সারাংশ (১ থেকে ৫০)
সারাংশ (৫১ থেকে ১০০)
সারাংশ (১০১ থেকে ১৫০)
সারাংশ (১৫১ থেকে ২০০)
১৫১
সময়ের যারা সদ্ব্যবহার করে, তারা জিতবেই। সময়েই টাকা, সময় টাকার চেয়েও বেশি। জীবনকে উন্নত করো কাজ করে। জ্ঞান অর্জন করো। চরিত্রকে ঠিক করে বসে থাকো। কৃপণের মতো সময়ের কাছ থেকে তোমার পাওয়া বুঝে নাও। এক ঘন্টা করে প্রতিদিন নষ্ট করো, বৎসর শেষে গুণে দেখো, অবহেলায় কত সময় নষ্ট হয়েছে। এক ঘন্টা করে প্রতিদিন একটু কাজ করো, দেখবে বৎসর শেষে, এমনকী মাসে কত কাজ তোমার হয়েছে। তোমার কাজ দেখে তুমি নিজেই বিস্মিত হবে।
সারাংশ : মানুষের জীবনে সময় অত্যন্ত মূল্যবান। সময় সম্পর্কে সচেতন হয়ে সে অনুযায়ী কাজ করলে তা মানুষের জীবনে সুফল বয়ে নিয়ে আসে। তাই জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্য সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য।
১৫২
সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্যে মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। স্বল্পপ্রাণ স্থুল বুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়। অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি। এদের একমাত্র দেবতা অহংকার। পারিবারিক অহংকার, জাতিগত অহংকার- এ সবের নিশান উড়ানোই এদের কাজ।
সারাংশ : সমাজের কাজ কেবল মানুষকে টিকিয়ে রাখা নয়। তার কাজ হলো মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তোলা, জীবনকে বিকশিত করার আগ্রহ সৃষ্টি করা। মনুষ্যত্ববোধ বিবর্জিত মানুষে আমাদের সমাজ পরিপূর্ণ। এ ধরনের মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথ সৃষ্টি করে দেওয়ার দায়িত্ব সমাজেরই।
১৫৩
সমাজে নারীরা পুরুষের দাসী। দাসী অর্থ যার কোনো ধরনের স্বাধীনতা নেই। প্রভু যা বলবে তাই করবে। এই যে আজ্ঞাবহ দাসী, সে একেবারেই পরাধীন। এ নারী প্রেমিকা নয়, জায়া নয়, জননী নয়, সহযোগিনী নয় বা অর্ধাঙ্গীও নয়। অর্ধাঙ্গী অর্থ তার পুরুষের সমান অধিকার আছে। স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের সমাজে তা নেই তাদেরকে জ্ঞানের আলো দান করা হতো না। অজ্ঞান করে রাখা হতো, ঘরের বাইরে বের হতে দেয়া হতো না। কঠিন পর্দার মধ্যে রাখা হতো। মানসিকভাবে তারা ছিল একেবারে প্রতিবন্ধী। যেমন সীতা। সীতার আপন সত্তা বলতে কিছু ছিল না। সে রামের হাতের খেলার পুতুল ছিল।
সারাংশ : সমাজ নারীদেরকে পুরুষের অধীনস্ত করে দাসীর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। স্বাধীনতাহীন নারী জাতি কোন কালেই পুরুষের কাছে কোন মর্যাদা পায়নি। রামের কাছে সীতাও ছিল খেলার পুতুলের ন্যায়।
১৫৪
সৎ হইলে, সাধু হইলে, পুণ্য করিলে মৃত্যুর পর ওই অনন্তকাল ধরিয়া অনন্ত শান্তি, অনন্ত তৃপ্তি ভোগ করিবে, আর এ জীবনে পাপ করিলে, রাক্ষস-পিশাচ-অধম জীবন যাপন করিলে কেবল অর্থ সঞ্চয়, সুখভোগ ও কামনা পূরণ লইয়াই দীর্ঘতম একশত বৎসরের মানবজীবন কাটাইয়া দিলে ঐ অনন্তকাল ধরিয়া অন্তরে বাহিরের তীব্রতম জ্বালাময় নরক আগুনে জ্বলিয়া মরিবে- একথা কি বিশ্বাস কর মানুষ?
সারাংশ : পরকালে মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। পার্থিব জীবনের কর্মফল সবাই অনন্তকাল ধরে ভোগ করবে। ভাল কাজের জন্য সুখ-শান্তি আর মন্দ কাজের জন্য সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট নির্ধারিত রয়েছে পরকালে।
১৫৫
সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাহিত্যের উদ্দেশ্যে মানুষের অন্তরস্থ বিবেককে জাগিয়ে তোলা- নির্ভীক, তেজস্বী ও সবল করে তোলা। যদি জ্ঞান, উপদেশ, পুস্তক এবং সাহিত্য মানুষের অন্তরকে জাগাতে না পারে, তাকে চিন্তাশীল করে তুলতে না পারে, তাকে আত্মবোধ না দিতে পারে, তবে বুঝতে হবে তার পাষাণ প্রাণে সমস্ত জ্ঞান ব্যর্থ হয়েছে। বিবেকের জাগরণের নামই আত্মবোধ। বিবেক অপেক্ষা আরও একটি মহৎ জিনিস আছে, তার নাম প্রজ্ঞা। বিবেক মানুষকে প্রতারণা করে, প্রজ্ঞা কোনো সময় মানুষকে প্রতারণা করে না। প্রজ্ঞা দিবালোকের মতো উজ্জ্বল, তার দৃষ্টির সম্মুখে কুয়াশা নেই, সন্দেহ নেই। প্রজ্ঞা ধ্রুব সত্যকে দর্শন করে। যিনি এই প্রজ্ঞার সন্ধান পেয়েছেন তিনি পরম চেতনা লাভ করেছেন, তিনি মানুষের পরম শ্রদ্ধার্হ।
সারাংশ : জ্ঞান ও সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের বিবেককে জাগ্রত করা, তাকে সাহসী, তেজস্বী ও সবল করে তোলা। প্রজ্ঞা বিবেক অপেক্ষাও মহৎ। প্রজ্ঞার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। আর প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সকলের শ্রদ্ধা লাভ করেন।
১৫৬
সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবহার বন্ধ করিয়া, একঘরে হইয়া দুই বেলা দুই মুঠা ভাত বেশি করিয়া খাইয়া নিন্দ্রা নিলেই তো চলিবে না। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে দেনা পাওনা করিয়া তবে আমরা মানুষ হইতে পারিব। যে জাতি তাহা না করিবে, বর্তমান কালে সে টিকিতে পারিবে না। তাই আমাদের দেশে চাষের ক্ষেতের ওপর সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের আলো ফেলিবার দিন আসিয়াছে। আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই। আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে। আজ শুধু চাষীর লাঙ্গলের ফলার সঙ্গে আমাদের দেশের মাটির সংযোগ যথেষ্ট, সমস্ত দেশের বুদ্ধির সঙ্গে, বিদ্যার সঙ্গে, অধ্যবসায়ের সঙ্গে তাহার সংযোগ হওয়া চাই।
