁত কর্মপরিকল্পনা।
১০৮
মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল, কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমন্ত শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সে নীরব মহাশব্দের সহিত এই পুস্তকাগারের তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর অগ্নি কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কালো চামড়ার কারাগারে বেড়া দগ্ধ করিয়া একবার বাহির হইয়া আসে। কালের শঙ্খরন্ধ্রে এই নীরব সহস্র বৎসর যদি এককালে ফুৎকার দিয়া উঠে তবে সে বন্ধনমুক্ত উচ্ছ্বসিত শব্দের স্রোতে দেশ-বিদেশে ভাসিয়া যাইত। হিমালয়ের মাথার ওপরে কঠিন তুষারের মধ্যে যেমন শত শত বন্যা বাঁধা পড়িয়া আছে, তেমনি এই পুস্তকাগারের মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখা হইয়াছে।
সারাংশ : গ্রন্থাগার হলো জ্ঞানের এক নীরব মহাসমুদ্র। হাজার বছরের জ্ঞান ও মানবহৃদয়ের আবেগ, উচ্ছ্বাস বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়ে গ্রন্থাগারে রক্ষিত হয়।
১০৯
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী। জগতের অন্যান্য প্রাণীর সহিত মানুষের পার্থক্যের কারণ- মানুষ বিবেক ও বুদ্ধির অধিকারী। এই বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান নাই বলিয়া আর সকল প্রাণী মানুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন করিয়া মানুষ জগতের বুকে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করিয়াছে, জগতের কল্যাণ সাধন করিতেছে; পশুবল ও অর্থবল মানুষকে বড় বা মহৎ করিতে পারে না। মানুষ হয় জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের বিকাশে। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের প্রকৃত বিকাশে জাতির জীবন উন্নত হয়। প্রকৃত মানুষই জাতীয় জীবনের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন আনয়নে সক্ষম।
সারাংশ : বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। জ্ঞান ও মনুষ্যত্ববোধের মাধ্যমে মানুষ সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে জগতের কল্যাণসাধন করছে। জাতীয় উন্নতির জন্যও এই জ্ঞান ও মনুষ্যত্ববোধই প্রয়োজন, অর্থবল বা পেশীশক্তি নয়।
১১০
মানুষের জীবনে ভাষার স্থান যে কত বড় তা আমরা খুব কমই ভেবে থাকি। আমরা যেমন খাই-দাই, ওঠা-বসা করি ও হেঁটে বেড়াই, তেমনি সমাজজীবন চালু রাখবার জন্যে কথা বলি, নানা বিষয়ে নানাভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিকতা বজায় রাখতে হলে তার প্রধান উপায় কথা বলা, মুখ খোলা, আওয়াজ করা। একে অন্যের সঙ্গে সম্বন্ধ যেমনই হোক না কেন শত্রুতার কী ভালোবাসার, চেনা কী অচেনার, বন্ধুত্বের কিংবা মৌখিক আলাপ-পরিচয়ের, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে কোনো সম্বন্ধ স্থাপন করতে গেলেই মানুষমাত্রকেই মুখ খুলতে হয়, কতকগুলো আওয়াজ করতে হয়। সে আওয়াজ বা ধ্বনিগুলোর একমাত্র শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো অর্থবোধক হওয়া চাই।
সারাংশ : মানবজীবনে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অপরের সাথে সম্পর্ক গড়া এবং তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন ভাষার। ভাষা বলতে কেবল মুখনির্গত কতগুলো আওয়াজ বা ধ্বনিকে বোঝায় না, ভাষা বলতে বোঝায় অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনির সমষ্টি।
১১১
মানুষের এক বড় সৃষ্টি তার সাহিত্য। তার বৈচিত্র্যময় জীবনের অন্তধারা দিয়ে মানুষ সাহিত্যের নানা শাখাকে রসে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। যুগ যুগ ধরে মানুষের মনোরাজ্যের লীলা খেলার কল্পলোকের বিচিত্র সূর ধ্বনিত হয়েছে। সাহিত্য সৃষ্টির গোড়া মানুষের চিন্তারাজ্যের এই যাত্রা রুদ্ধ হতে পারে না। যেখানে যে মানুষের মধ্যে এই চিন্তার স্রোতে রুদ্ধ হয়ে এসেছে, সেখানে তার জীবনও স্থবির হয়ে এসেছে। গতিহীন যে স্রোত সম্মুখে অগ্রসর হতে পারে না তার অকালমৃত্যু অনিবার্য।
সারাংশ : সাহিত্য মানুষের এক অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। যুগ যুগ ধরে সাহিত্য মানুষের মনকে অবলম্বন করে হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। মনের স্বাভাবিক গতি যদি রুদ্ধ হয় তবে সেই মনের মৃত্যু ঘটে। আর রূদ্ধ হওয়া মনে সাহিত্য তার খোরাক খুঁজে পায় না।
১১২
মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দিত হয়ো না। স্বভাবে সে সুন্দর নয়, দেখতে সুন্দর হলেও তার স্বভাব, তার স্পর্শ, তার রীতিনীতিকে মানুষ ঘৃণা করে। দুঃস্বভাবের মানুষ মানুষের হৃদয়ে জ্বালা ও বেদনা দেয়। তার সুন্দর মুখে মানুষ তৃপ্তি পায় না। অবোধ লোকেরা মানুষের রূপ দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার ফল ভোগ করে। যার স্বভাব মন্দ, সে নিজেও দুষ্ক্রিয়াশীল, মিথ্যাবাদী, দুর্মতিকে ঘৃণা করে। মানুষ নিজে স্বভাবে সুন্দর না হলেও সে স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে। স্বভাব গঠনে কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা চাই, নইলে শয়তানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
সারাংশ : বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, স্বভাবের সৌন্দর্যই মানুষকে বিচারের মাপকাঠি। খারাপ স্বভাবের মানুষও বাহ্যিক সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারে। আর যারা খারাপ স্বভাবের তারাও সুন্দর স্বভাবের মানুষকে পছন্দ করে। তাই কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে সুন্দর স্বভাবের অধিকারী হতে হবে।
১১৩
মানুষের একটা বড় পরিচয় সে ভাবতে পরে। করতে পারে যে কোন বিষয়ে চিন্তা। সে চিন্তা ও ভাব মানুষকে সাহায্য করে মানুষ হতে। পশুপাখিকে পশুপাখি হতে ভাবতে হয় না পারেও না ওরা ভাবতে বা চিন্তা করতে। সে বালাই ওদের নেই- যেটুকু পারে তার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ বাঁচা ও প্রজননের মধ্যে তা সীমিত। সভ্য-অসভ্যের পার্থক্যও এ ধরনের। যারা যত বেশি চিন্তাশীল সভ্যতার পথে তারাই তত বেশি অগ্রসর। আর চিন্তার ক্ষেত্রে যারা পেছনে পড়ে আছে, সভ্যতারও পেছনের সারিতেই তাদের স্থান। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি, দেশ সবের বেলায় এ সত্যের তারতম্য নেই। মোট কথা সভ্যতার প্রথম সোপানই হল চিন্তা-চিন্তার অভ্যাস তথা বুদ্ধির চর্চা।
