↬ ঝড়ের রাতে
↬ বর্ষণমুখর ঝড়ের রাত
মানুষের জীবনে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না হয়। অজস্র ছোট-বড় ঘটনা- সেসবের আনন্দঘন, ব্যথাতুর কিংবা পুলক জাগানো স্মৃতি মানসপটে সাজানো থাকে ছবির মতো। কোনো স্নিগ্ধ ভোরে প্রকৃতির শান্ত রূপ দেখে নিজেকে মনে হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে কিংবা দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে গিয়ে হয়েছে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। কত বিষণ্ণ সন্ধ্যা হৃদয়কে করেছে ব্যথাতুর। স্মৃতির সাগরে ডুব দিলে একে একে ভেসে ওঠে সব চোখের সামনে। চেনার গভীরে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো মেলে দেয় ডানা। সেই ডানায় ভর করে মন চলে যায় সুদূর অতীতে, ঘটনার দিনটিতে। তেমনি একটি দিনের ঘটনা আজও ভুলি নি আমি। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ভয়ঙ্কর সুন্দর, রোমাঞ্চকর আর ব্যথাময়তার মিশ্র অনুভূতি। সেটি ছিল একটি ঝড়ের রাত্রি।
এপ্রিলের কোনো একটি দিন। তারিখটা ঠিক মনে নেই। সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল গুড়ি গুড়ি। সন্ধ্যার পর থেকে একটু একটু হাওয়া দিচ্ছিল। সেটাকে গ্রাহ্যই করলামম না। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। তাই রাতের খাবার আগেভাগে খেয়ে নিয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম সবাই। ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে।
বাড়ির সবাই যে যায় রুমে আটকে গেছি। বাইরে শোঁ শোঁ আওয়াজ। সব দরজা জানালা বন্ধ। তারপরও কোথা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লে মাতাল হাওয়া। হঠাৎ ঝনঝন শব্দে জানালার কাচ ভেঙে গেল। ঘরময় উড়ে বেড়াতে লাগল গাছের পাতা আর ধুলো। ঘরের ভেতর সব লণ্ডভণ্ড, তছনছ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সবগুলো জানালার কাচ বুঝি ভেঙে পড়বে একসাথে। ইলেকট্রিসিটি নেই। কটা বাজে বোঝার কোনো উপায়ও নেই। কোনোমতে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে রেডিওটা পেয়েছি। প্রাণপণে ঘুরিয়ে যাচ্ছি নব। কিন্তু কোনো স্টেশন ধরতে পারছি না।
বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। বিচিত্র শব্দ। এই মনে হচ্ছে ঝনঝন শব্দে টিনের চাল উড়ে যাচ্ছে, এই মনে হচ্ছে কড় কড় শব্দে গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। চারিদিকে যেন প্রেতনৃত্য শুরু হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর বিচিত্র শব্দ। পাশের রুমম থেকে চিৎকার করে মা আমাকে ডাকছে। আমি বিছানা থেকে নেমে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলাম। ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বইপত্র, ক্যালেন্ডার, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাঁধানো ছবি, বেশ কটি শো-পিস, জানালার কাচের ভাঙাা টুকরো। ঘরময় বই-খাতার পাতা উড়ছে। আমাদের ঘরের ছাদ টালির কয়েকটা টালি উড়ে গেল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় আমি দেখলাম প্রকৃতির ভয়ংকর রুদ্র রূপ। মনে হচ্ছিল, আজই সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আকাশের এমন লাল রং এর আগে আমি এখনও দেখি নি। হাওয়ার ঝাপটায় লম্বা লম্বা গাছগুলো যেন বেঁকে নুয়ে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। বিকট শব্দে কোথাও বাজ পড়ল। মনে হচ্ছিল আমাদের বাড়ির ওপরই পড়ল বুঝি। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লাগার দশা। এরই মধ্যে বহু কষ্টে ঘরের সবাই একটু রুমে জড়ো হয়েছি। হারিকেনের আলোয় ঘরে ভৌতিক পরিবেশ। বাতাসের ঝাপটায় হারিকেনের আগুন নিবু নিবু হয়ে আবার জ্বলে উঠছে।
কাচের জানালা দিয়ে বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নিকষ অন্ধকার কেটে গিয়ে এখন ছাই বর্ণ প্রকৃতি। এরই মধ্যে আগুনের গোলা ছুটে যেতে দেখলাম স্পষ্ট। বারান্দার ফুলের টবগুলো নিশ্চয়ই পড়ে গেছে এতক্ষণে। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল। কিছুই করতে পারছি না। কেবল ঝড় থামবার প্রতীক্ষায় আছি।
বাতাসের তাণ্ডবে মনে হচ্ছে দরজা-জানালা এমন কি পুরো ছাদটাই ভেঙে পড়বে। দূর থেকে ভেসে আসছে মানুষের চিৎকার। কখনও স্টষ্ট, কখনও অস্পষ্ট। সেই আর্তকণ্ঠ শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম আমাদের আমগাছটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