সারাংশ : বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে গোটা পৃথিবীর সাথে আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজের দেশকে উন্নত করে তুলতে হবে। কৃষিক্ষেত্রেও জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আজকের দিনে কৃষির সাথে কেবল মাটির সংযোগ যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি বিদ্যা, বুদ্ধি এবং অধ্যবসায়ের সংযোগ অপরিহার্য।
১৫৭
সাধারণ মানুষ পুত্র পরিবারের সুখের জন্য হৃদয়ের রক্ত ঢালে, মহাপুরুষ মানুষের মঙ্গল তরে জীবন শোণিত প্রদান করেন। অন্যের জন্য জীবন ধারণে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সার্থকতা, অন্যের মধ্যে ডুবিয়া ও মুছিয়া যাওয়া মানুষের পূর্ণানন্দময় পরিনাম। আত্ম লইয়া আমি তৃপ্ত নহি, জীবন আমার আর কাহাকেও নিবেদন করিতে চাই। কে আমার বাঞ্ছিতজন, কাহাকে আমার জীবন দিয়া জন্ম আমার সার্থক করিব? ক্ষুদ্র লইয়া আমি বাঁচিতে পারি না, নিজেই যে ভাঙ্গিয়া ও মুছিয়া যায়, তাহার মধ্যে ডুবিয়া আমার প্রাণের তৃষ্ণা মিটিতে পারে না। আমি চাই চিরসত্য ও চিরানন্দ, মরণে মহাজীবন। চাই সর্বাপেক্ষা মহৎ ও মধূর যে, আমার উৎস ও লক্ষ্য যে, সেই পরম পবিত্র মহামহীয়ান প্রভুর কাছেই সর্বস্ব আমার লুণ্ঠিত করি, তাঁহারই মধ্যে অস্তিত্ব আমার লুপ্ত করিয়া অক্ষয় আনন্দে মগ্ন হই।
সারাংশ : অন্যের আনন্দে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে তৃপ্ত হয় মানবাত্মা। হৃদয়ের আকুতি তাই পরার্থে নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ।
১৫৮
সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্যে খেলনা তৈরি করতে বসেন। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে, তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়। কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের ছুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রাঙালাঠি, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল, নীতির টিনের ভেঁপু এবং ধর্মের জয়ঢাক-এইসব জিনিসে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে। সাহিত্যরাজ্যে খেলনা পেয়ে পাঠকের মনতুষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা গড়ে লেখকের মনতুষ্টি হতে পারে না।
সারাংশ : মনতুষ্টি ও মনোরঞ্জন এক নয়। বিপরীতমুখী মেরুতে এ দুটির অবস্থান। সাহিত্যিকদের কাজ পাঠকের মনতুষ্টি দায়ক সাহিত্য রচনা করা, সাময়িক মনোরঞ্জন নয়। নিম্নমানের সাহিত্য রচনার মাধ্যমে হয়ত ভানুমতির খেলার মত ক্ষণিকের আকর্ষণ পাওয়া যায়, সাহিত্যাকাশের মহৎ শিল্পী হওয়া যায় না।
১৫৯
স্বাধীন হবার জন্য যেমন সাধনার প্রয়োজন, তেমনি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতার। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন জাতি যতই চেষ্টা করুক, তাহাদের আবেদন নিবেদনে ফল হয় না। যে জাতির অধিকাংশ ব্যক্তি মিথ্যাচারী, সেখানে দু-চার জন সত্যনিষ্ঠকে বহু বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়। দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু মানুষ জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে, সে কষ্ট সহ্য না করে উপায় নেই।
সারাংশ : কঠোর সাধনার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। আবার স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা এবং ন্যায়পরায়নতা। যে দেশে মিথ্যাচারীর সংখ্যা বেশি সে দেশে মুষ্টিমেয় সত্যনিষ্ঠকে অনেক যন্ত্রণা এবং দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু জাতিকে মর্যাদাবান করে তোলার জন্য এ দুর্ভোগ সহ্য না করে উপায় নেই।
১৬০
স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্বলতাবশত নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ প্রভু হইতে পারে না। জগতে দেখিতে পাই প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট কোনো-না-কোনো প্রকার সাহায্য প্রার্থনা করে, যেন একে অপরের সাহায্য ব্যতীত চলিতে পারে না। তরুলতা যেমন বৃষ্টির সাহায্যপ্রার্থী মেঘও সেইরূপ তরুর সাহায্য চায়। জলবৃদ্ধির নিমিত্ত নদী বর্ষার সাহায্য পায়, মেঘ আবার নদীর নিকট ঋণী। তবে তরঙ্গিনী কাদম্বিনীর স্বামী, না কাদম্বিনী তরঙ্গিণীর স্বামী? এ স্বাভাবিক নিয়মের কথা ছাড়িয়া কেবল সামাজিক নিয়মে দৃষ্টিপাত করিলেও আমরা তাহাই দেখি- কেহ সূত্রধর, কেহ অন্তুবায় ইত্যাদি। একজন ব্যারিস্টার ডাক্তারের সাহায্যপ্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিস্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিস্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিস্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে স্বামী বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে স্বামী ভাবিবেন কেন?