সারাংশ : মানব জাতি প্রাণিকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কেবল চিন্তাশক্তির কারণে। যুগ যুগান্তরে সভ্যতার উদ্ভাবন ও বিবর্তন তাদের চিন্তারই ফসল। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও গবেষণা জাতিকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিয়ে যায়। আর এর বিপরীতে রয়েছে কেবল দৈন্যদশা।
১১৪
মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্রে, মনুষ্যত্বে, জ্ঞানে ও কর্মে। বস্তুত চরিত্র বলেই মানুষের জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কিছু নেই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করে, সে শুধু চরিত্রের জন্যে, অন্য কোনো কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে এত নত করার দরকার নেই। জগতে যে সকল মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের গৌরবের মূলে এই চরিত্রশক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, একথার অর্থ এই নয় যে, তুমি লম্পট নও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করো, তুমি পরদুঃখকাতর ন্যায়বান এবং মানুষের ন্যায় স্বাধীনতাপ্রিয়, চরিত্রবান মানে এই।
সারাংশ : চরিত্র মানবজীবনের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। চরিত্র বলেই মানুষ গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়, লাভ করে অপরের শ্রদ্ধা। আর চরিত্রবান বলতে মূলত সত্যবাদী, বিনয়ী, জ্ঞানবান, পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান, স্বাধীনতাপ্রিয় ব্যক্তিকে বোঝায়।
১১৫
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা সেই ঘরের নিচের তলা আর মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীবসত্তার ঘরেও সে কাজ করে; ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে তোলা তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অন্য কথায় শিক্ষার যেমন প্রয়োজনের দিক আছে, তেমনি অপ্রয়োজনের দিকও আছে; আর অপ্রয়োজনের দিকই তার শ্রেষ্ঠ দিক। সে শেখায় কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়, কী করে মনের মালিক হয়ে অনুভূতি ও কল্পনার রস আস্বাদন করা যায়।
সারাংশ : মনুষ্যত্ববোধের কারণে মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা। মানুষের জীবসত্তা থেকে মানবসত্তা তথা মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় হলো শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষকে মনুষ্যত্ববোধের সন্ধান দেয়, জীবনকে উপভোগ করতে শেখায় এবং হৃদয়কে আলোকিত করে।
১১৬
মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা সৈনিক-জীবনে। সৈনিক যে-পথ দিয়া হাঁটেন, সে পথের ধূলাগুলিও পবিত্র। সৈনিক সামান্য নহেন। পাপকে দমন করিবার জন্যে যে মানুষ অসি গ্রহণ করেন, তিনি অসামান্য। জীবনকে তুচ্ছ জানিয়া যিনি কামান-গোলার সম্মুখে বুক পাতিয়া দাঁড়ান, তিনি কত বড় তাহা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ? সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দান করিবার সাহস যাঁহার আছে তিনি কি শ্রেষ্ঠ মানুষ নন? খোদার সহিত প্রেম করিবার অধিকার সৈনিক ছাড়া আর কাহার আছে? যে মানুষ জীবনের মায়ায় অসত্যকে নমস্কার করে, সে মানুষ নহে।
সারাংশ : নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে সৈনিকরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, অপরের কল্যানের জন্য অস্ত্র ধারণ করে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই সৈনিক জীবন সার্থক জীবনের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে যারা নিজের সুখের জন্য অন্যায়কে বরণ করে তারা প্রকৃত মানুষ নয়।
১১৭
মাতৃস্নেহের তুলনা নাই। কিন্তু অতিস্নেহ অনেক সময় অমঙ্গল আনয়ন করে। যে স্নেহের উত্তাপে সন্তানের পরিপুষ্টি, তাহারই আধিক্যে সে অসহায় হইয়া পড়ে। মাতৃস্নেহের মমতার প্রাবল্যে মানুষ আপনাকে হারাইয়া আসল শক্তির মর্যাদা বুঝিতে পারে না। নিয়ত মাতৃস্নেহের অন্তরালে অবস্থান করিয়া আত্মশক্তির সন্ধান সে পায় না - দুর্বল অসহায় পক্ষীশাবকের মতো চিরদিন স্নেহাতিশয্যে আপনাকে সে একান্ত নির্ভরশীল মনে করে। ক্রমে জননীর পরম সম্পদ সন্তান অলস, ভীরু, দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হইয়া মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ হইতে দূরে সরিয়া যায়। অন্ধ মাতৃস্নেহ সে কথা বুঝে না অলসকে সে প্রাণপাত করিয়া সেবা করে ভীরুতার দুর্দশা কল্পনা করিয়া বিপদের আক্রমণ হইতে ভীরুকে রক্ষা করিতে ব্যস্ত হয়।
সারাংশ : মাতৃস্নেহে অতুলনীয় হলেও অন্ধস্নেহে এবং অত্যধিক স্নেহে সন্তানের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। মাতৃস্নেহে আধিক্যে সন্তানের অন্তরের শক্তির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয়। ফলে সে দুর্বল এবং পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
১১৮
মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া এ জগতে কোন জাতি বড় হইয়াছে? সারা দেশটিকে মূর্খ রাখিয়া দুই-চারজন লন্ডনে উচ্চজ্ঞানের সাথে পরিচিত হইতে পারিলে কি লাভ হইল ? তেমাার জ্ঞান, তোমার চিন্তা, যতদিন না তোমাকে প্রত্যেক দেশবাসীর আত্মাকে যাইয়া আঘাত করিতেছে, ততদিন তোমার উচ্চ জীবনের কোনো সার্থকতা নাই। তোমার জ্ঞান-ভান্ডারর মূল্য এক পয়সা নয়। জাতিকে উচ্চ রকমের জ্ঞান দান করো- তার চিত্ত মহৎ ও সুখী হইয়া উঠিবে। উহা কি দুই-একটা বিদেশী ভাষার স্কুল-কলেজে সম্ভব? সাহিত্যের ভিতর দিয়া জাতির হৃদয়ে আগুন জ্বালাইয়া দাও। সে জীবনের সার্থকতা অনুভব করিতে সমর্থ হইক।