ঝড়ের সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘরের ভেতর বন্যার মতো পানি গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীরের অর্ধেকটা ভেঙে পড়ে গেল। ঝড়ের গতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ বুলেটিন। জানা গেল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, হাতিয়া, সন্দ্বীপ উপকূল দিয়ে ১৬০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড়। উপকূলের মানুষগুলোর কথা মনে হতে ভয়ে শিউরে উঠলাম।
হারিকেনের আলোয় দেখলাম রাত তিনটে বাজে। সেই বারোটা থেকে শুরু হয়েছে তাণ্ডবলীলা। এখনোও কমবার কোনো লক্ষণ নেই। এক একবার বাতাসের ঝাপটায় দরজা-জানালাসহ পুরো বাড়িটাই যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। সেই মুহূর্তে ভেঙে না পড়াটাই যেন অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল।
আমার ঘর ভর্তি বই। জানালার কাচ ভেঙে গেছে। বৃষ্টির পানি আর প্রচণ্ড হাওয়ায় নিশ্চয়ই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! মার নিষেধ সত্ত্বেও আমি মার ঘর থেকে আমার ঘরে যেতে চাইলাম। দরজা খুলতেই প্রচণ্ড বাতাসের বেগ। আমি প্রায় উড়েই গেলাম। আমার হাতে টর্চ। দেয়ালের ঝুলন্ত শেলফ থেকে বেশির ভাগ বই মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। টর্চের আলোয় দেখলাম কাচভাঙা জানালা দিয়ে বিচিত্র সব জিনিস ঘরের ভেতর উড়ে এসেছে। ঘরের এক কোণে পড়ে আছে একটা মুনিয়া পাখি, মৃত। কয়েকটা বই নিয়ে কোনো রকমে ফিরে এলাম। আমায় যেন হাঁটতে হলো না। বাতাসই যেন উড়িয়ে নিয়ে এল।
আবারও দরজা বন্ধ করে ভেতরে আটকে থাকা। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ঘরের ভেতরে থেকে ঝড়কে যেন আরও সাংঘাতিক মনে হচ্ছে। ভাবছি, এই কি মহাপ্রলয়? সৃষ্টির অন্তিম লগ্নে এমনি করেই কি সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? আদৌ কি থামবে এই ঝড়?
থেকে থেকে বহু দূর হতে ভেসে আসছিল মানুষের আর্তস্বর। বাতাসের প্রচণ্ডতার কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছিল সেই আর্তনাদ। অস্পষ্ট, ক্ষীণ আকুল সেই চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল তক্ষুণি ছুটে যাই। কিন্তু সে মুহূর্তে আমি নিরুপায়, আমরা নিরুপায়।
চারিদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। আমাদের বাড়িটাকে মনে হচ্ছিল দ্বীপের মতো। প্রলয় তাণ্ডব দেখে মনে হচ্ছিল বিধাতা নিজ সৃষ্টির ওপরই ক্ষুব্ধ। প্রকৃতি যেন আজ কেবল ধ্বংসলীলায় মেতেছে। সৃষ্টির মধ্যেই কি তবে ধ্বংস অথবা ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টি!
ঝড়ের দাপট যখন অনেকটা কমে এল ঘড়িতে তখন চারটে। দরজা খুলে বাইরে বেরুলাম। বেরুবার পথে কাঁঠাল গাছের বিশাল ডাল পথ আটকাল। আমাদের মতো অনেকেই ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে হারিকেন, টর্চ, কুপি হাতে। এখানে ওখানে পড়ে আছে বিশাল বিশাল গাছের ডাল। পড়ে আছে বৈদ্যুতিক খুঁটি, টিনের চাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে আলো ফুটতে শুরু করল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এই পৃথিবী আমার সম্পূর্ণই অচেনা প্রচণ্ড আক্রোশে কেউ যেন সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। বাড়ির সীমানায় ইটের দেয়ালটা মিশে গেছে মাটিতে। মাধবীলতার ঝাড়টা কোথায় গেছে কে জানে। আরো অনেকেই কখন বেরিয়ে পড়েছে। কার কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হলো সেই হিসেব চলছে। এলাকার লোকজন লেগে পড়ল জঞ্জাল সরানোর কাজে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নারকেল, আম, সুপারি। ছোট শিশুরা হৈচৈ করে সেসব কুড়াতে শুরু করল। বিশাল আমগাছটা শেকড় সুদ্ধ পড়ে আছে। মনে হলো এ ঘর আমার নয়, এখানে আমি পথ ভোলা এক পথিক। পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠল। এক্ষুণি সূর্য উঠবে।
- প্রবন্ধ রচনা : শৈশব স্মৃতি
- প্রবন্ধ রচনা : নদীতীরে সূর্যাস্ত
- প্রবন্ধ রচনা : বর্ষণমুখর একটি সন্ধ্যা
- প্রবন্ধ রচনা : হেমন্তকালীন একটি সন্ধ্যা
- প্রবন্ধ রচনা : বাদল দিনে
- প্রবন্ধ রচনা : জ্যোৎস্না রাতে
- প্রবন্ধ রচনা : একটি দিনের দিনলিপি
- প্রবন্ধ রচনা : যখন সন্ধ্যা নামে
- প্রবন্ধ রচনা : নগরজীবন
- প্রবন্ধ রচনা : সমুদ্র সৈকতে একদিন
- প্রবন্ধ রচনা : নিজের দেশকে জানো
Outstanding post
ReplyDeletenice
ReplyDeleteBest Ever I have seen
ReplyDelete