সারাংশ : পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পুরুষকে নারীর প্রভু হিসেবে বিবেচনা করাটা অযৌক্তিক। সমাজের প্রতিটি মানুষই তো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই বিবেচনায় পুরুষ ও নারী একে অপরের সহযোগী, প্রভু নয়।
১৬১
সুখ প্রতিদিনের সামগ্রী, আনন্দ প্রত্যহের অতীত। সুখ শরীরের কোথাও পাছে ধুলা লাগে বলিয়া সংকুচিত। আনন্দ ধুলায় গড়াগড়ি দিয়া নিখিলের সঙ্গে আপনার ব্যবধান ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দেয়। এইজন্য সুখের পক্ষে ধুলা হেয়, আনন্দের পক্ষে ধুলা ভূষণ। সুখ কিছু হারায় বলিয়া ভীত। আনন্দ যথাসর্বস্ব বিতরণ করিয়া পরিতৃপ্তি। এইজন্যে সুখের পক্ষে রিক্ততা দারিদ্র্য, আনন্দের পক্ষে দারিদ্র্যই ঐশ্বর্য। সুখ ব্যবস্থার বন্ধনের মধ্যে আপনার শ্রীটুকুকে সতর্কভাবে রক্ষা করে। আনন্দ সংসারের মুক্তির মধ্যে আপন সৌন্দর্যকে উদারভাবে প্রকাশ করে। এইজন্য সুখ বাহিরের নিয়মের মধ্যে বদ্ধ, আনন্দ সে বন্ধন ছিন্ন করিয়া আপনার নিয়ম আপনি সৃষ্টি করে। সুখ সুধাটুকুর জন্য তাকাইয়া বসিয়া থাকে। আনন্দ-দুঃখের বিষয়কে অনায়াসে পরিপাক করিয়া ফেলে। এইজন্য কেবল ভালোটুকুর দিকেই সুখের পক্ষপাত- তার আনন্দের পক্ষে ভালোমন্দ দুই-ই সমান।
সারাংশ : সুখ এবং আনন্দ মানব মনের দুটি ভিন্ন অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। ইন্দ্রিয়জ প্রাপ্তি এবং ভোগের মধ্যে সুখ সীমাবদ্ধ। কিন্তু আনন্দ ইন্দ্রিয়জ সুখ অতিক্রান্ত হৃদয়ের ভিন্নতর এক উপলব্ধি। সুখ কেবল ভালোকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে আনন্দের কাছে ভালো-মন্দ উভয়ই সমান।
১৬২
সুখ দুঃখের অভাব মাত্র। আর সুখের নিরপেক্ষ অস্তিত্বই যদি স্বীকার করা যায়, তাহাতেই বা কী দেখা যায় ? ধরো, সুখও আছে, দুঃখও আছে। কিন্তু সুখের তীব্রতা নাই। দুঃখের তীব্রতা আছে। সুখ যত স্থায়ী হয়, তত কমে; দুঃখ যত থাকে, তত বাড়ে। এমনকী অতিরিক্ত সুখ দুঃখ হইয়া দাঁড়ায়, দুঃখকে সুখ হইতে কখনও দেখা যায় না। সংসারে চাহিয়া দেখো, শোক, হিংসা, ঈর্ষা আর পরিতাপ সবই দুখঃময়; যৌবনের স্বাধীনতা দুঃখের তৎকালীন অভাবমাত্র। ধনমান প্রায় সুখের আশা দেয়; কিন্তু আনে দুঃখ, স্নেহ, দয়া ও মমতা। ইহারা অধিকাংশ দুঃখেরই মূল। জ্ঞান-ধর্ম তাহারা তো অন্তদৃষ্টির প্রসার বাড়াইয়া অনুভূতির তীক্ষ্মতা জন্মাইয়া দুঃখভোগেরই সুবিধা করিয়া দেয়। যে জ্ঞানী, যে ধার্মিক তাহার দুঃখভোগ শক্তি অধিক। তাহার দুঃখও অধিক। মানুষেরই তো দুঃখ, কাঠ-পাথরের আবার দুঃখ কী ?
সারাংশ : মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ উভয়ই আছে। সুখের তীব্রতা না থাকলেও দুঃখের অনুভূতি অত্যন্ত তীব্র। সংসারে সকল কিছুই দুঃখময়। অনেকে মনে করে বিত্তে অপরিসীম সুখ। কিন্তু বিত্তের সুখ মানুষের দুঃখকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ধার্মিক এবং জ্ঞানী ব্যক্তির দুঃখানুভূতি সাধারণ মানুষ অপেক্ষা তীক্ষ্ম।
১৬৩
সুন্দর হওয়ার অর্থ কেবল গায়ের রংটি ফর্সা, কোকড়ানো চুল আর টানা চক্ষুই নয়। যাহার যেমন চেহারা থাকুক, তাহাকে থাকিতে হইবে পরিচ্ছন্ন। দাঁত মাজিয়া ঝকঝকে রাখিয়া, জামাকাপড় যাহার যেমন আছে সুন্দর করিয়া সেগুলো পরো। তাহা হইলে তুমি দেখিতে সুন্দর হইবে। কিন্তু সুন্দর হওয়ার বড় কথা হইতেছে চরিত্র। ফুল দেখিতে ভারি সুন্দর- তোমার চক্ষু জুড়াইয়া যায় ফুল দেখিয়া। ফুলের গন্ধটা আবার আরও চমৎকার। তোমার মন ভরিয়া ওঠে গন্ধে। কেবল দেখিতেই যদি সুন্দর হইত, সুন্দর গন্ধ যদি ইহার না থাকিত, তুমি কি ফুলকে এত আদর করিতে ?
সারাংশ : পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর সৎ চরিত্রের দ্বারা মানুষের সৌন্দর্য নির্ধারিত হয়। কেবল দৈহিক সৌষ্ঠব মানুষের সৌন্দর্যের পরিচায়ক নয়। শুধু বাহিরের সৌন্দর্য নয়, অন্তরের সৌন্দর্য মানুষকে মহৎ করে তোলে।
১৬৪
তবে কি সাহিত্যের উদ্দেশ্য লোককে শিক্ষা দেওয়া? অবশ্য নয়। কেননা কবির মতিগতি শিক্ষকের মতিগতির সম্পূর্ণ বিপরীত। স্কুল না বন্ধ হলে যে খেলার সময় আসে না, এ তো সকলেরই জানা কথা। কিন্তু সাহিত্য রচনা যে আত্মার লীলা, এ কথা শিক্ষকেরা স্বীকার করতে প্রস্তুত নন। সুতরাং শিক্ষা ও সাহিত্যের ধর্মকর্ম যে এক নয়, এ সত্যটি একটু স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া আবশ্যক। প্রথমত শিক্ষা হচ্ছে সেই বস্তু যা লোকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলধঃকরণ করতে বাধ্য হয়, অপর পক্ষে কাব্যরস লোকে শুধু স্বেচ্ছায় নয় সানন্দে পান করে, কেননা শাস্ত্রমতে সে রস অমৃত। দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো, কাব্য যে সংবাদপত্র নয়, একথা সকলেই জানেন। তৃতীয়ত অপরের মনের অভাব পূর্ণ করবার উদ্দেশ্যেই শিক্ষকের হস্তে শিক্ষা জন্মলাভ করছে, কিন্তু কবির নিজের মনের পরিপূর্ণতা হতেই সাহিত্যের উৎপত্তি।
সারাংশ : প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করে সাহিত্য। একান্ত বাধ্য হয়ে মানুষ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে, কিন্তু সাহিত্যের কাছ থেকে সে প্রত্যাশা করে আনন্দ। শিক্ষা সংবাদপত্র মানুষকে তথ্য দিয়ে থাকে অপরদিকে সাহিত্য মানুষের হৃদয়কে জাগ্রত করে। শিক্ষক যেখানে অন্যের মনের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ব্যস্ত থাকেন, কবি সেখানে আপন মনের খেয়ালে কাব্য রস সৃষ্টি করেন।
১৬৫