সারাংশ : মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। একটি দেশের গুটিকয়েক লোক বিদেশি ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করলেই গোটা জাতির উন্নতি হয় না। জাতির উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা, যার মধ্যদিয়ে সমগ্র জাতি জ্ঞানবান হয়ে ওঠবে।
১১৯
মিথ্যাকে মিথ্যা বলিলে, অত্যাচারীকে অত্যাচারী বলিলে যদি নির্যাতন ভোগ করিতে হয়, তাহাতে তোমার আসল নির্যাতন ঐ অন্তরের যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে না। প্রাণের আত্মপ্রসাদ যখন বিপুল হইয়া ওঠে তখন নির্যাতনের আগুন ঐ আনন্দের এক ফুঁতে নিভিয়া যায়। ইব্রাহীম যখন বিদ্রোহী হইয়া নমরুদ্রের অত্যাচারকে অত্যাচার এবং তাহার মিথ্যাকে মিথ্যা বলিয়া প্রচার করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, নমরুদ তাহাকে ধরিয়া এক বিরাট অগ্নি জাহান্নামে নিক্ষেপ করিল। কিন্তু ইব্রাহীমের সত্যের জোর ছিল বলিয়া তাহার আত্মপ্রসাদের ঐ বিপুল আনন্দের এক ফূঁতে সমস্ত জাহান্নাম ফুল হইয়া হাসিয়া উঠিল। তাঁহার মনে যদি এতটুকু ফাঁকি থাকিত তবে তখনই নমরুদের আগুন তাহাকে ভস্মীভূত করিয়া দিত।
সারাংশ : অসত্য আর অত্যাচার রুখে দাঁড়াতে গিয়ে নির্যাতিত মানুষ প্রকৃতপক্ষে আত্মিক শক্তির দুয়ারে উপনীত হয়। প্রতিবাদ করার প্রবল আত্মসুখের জোয়ারে নমরুদের আগুন ইব্রাহিমের কাছে ফুলের বাগানে পরিণত হয়েছে। কপটতা কখনোই অগ্নিকুন্ড বসে স্বর্গীয় সুখ লাভ করে না।
১২০
মুখে অনেকেই টাকা তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন। কিন্তু জগৎ এমন ভয়ানক স্থান যে টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই। সমাজে নাই, স্বজাতির নিকট নাই, ভ্রাতা-ভগিনীর নিকটে নাই, স্ত্রীর নিকটে নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে এমন বলতে জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালোবাসারও আশা নাই। কাহারও নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তে টাকা, জগতে টাকারই খেলা।
সারাংশ : অর্থকে অনর্থের মূল বলা হলেও মূলত এটি অত্যন্ত মূল্যবান। অর্থ বিত্তহীন মানুষকে তার পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্রই অসম্মানের চোখে দেখা হয়। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাই অর্থই প্রধান অবলম্বন।
১২১
মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিবার উপায় জগতের একটি প্রাণীরও নাই। সুতরাং এই অবধারিত সত্যকে সানন্দে স্বীকার করিয়া নিয়াও মৃত্যুকে জয় করিবার জন্যে একটি বিশেষ কৌশল আয়ত্ত করিতে হইবে। তাহা হইতেছে অতীতের পূর্বপুরুষদের সাধনাকে নিজের জীবনে এমনভাবে রূপবন্ত করা যেন ইহার ফলে তোমার বা আমার মৃত্যুর পরেও সেই সাধনার শুভফল তোমার পুত্রাদিক্রমে বা আমার শিষ্যদিক্রমে জগতের মধ্যে ক্রমবিস্তারিত হইতে পারে। মৃত্যু তোমার দেহকেই মাত্র ধ্বংস করিতে পারিল, তোমার আরদ্ধ সাধনার ক্রমবিকাশকে অবরুদ্ধ করিতে পারিল না, এইখানেই মহাবিক্রান্ত মৃত্যুর আসল পরাজয়।
সারাংশ : মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব না হলেও মানুষ মৃত্যুকে জয় করে পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে। পূর্ব-পুরুষদের মহৎ কীর্তির অনুসরণে নিজ কীর্তিকে পৃথিবীতে রেখে যেতে পারলে অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। কারণ মৃত্যু কেবল দেহকে ধ্বংস করে, মহৎ কীর্তিকে নয়।
১২২
যতটুকু আবশ্যক কেবল তাহার মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎ পরিমাণে স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ; কিন্তু তাই বলিয়া সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহনির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীনভাবে চলাফেরার জন্যে অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সন্বন্ধেও সেই কথা খাটে; অর্থাৎ কেবল যতটুকু শিক্ষা অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহার মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না।
সারাংশ : একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলে মানবহৃদয়ের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না। মানবহৃদয়ের পরিপূর্ণ বিকাশে প্রয়োজন স্বাধীনতা। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই। শিক্ষার্থীর মানসিক উন্নতির জন্যে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি স্বাধীন পাঠের সুযোগ থাকা অপরিহার্য।
১২৩
যত বড় কঠিন কাজই হোক না কেন, অনুকূল পরিবেশে ও উপযুক্ত সময়ে তাহা করিবার জন্য অগ্রসর হইলে সেই কঠিন কাজই অতি সহজে সম্পাদিত হয়। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে ও অনুপযুক্ত সময়ে তাহা শত চেষ্টাতেও সম্পন্ন করা যায় না। বিজ্ঞান জগতে স্বীকৃত এ সত্যটি মনোজগতেও সমভাবে প্রকটিত। মানুষের মন জিনিসটি বড়ই রহস্যময়, সন্দেহ নাই। বাহির হইতে শক্তি প্রয়োগ করিয়া এ মনকে আয়ত্তের মধ্যে আনা যায় না। মনেরও আছে গতি এবং সেই গতিও বহু বিচিত্ররূপে প্রসারিত। ইহা না বুঝিয়া যত শক্তিই প্রয়োগ করা যাক না কেন, কোন ফলই হয় না। ভয় দেখাইয়া বা প্রলুব্ধ করিয়া যে মানব মনকে আকর্ষণ করা যায় না, তাহাকেই হয়তো বা আকর্ষণ করা যায় সহৃদয় অন্তরের দরদ ভরা স্পর্শ লাগাইয়া। সদম্ভ শক্তি প্রাচুর্যের দ্বারা মানব চিত্ত জয় করা যায় না, মানব সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা, স্থির বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তিকে লইয়া আগুয়ান হইলে দৃঢ়সংকল্প মানব মনকে বশীভূত করা যায়।
সারাংশ : রহস্যময় মানুষের মন, এই মনের গতিবিধিও রহস্যময়, মনকে আয়ত্ত করতে শক্তি যেখানে পরাজিত বুদ্ধি সেখানে সর্বদাই জয়ী। মনকে জয় করার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার তাই সময়ের সাথে স্থির বুদ্ধির প্রয়োগ।
১২৪
যথাসময়ে বে-আইনী বাড়ি দখলের ব্যাপারটা তদারক করবার জন্যে পুলিশ আসে। সেটা স্বাভাবিক্ দেশময় একটা ঘোর পরিবর্তনের আলোড়ন বটে, কিন্তু কোথাও যে রীতিমতো মগের মুল্লুক পড়েছে তা নয়। পুলিশ দেখে তারা ভাবে, পলাতক গৃহকর্তা কি বাড়ি উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে? তবে সে কথা বিশ্বাস হয় না। দু-দিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করে দিয়ে যে দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে বর্তমানে তার অন্যান্য গভীর সমস্যার কথা ভাববার আছে।
সারাংশ : যারা মহৎ তারা নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না। নিজ স্বার্থকে তুচ্ছ করে দেশ ও জাতির বৃহৎ ভাবনায় তারা সর্বদা ব্যাপৃত থাকেন।
১২৫
যাকে বলা হয় গোপন ও নীরব সাধনা তা বৃক্ষেই অভিব্যক্ত, নদীতে নয়। তাছাড়া বৃক্ষের সার্থকতার ছবি যত সহজে উপলব্ধি করতে পারি, নদীর সার্থকতার ছবি তত সহজে উপলব্ধি করা যায় না। নদী সাগরে পতিত হয় সত্য, কিন্তু তার ছবি আমরা প্রত্যহ দেখতে পাই না। বৃক্ষের ফুল ফোটানো ও ফল ধরানোর ছবি কিন্তু প্রত্যহ চোখে পড়ে। দোরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে সে অনবরত নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করে।
সারাংশ : নদী ও বৃক্ষ অভিন্ন সৌন্দর্য্য হলেও প্রকৃতির মঞ্চে নিজেদের উপস্থাপন করে ভিন্নভাবে। বৃক্ষ তার সব রহস্য দৃশ্যমান রেখে আমাদের দুয়ারে শান্তির স্তম্ভ হয়ে আছে অনুক্ষণ। কিন্তু নদীর সব রহস্য প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে ধরা পড়ে না।
১২৬
যাহারা স্বয়ং চেষ্টা করেন আল্লাহ তাহাদের সহায় হন। পৃথিবীতে যাহারা বড় লোক হইয়াছেন তাহাদের প্রত্যেকের জীবনী পাঠ করিলে আমরা এই শিক্ষাই পাইয়া থাকি। বিদ্যাই হউক আর ধনই হউক পরিশ্রম না করিলে কেহ তাহা লাভ করিতে পারে না। এক রাজপুত এক পন্ডিতকে বলিয়াছেন, ‘মহাশয় ! সাধারণ লোক পরিশ্রম করিয়া বিদ্যা লাভ করিয়া থাকে। আমি রাজপুত্র, পরিশ্রমে অভ্যস্ত নহি। আমার জন্য কি বিদ্যা অর্জনের কোনো সহজ পথ করিয়া দিতে পারেন না?’ পন্ডিত বলিলেন, ‘রাজার বা রাজপুত্রের জন্য বিদ্যা-শিক্ষার স্বতন্ত্র উপায় নাই।’ অনেক বালকই আছে যাহারা শিক্ষক মহোদয়ের সাহায্যের ওপর নির্ভর করিয়া থাকে। অভিধান খুলিয়া কষ্ট স্বীকার না করিয়া অর্থ-পুস্তকের সাহায্য গ্রহণ করে-এইরূপ লোক কখনও জগতে উন্নতি লাভ করিতে পারে না।
সারাংশ : পরিশ্রম ব্যতীত সার্থকতা লাভ করা যায় না। সৃষ্টিকর্তা পরিশ্রমী মানুষকেই সাহায্য করেন। জ্ঞানার্জন করতে হলেও পরিশ্রম করতে হয়। সাধারণ মানুষ থেকে রাজা, মহারাজা সকলের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
১২৭
যাহারা মুখ্যভাবে ঠকাইয়া স্বার্থসিদ্ধ করিতে যায় আমরা তাহাদিগকে শীঘ্রই চিনিয়া ফেলি এবং ‘শঠ’, ‘তস্কর’, ‘অত্যাচারী’ ইত্যাদি নিন্দিত বিশেষণের কলংকে চিহ্নিত করিয়া জগতকে সতর্ক করি; কিন্তু যাহারা গৌনভাবে ঠকাইয়া কার্যোদ্ধার করেন তাহাদের বাহ্য উজ্জ্বলতায় মুগ্ধ হইয়া আমরা তাহাদিগকে ‘উদ্যোগী’, ‘কৃতী’, ‘যশস্বী’ আদি প্রশংসিত আখ্যায় বিভুষিত করি। কেহ সোনা বলিয়া পিতল বিক্রয় করিলে তাহাকে শঠ বলি, কিন্তু যখন কেহ সোনাই উচিত মূল্য অপেক্ষা অধিক টাকায় বিক্রয় করিয়া বড়লোক হয়, আমরা তাহাকে কৃতী পুরুষ বলি।
সারাংশ : যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে মানুষকে ঠকিয়ে নিজস্বার্থ উদ্ধার করে আমরা নানাভাবে তার নিন্দা করে থাকি। কিন্তু যে গোপনে মানুষকে ঠকিয়ে ধন এবং খ্যাতি লাভ করে তার নিন্দা তো করিই না, উল্টো তার প্রশংসা করি।
১২৮
যাহা জ্ঞানের কথা তাহা প্রচার হইয়া গেলেই তাহার উদ্দেশ্য সফল হইয়া শেষ হইয়া যায়। মানুষের জ্ঞান সন্বন্ধে নতুন আবিষ্কারের দ্বারা পুরাতন আবিষ্কার আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে। কাল যাহা পন্ডিতের অগম্য ছিল, আজ তাহা অর্বাচীন বালকের কাছেও নূতন নহে। যে সত্য নূতন বেশে বিপ্লব আনয়ন করে, সেই সত্য পুরাতন বেশে বিস্ময়মাত্র উদ্রেক করে না। আজ যে সকল তত্ত্ব মূঢ়ের নিকট পরিচিত, কোনোকালে যে তাহা পন্ডিতের নিকটও বিস্তর বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছিল, ইহাই লোকের কাছে আশ্চর্য বলিয়া মনে হয়। কিন্ত হৃদয়ভাবের কথা প্রচারের দ্বারা পুরাতন হয় না। জ্ঞানের কথা একবার জানিলে আর জানিতে ইচ্ছা হয় না; আগুন গরম, সূর্য গোল, জল তরল ইহা একবার জানিলেই চুকিয়া যায়; দ্বিতীয়বার কেহ যদি তাহা আমাদের নূতন শিক্ষার মতো জানাইতে আসে তবে ধৈর্য রক্ষা করা কঠিন হয়। কিন্তু ভাবের কথা বারবার অনুভব করিয়া শান্তিবোধ হয় না-সূর্য যে পূর্বদিকে ওঠে, একথা আর আমাদের মন আকর্ষণ করে না কিন্তু সূর্যোদয়ের যে সৌন্দর্য ও আনন্দ তাহা জীবনসৃষ্টির পর হইতে আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে অম্লান আছে। এমনকী অনুভূতি যত প্রাচীনকাল হইতে যত লোক পরম্পরার ওপর দিয়া প্রবাহিত হইয়া আসে, ততই তাহার গভীরতা বৃদ্ধি হয়ততই তাহা আমাদিগকে সহজে আবিষ্ট করিতে পারে।
সারাংশ : জ্ঞানের কথা একবার জানার পর তার প্রতি আর মানুষের আগ্রহ থাকে না। কিন্তু হৃদয়ভাবের কথা মানুষকে শ্রান্ত করে না, মানুষ কখনো তার প্রতি আগ্রহ হারায় না। জ্ঞান পুরাতন হয়ে গেলেও ভাব থাকে চির নতুন। ভাবের সৌন্দর্য ও আনন্দের অনুভূতি যত পুরাতন হয় ততোই তার গভীরতা বৃদ্ধি পায়, ততোই তা মানুষকে আবিষ্ট করে।
১২৯
যে মনে উচ্চ আকাক্সক্ষা, উচ্চ আদর্শ নাই, সে মনে তেজও নাই। যে গাছে রোদ বৃষ্টি লাগে না, তাহা আরামে থাকতে পারে বটে, কিন্তু সে আরামে কেবল দুর্বলতা বাড়িয়া যায়। আমাদের জাতির মনে পার্থিব কোনো প্রকার উচ্চ আকাক্সক্ষা, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির কোনো প্রবাহ নাই। এজন্যে আমাদের উচ্চশিক্ষিত লোকদিগের মধ্যেও তেমন বিশেষ তেজ, সাহস বা প্রতিভা দেখা যায় না। আমাদিগকে প্রাণপণ চেষ্টায় আমাদের বালক-বালিকাদের মনে স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্বলাভের শক্তিতে বিশ্বাসী এবং অন্যদিকে জাতির উন্নতির চরম ও পরম লক্ষ্যে মাতোয়ারা করিতে হইবে। আমাদের সন্তানদের মনে একবার আত্মবিশ্বাস জাগাইয়া তুলিতে পারিলেই তাহারা তাহাদের গন্তব্যপথ তাহা যতই বিঘ্ন বহুল ও বিপদসংকুল হউক না কেন, যতই দুর্গম ও দুরারোহ হউক না কেন- তাহা ধরিয়াই তাহারা প্রতিষ্ঠার স্বর্ণশিখরে উপস্থিত হইবে।