সাহিত্যজগতে যাঁদের খেলা করবার প্রবৃত্তি আছে, সাহস আছে, ক্ষমতা আছে, মানুষের নয়ন-মন আকর্ষণ করবার সুযোগ বিশেষ করে তাদের কপালেই ঘটে। মানুষ যে খেলা দেখতে ভালোবাসে তার পরিচয় তো আমরা এই জড় সমাজেও নিত্য পাই। টাউনহলে বক্তৃতা শুনতেই বা কজন যায় আর গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতেই বা কজন যায়। অথচ এ কথাও সত্য যে, টাউনহলে বক্তৃতার উদ্দেশ্য অতি মহৎ, আর গড়ের মাঠের খেলোয়াড়দের ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি আগাগোড়া অর্থশূন্য এবং উদ্দেশ্যবিহীন। আসল কথা এই যে, মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যহীন। মানুষ যখন খেলা করে, তখন সে এক আনন্দ ব্যতীত অন্য কোনো ফলের আকাক্সক্ষা রাখে না। যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরি পাওয়ার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, জুয়াখেলা এবং যেহেতু খেলার আনন্দ নিরর্থক অর্থাৎ অর্থগত নয়, সে কারণ তা কারও নিজস্ব হতে পারে না। এ আনন্দে সকলেরই অধিকার সমান।
সারাংশ : মানুষ সাহিত্যের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ফল প্রাপ্তির চেয়ে অনির্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করতে চায়। যার দক্ষতা আছে এ খেলায় সেই দর্শক মনোরঞ্জনের সফলতা লাভ করে। সাহিত্য ও খেলায় মধ্যে ব্যক্তিগত লাভলাভের প্রশ্ন জড়িত নেই বলেই আনন্দে সবারই অধিকার আছে।
১৬৬
পথ-পার্শ্বের-ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের বহু মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে-ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদের মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে এক তরুণেরই। খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত রখিল, সে যত মোনাজাতই করুক, খোদা তাহা কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়াছেন বেহেশত ও বেহেশতি চিজ অর্জন করিয়া লইবার জন্য, ভিখারীর মতো হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়। আমাদের পৃথিবী আমরা আমাদের মনের মতো করিয়া গড়িয়া লইব। ইহাই হউক তরুণের সাধনা।
সারাংশ : এক কালে ধর্ম মানুষের কল্যাণে এলেও এখন সময়ের আবর্তে সেই ধর্ম উপযোগিতা হারিয়ে মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করুণা লাভের প্রত্যাশা না করে তরুণদেরই এই মৃতপ্রায় ব্যাবস্থাকে পাল্টে দিয়ে নিজেদের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে নিতে হবে।
১৬৭
মানুষের জীবনে ভাষার স্থান যে কত বড়ো তা আমরা খুব কমই ভেবে থাকি। আমরা যেমন খাইদাই ওঠা বসা করি ও হেঁটে বেড়াই, তেমনি সমাজজীবন চালু রাখবার জন্যে কথা বলি, নানা বিষযে নানা ভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিকতা বজায় রাখতে হলে তার প্রধান উপায় কথা বলা, মুখ খোলা, আওয়াজ করা। একে অন্যের সঙ্গে, সম্বন্ধ যেমনই হোক না কেন-শত্রুতার কি ভালোবাসার, চেনা কি অচেনার, বন্ধুত্বের কিংবা মৌখিক আলাপ-পরিচয়ের, মানুষের সঙ্গে মানুষের যেকোনো সম্বন্ধ স্থাপন করতে গেলেই মানুষ মাত্রকেই মুখ খুলতে হয়, কতগুলো আওয়াজ করতে হয়। সে আওয়াজ বা ধ্বনিগুলোর একমাত্র শর্ত হচ্ছে যে সেগুলো অর্থবোধক হওয়া চাই। অর্থহীন ধ্বনিও অবশ্য মানুষ করতে পারে কিন্তু তাতে সমাজজীবন চলে না।
সারাংশ : অর্থপূর্ণ ধ্বনি সমষ্টি মানুষের ভাষা। যার সাহায্যে সে এই পৃথিবীতে মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে।
১৬৮
সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। স্বল্পপ্রাণ, স্থূল বুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করে নি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃত বুদ্ধির। এদের একমাত্র দেবতা অহংকার। পারিবারিক অহংকার, জাতিগত অহংকার-এসবের নিশান উড়ানোই এদের কাজ।
সারাংশ : ভালো-মন্দ মানুষ নিয়েই সমাজ গঠিত। যারা মন্দ তাদের মধ্যে অহংকার রিপু প্রবল। এর ফলে সমাজে উন্নতি হয় বিঘ্নিত। তাদের প্রেমহীন নিষ্ঠুর আচরণ অশান্তির সৃষ্টি করে। এদেরকে উন্নত জীবনে ফিরিয়ে আনা সমাজের কাজ।
১৬৯
অনেকে বলে, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চর্ব্যচোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারিখানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট। আর বেশি আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে, আবশ্যক আছে, যেহেতু মাতার দোষ-গুণ লাইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক বালক শিক্ষকের বেত্রতাড়নায় কণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফ.এ.বি.এ পাস হয় বটে কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে। তাহাদের বিদ্যার পরীক্ষায় এ কথার সত্যতার উপলব্ধি হইতে পারে।
সারাংশ : মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার বিরোধিতা করে অনেকই রান্নাবান্না গৃহকত্রী ও সামান্য শিক্ষার কথা বলে থাকে। কিন্তু সন্তানকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে মাকেও উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
১৭০
জীবনের একটি প্রধান লক্ষণ হাসি ও আনন্দ। যার প্রত্যেক কাজে আনন্দ স্ফূর্তি তার চেয়ে সুখী আর কেউ নয়। জীবনে যে পুরোপুরি আনন্দ ভোগ করতে জানে আামি তাকে বরণ করি। স্থূল দৈনন্দিন কাজের ভেতর সে এমন একটা কিছুর সন্ধান পেয়েছে যা তার নিজের জীবনকে সুন্দর ও শোভনীয় করেছে এবং পারিপার্শ্বিক দশ জনের জীবনকে উপভোগ্য করে তুলেছে। এই যে এমন একটা জীবনের সন্ধান যার ফলে সংসারকে মরুভূমি বোধ না হয়ে ফুলবাগান বলে মনে হয়। সে সন্ধান সকলের মেলে না। যার মেলে সে পরম ভাগ্যবান। এরূপ লোকের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখান থেকে কলুষ বর্বরতা আপনাআপনি দূরে পালায়। সেখানে প্রেম, পবিত্রতা সর্বদা বিরাজ করে।