সারাংশ : উচ্চাকাঙ্খা ও উচ্চ আদর্শের অভাবে জাতি মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই উচ্চশিক্ষিতের মধ্যেও সাহস বা প্রতিভা লক্ষ্য করা যায় না। শিশুদের যদি স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্বের শক্তিতে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা যায় এবং আপন লক্ষ্যে স্থির রাখা যায় তবে তারা সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহন করবেই।
১৩০
যে-সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্ছারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর, রং, ইঙ্গিত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদযের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না; তাহাই সাহিত্যের সামগ্রী। তাহা আকারে প্রকারে, ভাবে-ভাষায়, সুরে-ছন্দে মিলিয়া তবেই বাঁচিতে পারে। তাহা মানুষের একান্ত আপনার; তাহা আবিষ্কার নহে, অনুকরণ নহে, তাহা সৃষ্টি। সুতরাং তাহা একবার প্রকাশিত হইয়া উঠিলে তাহা রূপান্তর, অবস্থান্তর করা চলে না। তাহার প্রত্যেক অংশের ওপর তাহার সমগ্রতা একান্তভাবে নির্ভর করে। যেখানে তাহার ব্যত্যয় দেখা যায়, সেখানে সাহিত্য - অংশে তাহা হেয়।
সারাংশ : সাহিত্যের সাথে মানবহৃদয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট। যে সাহিত্য হৃদয় দ্বারা সৃষ্ট সে সাহিত্যই হৃদয়ে স্থান লাভ করে। অপরের অনুকরণে নয়, আপন হৃদয়ের ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দের সাথে মিশে সাহিত্য জন্ম লাভ করে। আর এ সাহিত্যই হয় অমর, অক্ষয়।
১৩১
যে আদিম মনুষ্য হিংস্র পশুর ন্যায় ক্ষুধার জ্বালায় মহারণ্যে বিচরণ করিয়া মৃগ বধপূর্বক মধ্যাহ্নে বৃক্ষমূলে কাঁচা মাংস চিবাইয়া খাইত, সেই মনুষ্যই যেদিন অপরাহ্নের অস্তাচলগামী মৃদু মধুর বর্ণচ্ছাটায় বিমুগ্ধ হইয়া কি জানি কি ভাবিয়া, একটি পবনান্দোলিত বিলম্বিত লতা হইতে সবুজ জ্যোতিপুষ্প ছিঁড়িয়া মাথার চুলে গুঁজিল, সেই দিনই তাহার বিশাল ইতিহাসের সূত্রপাত হইল। সেইদিন জানা গেল যে, মহারণ্যবাসী সিংহ, ব্যাঘ্র চিরকাল মহারণ্যেই বাস করিবে; কিন্তু তাহাদের আদিম সহচর মনুষ্য মহারণ্য বিনষ্ট করিয়া মহাসম্পদের সৃষ্টি করিবে। সেদিন জানা গেল যে সিংহ ব্যাঘ্রের কেবল পৃথিবী আছে, কিন্তু মনুষ্যের পৃথিবী ও স্বর্গ দুই-ই আছে। সেই হইতে মানুষের অনন্ত শিক্ষার, আনন্ত উন্নতির সূত্রপাত হইল।
সারাংশ : মানুষ প্রাণী হলেও অন্য প্রাণী থেকে সে পৃথক। মানুষের মধ্যে আছে সৌন্দর্যবোধ। এই সৌন্দর্যবোধ যেদিন মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে সেদিন থেকে অন্য প্রাণীর সাথে তার পার্থক্য রচিত হয়েছে। মানুষের শিক্ষা এবং উন্নতির মূলসূত্রও এই সৌন্দর্যবোধ।
১৩২
যে জাতির লক্ষ্য ‘সত্য’ নহে সে জাতির কোন সাধনাই সফল হবে না। ‘সত্যবর্জিত’ জাতির জীবন অন্ধকার। জাতির উন্নতির জন্য তারা বৃথাই শরীরের রক্তপাত করে, সত্যই শক্তি। এ সকল কল্যাণের মূল। এতে মানুষের সর্বপ্রকার দুঃখের মীমাংসা হয়। সত্যকে ত্যাগ করে কোন জাতি কোন দিন বড় হয়নি, হবে না। মানব জীবনের লক্ষ্যই সত্য। এটাই শান্তির ও ঐক্যের পথ। সত্যের অভাব বিরোধ ও দুঃখ সৃষ্টি করে। মানুষে মানুষে, বন্ধুতে বন্ধুতে, আত্মীয়ে আত্মীয়ে পরস্পর মতান্তর উপস্থিত হয়। সত্য বর্জন করে তোমরা কোন কাজ করতে যেও না এর ফল পরাজয়।
সারাংশ : ‘সত্য’ জাতীয় জীবনের মূলমন্ত্র। জাতীয় জীবনে সত্যকে পরিহার করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। শান্তি ও ঐক্য অর্জিত হয় এর মাধ্যমে। সত্যের পথ পরিহার জাতীয় জীবনে ডেকে আনে অকল্যাণ, অন্ধকার। সত্যই তাই জীবনের ব্রত হওয়া উচিত।
১৩৩
যে জাতি চেষ্টা দ্বারা, বুদ্ধি ও শ্রম দ্বারা কিছু উপার্জন করিতে সক্ষম না হয়, সে জাতি পৃথিবীতে টিকিয়া থাকিতে পারে না। শুধুমাত্র অনুকরণ দ্বারা স্থায়ী বস্তু লাভ করা যায় না। জ্ঞানের অনুশীলন, ধৈর্য্য, সততা ও পরিশ্রম ব্যতিরেকে কোনো কিছুই লাভ করা সম্ভব নয়। ছাত্রসমাজকে এই ব্যাপারে মনোযোগী হইতে হইবে। তাহারাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক ও জাতির মেরুদ-। তাহারাই দেশের আশা ভরসা ও মানবসভ্যতার অগ্রগতির সহিত বিশেষভাবে জড়িত। তাই প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীকে পরিশ্রমী, মনোযোগী, কর্মঠ ও অধ্যবসায়ী হইয়া গড়িয়া উঠিতে হইবে। তাহা না হইলে জাতির জীবনের দুর্দিন ঘনাইয়া আসিবে সন্দেহ নাই।
সারাংশ : বুদ্ধি, শ্রম, প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং সততার মাধ্যমেই কোনো জাতির পক্ষে উন্নতি ও স্থায়িত্ব লাভ করা সম্ভব, অনুকরণের মাধ্যমে নয়। ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ এবং দেশ ও জাতির মেরুদ-। তাই জাতির উন্নতির জন্য তাদের পরিশ্রমী, মনযোগী, কর্মঠ এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠতে হবে।
১৩৪
যে মরিতে জানে, সুখের অধিকার তাহারই। যে জয় করে, ভোগ করা তাহাকেই সাজে। যে লোক জীবনের সঙ্গে সুখকে, বিলাসকে দুই হাতে আঁকড়াইয়া থাকে, সুখ তাহার সেই ঘৃণিত ক্রীতাদাসের কাছে নিজের সমস্ত ভান্ডার খুলিয়া দেয় না। তাহাতে উচ্ছিষ্টমাত্র দিয়া দ্বারে ফেলিয়া রাখে। আর মৃত্যুর আহ্বান মাত্র যাহারা তুড়ি মারিয়া চলিয়া যায়, চির-অদৃত সুখের দিকে একবার পিছন ফিরিয়া তাকায় না, সুখ তাহাদিগকে চায়। সুখ তাহারাই জানে। যাহারা সবলে ত্যাগ করিতে পারে, তাহারাই প্রবলভাবে ভোগ করিতে পারে।
সারাংশ : জীবনে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম ও মৃত্যুভয়মুক্ত হওয়ার মধ্যে যে সুখ ও তৃপ্তি রয়েছে তা বিলাসিতার মধ্যে নেই। মানসিক প্রশান্তিই প্রকৃত সুখ যা ভোগে নয় ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে আত্মতৃপ্ত হওয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।
১৩৫
যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে জীবনের বিকাশ নেই, উল্লাস নেই, প্রেরণা নেই, নেই কোন প্রয়াস। জীবনের জাগরণের জন্য চাই দ্বন্দ্ব, চাই সংঘাত। আর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যারা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে পাপী-অপরাধী, আসামী, পরিণামে জয়ী তারাই। এমনি নতুন চিন্তা আঘাতেই জাগে, তাই এ চিন্তা আঘাতেরই সন্তান। এ অর্থে সে যে পরশ, সেই তো পুরস্কার। দুর্ব্বা ক্ষুদ্র ও কোমল। পায়ে দলিত হওয়াই তার নিয়তি। তবুও সে অমর ও চিন্ময়- সবুজ ও প্রাণময়, তেমনি মানবতাবাদী মনীষীরা সংখ্যায় নগণ্য, বাহুবলে তুচ্ছ, নির্যাতনই তাদের ললাট লিপি।তবুও তারাই মানব ভাগ্যের নিয়ন্তা। তারা ভাঙেন কিন্তু মচকান না। নিজে মরেন কিন্তু দিয়ে যান হায়াত। চিন্তাবিদ বাহ্যত একক ব্যক্তি, কিন্তু আসলে রক্তজীব। দুর্ব্বার মতো চিন্তা ও চিন্তাবিদদের ধ্বংস নেই। সে মরে, মরেই বাঁচে।
সারাংশ : চিন্তার ভিতর দিয়ে বিকশিত জীবনের ধ্বংস নেই। মানব সভ্যতার বাতিঘর হয়ে তাই যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন চিন্তাবিদ, জ্ঞানী মনীষীরা। সংখ্যায় অতি ক্ষুদ্র এই মহৎ প্রাণ মানুষগণ সমস্ত জাতির পথ প্রদর্শক। তাদের চিন্তার খোরাক জাগে সংঘাত আর দ্বন্দ্ব থেকে।
১৩৬
যুগে যুগে আদর্শবাদীরাই জগৎকে আনন্দে, শান্তিতে, সাম্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যাহারা বৃহৎ-এর চিন্তা করেন, তাহারা পৃথিবীতে বৃহৎ কল্যাণ আনয়ন করেন। ক্ষুদ্রত্বের বন্ধনে বাঁধা থাকিলে জীবন, যৌবন ও কর্মের শক্তি ক্ষুদ্র হইয়া যায়। পুকুরের পানি গ্রামের কল্যাণ করে, কিন্তু সংক্রামক রোগের একটি জীবাণু পড়িলেই সে পানি দূষিত ও অপেয় হইয়া যায়। কেননা পুকুরের পানির চারিধারে বন্ধনতার বিস্তৃতি নাই, গতি নাই, প্রবাহ নাই। নদীর পানিরও চারিধারে বন্ধন, একধারে পাহাড়, একধারে সমুদ্র, দুইধারে কূল। কিন্তু তার বিস্তৃতি আছে, তাই গতি ও প্রবাহ নিত্য সাথী। এই প্রবাহের জন্যই নদীর পানিতে নিত্য শত রোগের জীবাণু পড়িলেও তাহা অশুদ্ধ হয় না, অব্যবহার্য হয় না। তাই নদী পুকুরের চেয়ে দেশের বৃহৎ কল্যাণ করে। নদীর নিত্য তৃষ্ণা সমুদ্রের দিকে, অসীমের দিকে। অসীম সমুদ্রকে পাইয়াও সে সীমাবদ্ধ দেশকে স্বীকার করে, তার বক্ষচ্যুত হয় না। আমাদের আদর্শ পরম পুণ্যের, পরম নিত্যের। কিছুতেই আমরা কর্মচ্যুত হইব না, বৃহৎ কর্ম করিব।
সারাংশ : আদর্শ মানুষরাই পৃথিবীকে শান্তির সবুজ ছায়ায় ঢেকে দিয়েছেন। যারা বৃহৎ কল্যাণ সাধন করেন তারা কেউই ক্ষুদ্র মানসিকতার অধিকারী নন। পুকুর মানুষের ক্ষুদ্র প্রয়োজন মেটায় কিন্তু বৃহৎ প্রয়োজন মেটাতে দরকার নদীর মত প্রবাহমান, বিশুদ্ধ স্রোত। কেননা ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে কখনোই বৃহৎ কর্ম সম্পাদন হয় না।
১৩৭
রাজার ছেলের সঙ্গে দরিদ্রের ছেলেরও খেলায় যোগ দেবার অধিকার আছে। আমরা যদি একবার সাহস করে কেবলমাত্র খেলা করবার জন্যে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করি, তাহলে নির্বিবাদে সে জগতের রাজ-রাজড়ার দলে মিশে যাই। কোনোরূপ উচ্চ আশা নিয়ে সেক্ষেত্রে উপস্থিত হলেই নিম্নশ্রেণিতে পড়ে যেতে হয়।
সারাংশ : সাহিত্য জগতে প্রবেশের অধিকার সকলের সমান। আনন্দদানের উদ্দেশ্যেই সাহিত্য রচিত হওয়া উচিত। কিন্তু যে সাহিত্য খ্যাতি বা মহত্ব লাভের উদ্দেশ্যে রচিত হয় সে সাহিত্য নিম্ন শ্রেণিতে পতিত হয়।
১৩৮
রূপলোকে ও রসলোকে আমাদের উন্নীত করতে পারে শিক্ষা। তাই শিক্ষা একটি উদ্দেশ্য এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য মনের চোখ ও রসনা সৃষ্টি করা। যেখানে তা হয়নি সেখানে শিক্ষা ব্যর্থ। মনুষ্যত্বের সাধনা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনা, আর প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দের তাগিদে আমরা লঘুভার হতে পারি। শিক্ষা আমাদের এই প্রেম-সৌন্দর্য ও আনন্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের সাধনায় তথা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনায় সহায়তা করে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর রূপ ও রসের জন্যে কল্যাণ, কল্যাণের জন্যে রূপ ও রস নয় এই বোধ থাকে না বলে শিল্প-সাহিত্যের এত অপব্যবহার ঘটে। শিক্ষার কাজ সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
সারাংশ : শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মনের চোখকে উন্মোচিত করা, প্রেম সৌন্দর্য ও আনন্দবোধ সৃষ্টি করা এবং মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করা। এ উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হলে শিক্ষা সার্থকতা লাভ করতে পারে না।
১৩৯
রূপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় আর কটি লোক। শতকরা নিরানব্বইটি মানুষকেই চেষ্টা করতে হয়, জয় করে জিততে হয় তার ভাগ্যকে। বাঁচে সেই যে লড়াই করে প্রতিকূলতার সঙ্গে। পলাতকের স্থান জগতে নেই। সমস্ত কিছুর জন্যেই চেষ্টা দরকার। চেষ্টা ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। সুখ চেষ্টারই ফল-দেবতার দান নয়। তা জয় করে নিতে হয়। আপনা আপনি এটা পাওয়া যায় না। সুখের জন্যে দু রকম চেষ্টা দরকার, বাইরের আর ভিতরের। ভিতরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্য একটি। বৈরাগ্যও চেষ্টার ফল, তা অমনি পাওয়া যায় না। কিন্তু বাইরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্যের স্থান নেই।
সারাংশ : খুব কম সংখ্যক মানুষই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অধিকাংশ মানুষকেই বাহিরের ও অন্তরের বৈরাগ্যময় চেষ্টার দ্বারা সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে সুখ এবং সৌভাগ্য অর্জন করতে হয়। প্রতিকূলতা আবার বৈরাগ্য ও চেষ্টার ফল, তবে বাহিরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্য নেই।
১৪০