সারাংশ : সংসারের প্রত্যেকটি কাজের মধ্যে আমাদের আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। যে হাসি আনন্দে নিজের জীবনকে ভরিয়ে তুলতে পারে সে জগৎটাকেও আনন্দময় করে তোলে। এ রকম মানুষই পৃথিবীকে পাপ পঙ্কিলতা মুক্ত করে প্রেমময় করে তোলে।
১৭১
বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক, তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনো মতে কাজ চলে মাত্র; কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে, কিন্তু আহারটি রীতিমতো হজম করিবার জন্য হাওয়ার দরকার। তেমনি একটি শিক্ষা পুস্তককে রীতিমতো হজম করিতে অনেকগুলি অপাঠ্য পুস্তকের সাহায্য আবশ্যক। ইহাতে আনন্দের সহিত পড়িতে পারিবার শক্তি অলক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। গ্রহণশক্তি, ধারণশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে ফল লাভ করে।
সারাংশ : আনন্দহীন শিক্ষাগ্রহণ মানুষের যথাযথ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। আবশ্যক বিষয়ের বাইরে আনন্দদায়ক লেখা পড়া মানুষের চিন্তাশক্তিকে ও ধারণশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। শিক্ষার প্রকৃত ফল লাভ তখনই সম্ভব হয়।
১৭২
অভাব আছে বলিয়াই জগৎ বৈচিত্র্যময়। অভাব না থাকিলে জীব-সৃষ্টি বৃথা হইত। অভাব আছে বলিয়াই অভাব পূরণের জন্য এত উদ্যম, এত উদ্যোগ। আমাদের সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়াই কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলকেই স্থানু, স্থবির হইতে হইত, মনুষ্য-জীবন বিড়ম্বনাময় হইত। মহাজ্ঞানীরা জগৎ হইতে দুঃখ দূর করিবার জন্য ব্যগ্র। কিন্তু জগতে দুঃখ আছে বলিয়াই তো আমরা সেবার সুযোগ পাইয়াছি। সেবা মানবজীবনের ধর্ম। দুঃখ আছে বলিয়াই সে সেবার পাত্র যত্রতত্র সদাকাল ছাড়াইয়া রহিয়াছে। যিনি অন্নদান, বস্ত্রদান, জ্ঞানদান, বিদ্যাদান করেন, তিনি যেমন জগতের বন্ধু তেমনি যিনি দুঃখে আমাদের সেবার পাত্রে অজস্র দান করিতেছেন, তিনিও মানবের পরম বন্ধু। দুঃখকে শত্রু মনে করিও না, দুঃখ আমাদের বন্ধু।
সারাংশ : অভাববোধই মানুষের জীবনকে কর্মমুখর করে তুলেছে। অভাব না থাকলে জীবন নিশ্চল হয়ে পড়তো, দেখা দিত বিড়ম্বনা। মহামানবেরা এই অভাব দূর করবার জন্যই অন্ন, বস্ত্র, জ্ঞান, বিদ্যা ও সেবা নিয়ে মানুষের বন্ধু হয়ে আসে। অভাবের মতো দুঃখও মানুষকে আজ বড় করে তুলছে।
১৭৩
অনেকের ধারণা এই যে, মহৎব্যক্তি শুধু উচ্চবংশেই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন, নিচুকূলে মহতের জন্ম হয় না। কিন্তু প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করিলেই দেখা যায় যে, মানুষের ধারণা অতিশয় ভ্রমাত্মক। পদ্মফুল ফুলের রাজা। রূপে গন্ধে সে অতুলনীয়। কিন্তু ইহার জন্ম হয় পানের অযোগ্য পানিভরা এঁদো পুকুরে। পক্ষান্তরে বটবৃক্ষ মধ্যে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বটে, অথচ বহু বৃক্ষের ফল আমরা আস্বাদন করি, এত খ্যাতনামা যে বটগাছ, তাহার ফল আমাদের অখাদ্য।
সারাংশ : বংশ পরিচয় নয়, কর্মই মানুষকে মহৎ করে তোলে। জন্ম পরিচয় যত নিচুস্তরেই হোক না কেন মানুষের জন্য কাজ করলে পৃথিবীতে তার আসন অটুট হয়ে থাকবে।
১৭৪
কথায় কথায় মিথ্যাচারণ, বাক্যের মূল্যকে অশ্রদ্ধা করা- এসব সত্যনিষ্ঠ স্বাধীন জাতির লক্ষণ নয়। স্বাধীন হবার জন্য যেমন সাধনার প্রয়োজন, তেমনি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতার। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন জাতি যতই চেষ্টা করুক তাদের আবেদন-নিবেদন আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না, তাদের স্বাধীনতার দ্বার থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হবে। যে জাতির অধিকাংশ ব্যক্তি মিথ্যাচারী, সেখানে দু/একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির বহু বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে। কিন্তু মানবকল্যাণের জন্য, সত্যের জন্য যে বিড়ম্বনা ও নিগ্রহ তা সহ্য করতেই হবে।
সারাংশ : বহু সাধনায় অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে জাতিকে ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠ হতে হয়। জাতির অধিকাংশ মানুষ মিথ্যাচারী হলে দু’একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষকে পীড়ন সহ্য করে ও মানবকল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হয়।
১৭৫
কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেছ? সৎ আকাক্সক্ষা। তোমরা শিখবে বলে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছ। কি শিখতে হবে ভেবে দেখ। পাখি তার মা-বাপের কাছে কি শিখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কি করে বড় করে আকাক্সক্ষা করতে হয়। পেট ভরাতে হবে-এ শিখবার জন্য বেশি সাধনার দরকার নেই, কিন্তু পুরোপুরি মানুষ হতে হবে-এই শিক্ষার জন্য যে অপরিমিত আকাক্সক্ষা দরকার শেষ পর্যন্ত তা জাগিয়ে রাখবার জন্য প্রয়োজন মানুষের শিক্ষা।
সারাংশ : শুধু ক্ষুধা নিবৃত্তি শিক্ষার কাজ নয়, শিক্ষা মানুষের অন্তরলোকের বিস্তার ঘটায়। পাখি যেমন তার পিতা মাতার কাছে উড়তে শেখে আমাদেরও তেমনি মনের পাখায় ভর করে তীব্র জীবনাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠতে হবে।
১৭৬
মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিবার উপায় জগতের একটি প্রাণীরও নাই। সুতরাং এই অবধারিত সত্যকে সানন্দে স্বীকার করিয়া নিয়াও মৃত্যুকে জয় করিবার জন্য একটি বিশেষ কৌশল আয়ত্ত করিতে হইবে। তাহা হইতেছে, অতীতের পূর্বপুরুষদের সাধনাকে নিজের জীবনে এমনভাবে রূপবন্ত করা যেন ইহার ফলে তোমার বা আমার মৃত্যুর পরেও সেই সাধনার শুভফল তোমার পুত্রাদিক্রমে বা আমার শিষ্যাদিক্রমে জগতের মধ্যে ক্রমবিস্তারিত হইতে পারে। মৃত্যু তোমার দেহকে মাত্র ধ্বংস করিতে পারিল, তোমার আরদ্ধ সাধনার ক্রমবিকাশকে অবরুদ্ধ করিতে পারিল না,-এইখানেই মহাবিক্রান্ত মৃত্যুর আসল পরাজয়।