শ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করো। কালি-ধুলার মাঝে রৌদ্র-বৃষ্টিতে কাজের ডাকে নেমে যাও। বাবু হয়ে ছায়ায় পাখার তলে থাকবার দরকার নেই। এ হচ্ছে মৃত্যুর আয়োজন। কাজের ভিতর কুবুদ্ধি, কুমতলব মন-চিত্তে বাসা বাঁধতে পারে না। কাজে শরীরে সামর্থ্য জন্মে ; স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ, স্ফুর্তি সকলই লাভ হয়। পরিশ্রমের পর যে অবকাশ লাভ হয়, তা পরম আনন্দের অবকাশ। তখন কৃত্রিম আয়োজন করে আনন্দ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। শুধু চিন্তার দ্বারা জগতের হিত সাধন হয় না। মানবসমাজে মানুষের সঙ্গে কাজে, রাস্তায়, কারখানায় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে।
সারাংশ : কোনো কাজকেই ছোটো করে দেখা উচিত নয় অলসতা হৃদয়ের মৃত্যুকে ডেকে আনে। কাজের মাধ্যমে মানুষ শরীরিকভাবে সমর্থ হয় এবং আনন্দ লাভ করে। কাজের পরবর্তী যে অবসর তার আনন্দ অতুলনীয়। কাজের মাধ্যমে অন্যের সাথে সুব্যবহার করে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে।
১৪১
শিক্ষা একমুখী হওয়া কিছু নহে। উহা বহুমুখী হওয়া চাই। মানুষের মনকে যদি একটি পায়রার ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে সর্বতোমুখী শিক্ষা উহার সকল দ্বার মুক্ত করিয়া রাখে। এই অসীম বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড চক্ষু উন্মীলন করিলেই কৃত বিষয় দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইলে অনেক জ্ঞান লাভ করা যায়। কিন্তু যাহার মনের সকল দ্বারগুলো খোলা নাই, যাহার মনোবৃত্তিসমূহ সম্যক পুষ্ট নহে, তাহার পক্ষে সমস্তই অন্ধকার। পরন্তু যাহার সেই দ্বারগুলো খোলা সে যে দিবানিশি জ্ঞান সঞ্চয় করিতে পারে তাহাই নহে, সে ইহার ব্যবহারও করিতে পারে।
সারাংশ : শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতি চর্চা জীবনকে অর্থপূর্ণ এবং সম্পূর্ণ করে তোলে। আবার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আর সমাজ, প্রগতি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরের পরিপূরক। তাই এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সাহিত্যিক শিল্পীদের ভূমিকা জানতে হলে দুটি বিষয়কেই জানতে হবে।
১৪২
শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষত লোকমাত্রই স্বশিক্ষিত। আজকের বাজারে বিদ্যাদাতার অভাব নেই, এমনকি এক্ষেত্রে দাতাকর্ণেরও অভাব নেই এবং আমরা আমাদের ছেলেদের তাদের দ্বারস্থ করেই নিশ্চিন্ত থাকি। এ বিশ্বাসে যে, সেখান থেকে তারা এতটা বিদ্যার ধন লাভ করে ফিরে আসবে যার সুবাদে তারা বাকি জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এ বিশ্বাস নিতান্ত অমূলক। মনোরাজ্যের দান গ্রহণসাপেক্ষ, অথচ আমরা দাতার মুখ চেয়ে গ্রহীতার কথাটা একেবারে ভূলে যাই। এ সত্য ভূলে না গেলে আমরা বুঝতাম যে, শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতুহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধি-বৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনোরাজ্যেও ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, তার জ্ঞান পিপাসাকে জ্বলন্ত করতে পারেন, এর বেশি আর কিছু পারেন না।
সারাংশ : জ্ঞানার্জনের প্রতি সুতীব্র ইচ্ছা থেকে মানুষ জ্ঞানী হয়ে উঠে। প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক কখনোই কারো জ্ঞান পিপাসা জাগ্রত করতে পারে মাত্র। জ্ঞান অর্জনের আকাক্সক্ষা শুধু ব্যক্তির অন্তর দ্বারা উপলব্ধি হতে হয়, অন্যথায় শিক্ষা হয়ে পড়ে নাম সর্বস্ব।
১৪৩
শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া জীবন কখনও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে না- কারণ ঐ ছাড়া জীবনের ধারণা আর উপলব্ধি থেকে যায় অসম্পূর্ণ ও অলব্ধ। জীবনকে স্রেফ যৌগিক নয় এ বোধ একমাত্র শিল্প-সাহিত্যই সঞ্চারিত করে দেয় আমাদের মনে। কাজেই সমাজ, প্রগতি আর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরস্পরের সহযোগী ও একে অন্যের পরিপূরক। তবে এসবের যথাযথ ভূমিকা বোঝার জন্যে এর প্রত্যেকটা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে এদের পারস্পরিক সম্বন্ধ যেমন বুঝতে পারা যাবে না তেমনি পারা যাবে না সাহিত্যিক শিল্পীদের যথার্থ ভূমিকা কী তাও।
সারাংশ : শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতি চর্চা জীবনকে অর্থপূর্ণ এবং সম্পূর্ণ করে তোলে। আবার এগুলো সমাজ ও প্রগতির সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরের পরিপূরক। তাই এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সাহিত্যিক-শিল্পিদের ভূমিকা জানতে হলে দুটি বিষয়কেই ভালোভাবে বুঝতে হবে।
১৪৪
শুনিয়াছি নাকি বিলাত প্রভৃতি মেচ্ছ দেশে পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে-স্ত্রীলোক দুর্বল ও নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই। এ আবার একটা কী কথা। সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না। আমরা বলি যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়। তা সে নরনারী যাই হোক না কেন।
সারাংশ : পাশ্চাত্য দেশে নারী তার যথার্থ মর্যাদা পায়। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় সেটি খুব কমই দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে নিগৃহীত, অপমানিত হতে হয়।
১৪৫
শ্রেষ্ঠ বলিয়া অহঙ্কার করিতে যে লজ্জাবোধ করে না, যে মানুষকে নি:স্বার্তে বসাইয়া রাখিতে আনন্দবোধ করে, দরিদ্র ও ছোটকে ছোট করিয়া রাখিতে কষ্ট অনুভব করে না, যে মানুষের শক্তি স্বাধীনতা হরণ করিতে ব্যস্ত, যে মানুষের হাত দিয়া নিজের পায়ের জুতা খুলাইয়া লয়, তোমরা তাহাদিগকে সালাম করিও না। সে সারারাত্রি এবাদত করুক, মানুষ তাহার পদধূলি লইয়া মাথায় মাখুক, সে প্রথম শ্রেণীর গাড়ি চড়–ক, সে রাজদরবারের সদস্য হউক, তোমরা তাহাকে আত্মীয় করিও না। তোমরা কি জান এ যুগের রাজা কাহারা? নরনারী মুক্তির আশায় করুণ নেত্রে তোমাদের দিকেই চাহিয়া আছে। পিষ্ট, কোটি মানবাত্মা তোমাদের আগমনের অপেক্ষা করিতেছে। যে দুর্বৃত্তের দল সত্যকে চূর্ণ করিয়া আল্লাহর বাণীকে অবমাননা করিতেছে তাহাদিগকে দেখিয়া আর তোমরা শ্রদ্ধার আসন ছাড়িয়া দাঁড়াইও না। মহানবীর জীবন ও চিন্তাকে যে অনুসরণ করে না, যে শুধু দরুদ (শান্তিবাদ) পাঠ করিয়াই প্রেমিক হইবার দাবি রাখে, সে মহানবীর কেহই নয়। ভ- বলিয়া তাহার গায়ে ধূলি নিক্ষেপ করিলে আমার মনে দুঃখ হইবে না।
সারাংশ : মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ সে, যে অন্যকে সম্মান করতে জানে এবং অন্যের অধিকার হরণ করতে উদ্যত হয় না। সৃষ্টিকর্তাকে অমান্যকারী সমাজের যত বড় আসনে আসীন থাকুক সে সর্বদাই ঘৃণার পাত্র।
১৪৬
সকল প্রকার কায়িক শ্রম আমাদের দেশে অমর্যাদাকর বলিয়া বিবেচিত হইয়া আসিতেছে। শ্রম যে আত্মসম্মানের অনুমাত্রও হানিজনক নহে এবং মানুষের শক্তি, সম্মান ও উন্নতির ইহাই প্রকৃষ্ট ভিত্তি এ বোধ আমাদের মধ্যে এখনও জাগে নাই। জগতের অন্যত্র মানবসমাজ শ্রম সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করিয়া সৌভাগ্যের সোপানে উঠিতেছে, আর আমরা কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করিয়া দিন দিন দুর্গতি ও হীনতায় ডুবিয়া যাইতেছি। যাহারা শ্রমবিমুখ বা পরিশ্রমে অসমর্থ, জীবনসংগ্রামে তাহাদের পরাজয় অনিবার্য। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে অযোগ্যর পরিত্রাণ নাই। যাহারা যোগ্যতম, তাহাদেরই বাঁচিবার অধিকার এবং অযোগ্যর উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং পরিশ্রমের অমর্যাদা আত্মহত্যারই নামান্তর।
সারাংশ : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কায়িক শ্রমের ওপর ভিত্তি করে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করলেও আমাদের দেশে সকল প্রকার কায়িক শ্রমকে অমর্যাদাকর বলে বিবেচনা করা হয়। ফলে শ্রমবিমুখ এবং পরিশ্রমে অসমর্থ হয়ে আমরা ক্রমশ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছি।
১৪৭
সত্য ওজন দরে বা গজের মাপে বিক্রয় হয় না। তাহা ছোট হইলেও বড়। পর্বত পরিমাণ খড়-বিচালি স্ফুলিঙ্গ-পরিমাণ আগুনের চেয়েও দেখিতে বড়, কিন্তু আসলে বড় নহে। সমস্ত সেজের মধ্যে যেখানে সফলতার সূচাগ্র পরিমাণ মুখটিতে আলো জ্বলিতেছে সেখানেই সমস্ত সেজটার সার্থকতা। তেলের নিম্নভাগে অনেকখানি জল আছে; তাহার পরিমাণ যতই হোক সেইটিকে আসল জিনিস বলিবার কোনো হেতু নাই। সকল সমাজেই সমস্ত সমাজ প্রদীপের আলোটুকু যাহারা জ্বালাইয়াছেন, তাহারা সংখ্যা হিসেবে নহে, সত্য হিসাবে সে সমাজে অগ্রগণ্য। তাহারা দগ্ধ হইতেছেন। আপনাকে তাহারা নিমিষে ত্যাগই করিতেছেন, তবু তাঁহাদের শিক্ষা সমাজে সকলের চেয়ে উচ্চে। সমাজে তাঁহারাই সজীব ও তাহারাই মহৎ।
সারাংশ : সত্য এবং মহত্ত্বের শক্তি পরিমাপ করা যায় না। মহৎ ব্যক্তি সত্যের শক্তিতেই সমাজে অগ্রগণ্য, সংখ্যায় নয়। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সমাজের জন্য তাঁর অবদান সকল কিছুর উর্ধ্বে।
১৪৮
সব সুন্দর আপনাকে গোপন রাখে, অসুন্দর সে নিজেই এগিয়ে আসে। ফুল কতখানি সুন্দর হয়ে ফোটে তাহা সে নিজেই জানে না, প্রজাপতি জানে না যে কতখানি সুন্দর তার গতাগতি, শামুক জানে না যে তাজমহলের চেয়ে আশ্চর্য সুন্দর সমাধি গড়ে যাচ্ছে সে। যে কাজে রচয়িতা কেমনটা বানিয়াছে, এটুকুই প্রকাশ করে গেল সে কাজ অসুন্দর হলো- এর নিদর্শন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সেখানে প্রত্যেক পাথর কী কৌশলে একের পর এক স্তুপাকার করে তোলা হয়েছে, এইটেই দেখা যায়। কারিগর তার তোড়জোড় নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে বুক ফুলিয়ে; কিন্তু তাজমহল? সেখানে কারিগর কেমন করে পাথরগুলো কোন কোন জায়গায় জুড়েছে তার হিসাবটিও যথাসম্ভব মুছে দিয়ে তার সৃষ্টিটাকে এগিয়ে আসতে দিয়েছে সামনে। কাজের থেকে এতখানি আপনাকে লোপ করে দিতে যে না পারল, সে অসুন্দর কাজ করল। বাড়ির কর্তা যেখানে অভ্যাগতকে আসন দিল না, নিজেই গ্যাট হয়ে জায়গা জুড়ে বসল, সেখানে উৎসব তার পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে দেখা দিল না।
সারাংশ : অসুন্দর সাগ্রহে নিজেকে প্রকাশ করে কিন্তু সুন্দর সর্বদা নিজেকে গোপন রাখে। যে কাজ করে ব্যক্তি সেখান থেকে নিজেকে লোপ করে দিতে পারে না। সে কাজ কখনোই সুন্দর হয় না।
১৪৯
সংহতি ও শৃঙ্খলা যেমন ব্যক্তিগত জীবনে, তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবনে ও জাতীয় জীবনে মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসে। দুশমনের ষড়যন্ত্রে জাতির জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সঙ্কট দেখা দিতে পারে, সংহতি ও শৃঙ্খলা তা থেকে জাতিকে রক্ষা করে। ক্ষুদ্র স্বার্থান্ধতা ও ভেদবুদ্ধি পরিত্যাগ করে বৃহত্তর মানবতামুখী পরিচর্যায় পরিব্যাপ্ত করতে হবে আমাদের চিন্তা ও কর্মকে। তবেই তা অনিষ্টকর না হয়ে, হয়ে উঠবে কল্যাণের, শান্তির। জাতির পক্ষে যেকোন পরিকল্পনা কার্যকরী করতে হলে, সাফল্যম-িত করতে হলে চাই ঐক্য, শৃঙ্খলা ও শান্তি। শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন বড়-ছোট, ধলো-কালো, পূর্বী-পশ্চিমী বলে কোন ভেদাভেদ থাকে না। সাম্য ও মৈত্রীর ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাই মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। প্রগতি বলতে যদি জাতির প্রতিটি ব্যক্তির উন্নতি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি বোঝায়, তাহলে সেই প্রগতি অবশ্যই ঐক্য, শৃঙ্খলা, ঈমান, সাম্য ও মৈত্রীভিত্তিক হতে হবে। ব্যক্তির কল্যাণ মানেই জাতির কল্যাণ, আর জাতির কল্যাণ মানেই আন্তর্জাতিক তথা বিশ্বের কল্যাণ।
সারাংশ : শৃঙ্খলাম-িত জীবন সর্বদাই সাফল্যের সোনালি স্রোতে অবগাহন করে। জাতীয় জীবনে সফলতার মূলমন্ত্রও তাই ঐক্য ও শৃঙ্খলা।
১৫০
সময় ও স্রোত কারও অপেক্ষায় বসে থাকে না। চিরকাল চলতে থাকে। সময়ের নিকট অনুনয় কর, একে ভয় দেখাও, ভ্রুক্ষেপও করবে না, সময় চলে যাবে আর ফিরবে না। নষ্ট স্বাস্থ্য ও হারানো ধন পুনঃপ্রাপ্ত হওয়া যায়। কিন্তু সময় একবার গত হয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। গত সময়ের জন্য অনুশোচনা করা নিষ্ফল। যতই কাঁদ না কেন, গত সময় কখনও ফিরে আসবে না।
সারাংশ : সময় থেমে থাকে না। স্বাস্থ্য ও ধন হারালে তা পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু যে সময় চলে গেছে তা আর ফিরে পাওয়া যায়না। তাই সময়ের কাজ সময়ে করা উচিত।