সারাংশ : মৃত্যু চিরন্তন। কিন্তু মানুষ নিজ কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারে। এভাবেই মানুষ মৃত্যুকে জয় করে অমর হতে পারে।
১৭৭
মাতৃস্নেহের তুলনা নাই, কিন্তু অতি স্নেহ অনেক সময় অমঙ্গল আনয়ন করে। যে স্নেহের উত্তাপে সন্তানের পরিপুষ্টি, তাহারই আধিক্যে সে অসহায় হইয়া পড়ে। মাতৃহৃদয়ের মমতার প্রাবল্যে মানুষ আপনাকে হারাইয়া আপন শক্তির মর্যাদা বুঝিতে পারে না। নিয়ত মাতৃস্নেহের অন্তরালে অবস্থান করিয়া আত্মশক্তির সন্ধান সে পায় না-দুর্বল, অসহায় পক্ষীশাবকের মতো চিরদিন স্নেহাতিশয্যে আপনাকে সে একান্ত নির্ভরশীল মনে করে। ক্রমে জননীর পরম সম্পদ সন্তান অলস, ভীরু, দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হইয়া মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ হইতে দূরে সরিয়া যায়। অন্ধ মাতৃস্নেহ সে কথা বুঝে না-অলসকে সে প্রাণপাত করিয়া সেবা করে-ভীরুতার দুর্দশা কল্পনা করিয়া বিপদের আক্রমণ হইতে ভীরুকে রক্ষা করিতে ব্যর্থ হয়।
সারাংশ : সন্তানের জন্য মাতৃস্নেহ প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত স্নেহ পরিণামে সন্তানের জন্য অমঙ্গলই বয়ে আনে। অন্ধ মাতৃস্নেহের সুযোগে আত্মশক্তির, মানুষ্যত্বের বিকশে বাধাগ্রস্থ হয়, সন্তান হয়ে পড়ে পরনির্ভরশীল।
১৭৮
ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই হল জ্ঞানীর কাজ। পিপঁড়ে-মৌমাছি পর্যন্ত যখন ভবিষ্যতের জন্য ব্যতিব্যস্ত, তখন মানুষের কথা বলাই বাহুল্য। ফকির-সন্ন্যাসী যে ঘরবাড়ী ছেড়ে, আহার-নিদ্রা ভুলে, পাহাড়-জঙ্গলে চোখ বুজে বসে থাকে, সেটা যদি নিতান্ত গঞ্জিকার কৃপায় না হয়, তবে বলতে হবে ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে। সমস্ত জীব-জন্তুর দুটো চোখ সামনে থাকবার মানে হল ভবিষ্যতের দিকে যেন নজর থাকে। অতীতের ভাবনা ভেবে লাভ নেই। পণ্ডিতেরা তা বলে গেছেন, ‘গতস্য শোচনা নাস্তি’। আর বর্তমানে নেই বললেই চলে। এই যেটা বর্তমান সেই-এই কথা বলতে বলতে অতীত হয়ে গেল। কাজেই তরঙ্গ গোণা আর বর্তমানের চিন্তা করা সমানই অনর্থক। ভবিষ্যত হল আসল জিনিস। সেটা কখনও শেষ হয় না। তাই ভবিষ্যতে মানব কেমন হবে সেটা একবার ভেবে দেখা উচিত।
সারাংশ : ভবিষ্যতই মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। বর্তমান প্রতি মুহূর্তে অতীতের গহ্বরে মিশে যায়। অফুরন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ। জ্ঞানীদের মতো ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে কাজ করতে পারলেই জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে।
১৭৯
রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় আর কটি লোক। শতকরা নিরানব্বইটি মানুষকেই চেষ্টা করতে হয়, জয় করে নিতে হয় তার ভাগ্যকে। বাঁচে সেই যে লড়াই করে প্রতিকূলতার সঙ্গে। পলাতকের স্থান জগতে নেই। সমস্ত কিছুর জন্যই চেষ্টা দরকার। চেষ্টা ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। সুখ চেষ্টারই ফল-দেবতার দান নয়। তা জয় করে নিতে হয়। আপনা আপনি এটা পাওয়া যায় না। সুখের জন্য দু’রকম চেষ্টা দরকার, বাইরের আর ভিতরের। ভিতরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্য একটি। বৈরাগ্যও চেষ্টার ফল, তা অমনি পাওয়া যায় না। কিন্তু বাইরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্যের স্থান নাই।
সারাংশ : জীবনের লড়াই থেকে পালিয়ে বাঁচবার সুযোগ নেই। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই জয়কে সুনিশ্চিত করতে হয়। সফলকাম হতে হলে মানুষকে বাইরের-ভিতরের দুই সংগ্রামের চেষ্টা চালাতে হয়।
১৮০
নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কি থাকিত? একটা ভাল কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না, -সে ভাল কাজের দাম কি! একটা ভাল কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাই-ভাল গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কি হতে পারে? জীবনকে ধর্মচর্চায় উৎসর্গ করিলাম, যদি কোন মন্দ লোক তাহার মধ্যে মন্দ অভিপ্রায় না দেখিল, তবে সাধুতা যে নিতান্তই সহজ হইয়া পড়িল। মহত্ত্বকে পদে পদে কাটা মাড়াইয়া চলিতে হয়। ইহাতে যে হার মানে, বীরের সদগতি সে লাভ করে না। পৃথিবীতে নিন্দা দোষীকে সংশোধন করিবার জন্য আছে-তাহা নহে, মহত্ত্বকে গৌরব দেওয়া তাহার একটা মস্ত কাজ।
সারাংশ : নিন্দুকের নিন্দা মানুষের কাজকে আরো মহিমান্বিত করে তোলে। নিন্দার কাঁটা পায়ে বিঁধে মানুষকে মহৎ কাজে জীবন উৎসর্গ করতে হয়। এতে তার বীরত্বেরই প্রকাশ ঘটে। সে অর্থে মহত্ত্বের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে নিন্দা।
১৮১
ক্রোধ মানুষের পরম শত্রু। ক্রোধ মানুষের মনুষ্যত্ব নাশ করে। যে লোমহর্ষক কাণ্ডগুলি পৃথিবীকে নরকে পরিণত করিয়াছে, তাহার মূলেও রহিয়াছে ক্রোধ। ক্রোধ যে মানুষকে পশুভাবাপন্ন করে, তাহা একবার ক্রুদ্ধ ব্যক্তির মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যে ব্যক্তির মুখখানা সর্বদা হাসিমাখা, উদার ভাবে পরিপূর্ণ, দেখিলেই তোমার মনে আনন্দ ধরে না, একবার ক্রোধের সময় সেই মুখখানির দিকে তাকাইও, দেখিবে, সে স্বপ্নের সুষমা আর নাই- নরকাগ্নিতে বিকট রূপ ধারণ করিয়াছে। সমস্ত মুখ কি এক কালিমায় ঢাকিয়া গিয়াছে। তখন তাহাকে আলিঙ্গন করা দূরে থাকুক, তাহার নিকটে যাইতেও ইচ্ছা হয় না। সুন্দরকে মুহূর্তের মধ্যে কুৎসিত করিতে অন্য কোন রিপু ক্রোধের ন্যায় কৃতকার্য হয় না।
সারাংশ : ক্রোধ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে এনে পৃথিবীতে নরক সৃষ্টি করে। মানুষের পরম শত্রু এই রিপুর তাড়নায় মুহূর্তে সুন্দর পরিণত হয় কুৎসিতে।
১৮২
সকল প্রকার কায়িক শ্রম আমাদের দেশে অমর্যাদাকর বলিয়া বিবেচিত হইয়া আসিয়াছে। শ্রম যে আত্মসম্মানের অণুমাত্রও হানিজনক নহে এবং মানুষের শক্তি, সম্মান ও উন্নতির ইহাই প্রকৃষ্ট ভিত্তি, এই বোধ আমাদের মধ্যে এখনও জাগে নাই। জগতের অন্যত্র মানব সমাজ শ্রম সামর্থ্যরে উপর নির্ভর করিয়া সৌভাগ্যের সোপানে উঠিতেছে। আর আমরা কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করিয়া দিন দিন দুর্গতি ও হীনতায় ডুবিয়া যাইতেছি। যাহারা শ্রমবিমুখ বা পরিশ্রমে অসমর্থ, জীবন সংগ্রামে তাহাদের পরাজয় অনিবার্য। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে অযোগ্যের পরিত্রাণ নাই। যাহারা যোগ্যতম তারাই পায় বাঁচিবার অধিকার এবং অযোগ্যর উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং পরিশ্রমের অমর্যাদা আত্মহত্যারই শামিল।
সারাংশ : পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যখন কায়িক শ্রমের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে উন্নতির শিখরে আহরণ করছে আমরা তখন তাকে ঘৃণা করে ক্রমশ পিছয়ে পড়ছি। শ্রম বিমুখ হয়ে আত্মহত্যা না করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ যুগে শ্রমের মর্যাদা দিয়েই মানুষকে জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।
১৮৩
প্রকৃত জ্ঞানের স্পৃহা না থাকলে শিক্ষার মূল উোদ্দশ্য পূরণ হয় না। এ অবস্থায় পরীক্ষায় পাস করাটাই বড় হয় এবং পাঠ্যপুস্তক পর্যন্তই জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকে। আমাদের দেশে পরীক্ষায় পাস করা লোকের অভাব নেই, কিন্তু জ্ঞানী লোকের অভাব আছে। যেখানে পরীক্ষা পাসের মোহ তরুণ শির্ক্ষীদের উৎকন্ঠিত রাখে, সেখানেই জ্ঞান নির্বসিত। একটি স্বধীন জাতি হিসেবে জগতের বুকে অক্ষয় ও অমরত্ব লাভ করতে হলে জ্ঞানের প্রতি তরুণসমাজকে উম্মুখ করতে হবে। সহজ লাভ আপাতত সুখের হলেও পরিণামে কল্যাণ বয়ে আনে না। পরীক্ষা পাসের মোহ থেকে মুক্ত না হলে তরুণসমাজের সামনে কখনোই দিগন্ত উম্মোচিত হবে না।
সারাংশ : শুধু পাশ করা জ্ঞান সমাজের কোনো কাজে আসে না। এবং এই পুথিগত বিদ্যাদ্বারা শুধু সার্টিফিকেটই অর্জন করা যায়। প্রকৃত জ্ঞান আরোহণ করা যায় না। তাই তরুণ সমাজকে প্রকৃত জ্ঞান অর্থাৎ জগৎ সংসারের কল্যাণমুখী জ্ঞানই অর্জন করতে হবে।
১৮৪
বাল্যকাল হতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিত্যান্ত আবশ্যক তাহাই কন্ঠস্থ করিতেছি। তেমনি করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে। কিন্তু আহারাদি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া আবশ্যক। তেমনি একটি শিক্ষাপুস্তককে রীতিমত হজম করিতে অনেকগুলি অপাঠ্য পুস্তকের সাহায্য আবশ্যক। ইহাতে আনন্দের সহিত পড়িতে পারিবার শক্তি অলক্ষিত ভাবে বৃ্দ্ধি পাইতে থাকে। প্রহণশক্তি, ধারণশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বল লাভ করে।
সারাংশ : আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু জ্ঞানগর্ব শিক্ষাই প্রদান করা হয়ে থাকে। এতে শিক্ষা লাভে কোন আনন্দ থাকে না। আনন্দ ছাড়া বছরের পর বছর কিছু গ্রহণ করাও যায় না। এতে অনিহা তৈরি হয়। তাই পাঠ্যপুস্তকের পড়ার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা বা আনন্দের যোগ থাকতে হবে।
১৮৫
আমরা দেশকে সাজাব আমাদের কল্পনা দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে, সৌন্দর্যবোধ দিয়ে-জননী করে নয়, প্রিয়া করে। কারণ প্রিয়াকে আমারা সৃষ্টি করতে পারি, কিন্তু জননী আমাদের প্রষ্ঠা জননী অতীতের , প্রিয়া বর্তমান ও ভবিষ্যতের । আজো যে আমরা দেশকে প্রগতিশীল করে তুলতে পরিনি, তার কারণ দেশকে আমরা জননী করে দেখছি, প্রিয়া করে নয়। জননীর জন্য প্রগতি নিষ্ট প্রয়োজন, অতীতের সুমধূর স্মৃতিতেই তার তৃপ্তি; প্রিয়াকে কিন্তু পরিবর্তনশীল হতে হয়, কারণ জীবনের নব নব স্বাদ পাওয়া ও পাওয়ানো তা জীবনধর্ম।
সারাংশ : [এখনো লিখা হয়নি। কমেন্ট বক্সে সারাংশটি লিখে সহায়তা করুন।]
১৮৬
শ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহন কর। কালি-ধুলার মাঝে, রৌদ্র- বৃষ্টিতেকাজের ডাকে নেমে যাও। বাবু হযে ছায়ার তলে থাকবার দরকার নেই। এ হচ্ছে মৃত্যুর আয়োজন। কাজের মধ্যে কুবুদ্ধি কুমতলব মানবচিত্তে বাসা বাঁধতে পারে না।কাজে শরীরকে সামর্থ্য জন্মে। স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ, ফূর্তি সকলই লাভ হয়।পরিশ্যমের পর যে অবকাশ লাভ হয় তা পরম আনন্দের অবকাশ। তখন কৃত্রিম আয়োজন করে আনন্দ করার কোনো প্রয়োজন হয় না। শুধু চিন্তর দ্বারা জগতের হিতসাধন হয় না। মানব সমাজে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে কাজে, রাস্তায়-কারখানায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে।
সারাংশ : শ্রম মানুষের সামগ্রিক উন্নতি বয়ে আনে। শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায় না। চিন্তা ও বই জ্ঞানের যে দ্বার উন্মোচন করে, তা পূর্ণতা পায় কায়িক শ্রমে।১৮৭
মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্রে, মনুষ্যত্বে, জ্ঞানে ও কর্মে। বস্তু চরিত্র বলেই মানুষের জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা বুঝাতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কিছুই নেই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করে সে শুধু চরিত্রের জন্য। অন্য কোনো কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে নত হবার দরকান নেই। জগতে যে সকল মাহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করেছেন, তাদে গৌরবের মূলে এই চরিত্র শক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, এই কথার অর্থ এই নয় যে তুমি শুধু লম্পট নও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানে প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ কর। তুমি পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান এবং মানুষের ন্যায় স্বাধীনতা প্রিয়। চরিত্রবান মানেই এই।
সারাংশ : মানুষের জীবনের উৎকর্ষ-অপকর্ষের বিচার হয় তার চরিত্র-পরিচয়ে। মানুষের জীবন ও কর্মের মহিমা তার চরিত্রের আলোকেই পায় দীপ্ত। মানুষ তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অনুসারেই কাজ ও চিন্তা করে এবং সেই অনুযায়ীই সমাজ-জীবনে ভূমিকা রাখে। মানুষের জীবনে চরিত্র যেন অলঙ্কার ও সম্পদ। তা তাকে দেয় উজ্জ্বল শোভা ও সমুন্নত মহিমা।
১৮৮
জাতি শুধু বাইরের ঐশ্বর্যসম্ভার, দালানকোঠার সংখ্যাবৃদ্ধি কিংবা সামরিক শক্তির অপরাজেয়তায় বড় হয় নয়। বড় হয় অন্তরের শক্তিতে, নৈতিক চেতনায়, আর জীবন পণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতায়। জীবনের মূল্যবোধ ছাড়া জাতীয় সত্তার ভিত কখনও শক্ত আর দুর্মুল্য হতে পারে না। মূল্যবোধ জীবনাশ্যয়ী হয়ে জাতির সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লেই তবে জাতি অর্জন করে মহত্ত্ব আর মহৎ কর্মের যোগ্যতা। সবরকম মূল্যবোধের বৃহত্তম বাহন ভাষা, তথা মাতৃভাষা, আর তা ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব শুধু লেখক আর সাহিত্যেকদেরই নয় বরং সর্বস্তরের জনগণের।
সারাংশ : বাইরের সমৃদ্ধিতে জাতি বড় হয় না, বড় হয় অন্তরের শক্তি ও ঐশ্বর্যে। জীবনাশ্রয়ী মূল্যবোধ অর্জনের ফলে জাতীয় সত্তার ভিত মজবুত হয়। লেখক আর সাহিত্যিকদের এই মূল্যবোধের কথা মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রচার করতে হবে।
১৮৯
দেশকে যে নারীর করুণা নিয়ে সেবা করে সে পুরুষ নয়, হয়তো মহাপুরুষ। কিন্তু দেশ এখন চায় মহাপুরুষ নয়। দেশ চায় সেই পুরুষ, যার ভালোবাসায় আঘাত আছে, বিদ্রোহ আছে। যে দেশকে ভালোবেসে শুধু চোখের জলই ফেলবে না, সে দরকার হলে আঘাতও করবে, প্রতিঘাতও বুক পেতে নেবে, বিদ্রোহ করবে। বিদ্রোহ করা, আঘাত করার পশুত্ব বা পৈশাচিকতাকে যে অনুভূতি নিষ্ঠুরতা বলে দোষ দেয় বা সহ্য করতে পারে না, সেই অনুভূতিই হচ্ছে নারীর অনুভূতি, মানুষের এটুকুই হচ্ছে দেবত্ব। যারা পুরুষ হবে, যারা দেশসৈনিক হবে, তাদের বাইরে ঐ পশুত্বের বা অসুরত্বের বদনামুটুকু সহ্য করে নিতে হবে। যে ছেলের মনে সেবা করার নামে বুকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছাটি প্রবল, তার সৈনিক না হওয়াই উচিত। দেশের দুঃখী, আর্ত-পীড়িতদের সেবার ভার এসব ছেলেরা ভালোভাবেই গ্রহণ করতে পারে।
সারাংশ : দেশ ও জাতি যখন বিপন্ন, দুর্দশাগ্রস্ত থাকে তখন প্রয়োজন অপ্রতিরোধ্য ও অদম্য শক্তিধর পুরুষের। কারণ দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা তার পক্ষেই সম্ভব যে বিদ্রোহ করতে পারে, আত্মদান করতে পারে।
১৯০
পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিজের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতএব, সব কিছুর বিনিময়ে আগে নিজের জীবন জিইয়ে রাখতে হবে; অন্তত জিইয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কেননা, জান থাকলেই জাহান। ধড়ে প্রাণ থাকলে পরে অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়। মরণের পর বেহেশতে যেতে চাও?- ভালো কথা, তবে সেটা মানুষকে মেরে নয়, বরং মানুষকে ভালোবেসে, মানুষকে বাঁচিয়ে।
সারাংশ : মানব জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। তাই জীবনে বেঁচে থাকাটা প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু জীবনে বেঁচে থাকাটা সার্থক হয়ে ওঠে মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে।
১৯১
বর্তমান সভ্যতায় দেখি, এক জায়গায় একদল মানুষ অন্ন উৎপাদনের চেষ্টায় নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছে, আর এক জায়গায় আর একদল মানুষ স্বতন্ত্র থেকে সেই অন্নে প্রাণধারণ করে। চাঁদের এক পিঠে অন্ধকার, অন্য পিঠে আলো-এ সেইরকম। একদিকে দৈন্য মানুষকে পঙ্গু করে রেখেছে অন্যদিকে ধনের সন্ধান, ধনের অভিমান, ভোগবিলাস-সাধনের প্রয়াসে মানুষ উন্মত্ত। অন্নের উৎপাদন হয় পল্লিতে, আর অর্থের সংগ্রহ চলে নগরে। অর্থ উপার্জনের সুযোগ ও উপকরণ সেখানেই কেন্দ্রীভূত; স্বভাবতই সেখানে আরাম, আরোগ্য, আমোদ ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোকাকে ঐশ্বর্যের আশ্রয় দান করে। পল্লিতে সেই ভোগের উচ্ছিষ্ট যা-কিছু পৌঁছায় তা যৎকিঞ্চিৎ।
সারাংশ : বর্তমান সভ্যতায় উৎপাদন ও পরিভোগে বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। পল্লির বিপুল জনগণ অন্ন উৎপাদন করেও দারিদ্র্যাকবলিত। অথচ নগরের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীরা ভোগবিলাসিতায় আচ্ছন্ন। অর্থের কেন্দ্রীভবন নগরকে দিয়েছে নানা নাগরিক সুবিধা। পক্ষান্তরে, পল্লি সুবিধাবঞ্চিত ও অন্ধকারে নিমজ্জিত।
সারাংশ (১ থেকে ৫০)
সারাংশ (৫১ থেকে ১০০)
সারাংশ (১০১ থেকে ১৫০)
সারাংশ (১৫১ থেকে ২০০)
আমি একটা সারাংশ চাই চিলাম কিন্তু পাইনি
ReplyDeleteAmio
Deleteআমি যেই সারাংশ টা খুজতাছি সেই টা তো নাই
ReplyDeleteআমি যে সারাংশ টা খুঁজতাছি তা তো নাই
DeletePls add "মানুষের মনেও যখন রসের আবির্ভাব না থাকে, তখনই সে জড়পিণ্ড" সারাংশ
ReplyDelete