ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙালির জাতীয় জীবনের শুভ্র ললাটে এক রাজতিলক। দু’শ চব্বিশ পঁচিশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির প্রবল প্রত্যাশায় বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ১৯৭১ সালে যে মরণপণ সংগ্রামের সূচনা করেছিল ইতিহাসে তাই মুক্তিযুদ্ধ নামে অভিহিত। একাত্তরের বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে শত্রু হননের প্রবল মন্ত্রে যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে ‘একটি ফুলকে বাঁচাতে’ কণ্ঠে তুলে নিয়েছিল শিকল ভাঙ্গার গান- সে সুরের লহরী তোলার সময় হতে চলে গেছে ২৫টি বছর। ১৯৯৬ সাল মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পূর্তিকাল। ১ ডিসেম্বর হতে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতি সগর্বে মেতে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তীতে।
রজত জয়ন্তীর গৌরবময় অনুষ্ঠানমালা : ডিসেম্বর মহান মুক্তির মাস। ডিসেম্বর এলেই জাতির স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে একটি মুক্তির মহান আনন্দ প্লাবন। লাখো শহীদের জীবন দানের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার রক্ত-স্মৃতি আমাদের প্রাণে নব নব চেতনার পরশ বুলিয়ে দেয়। পঁচিশ বছর পূর্তিতে এ স্মৃতি যেন সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে আমাদের মননে তুলেছে নবীন শিহরণ। রজত শুভ্র আনন্দ ধারায় আজ জাতির প্রাণ স্পন্দিত। স্বাধীনতা উত্তরকালের সঞ্চিত সকল গ্লানি, সকল জীর্ণতা ধুয়ে মুছে নবীন আলোক-স্পর্শে জাগ্রত হল বাংলা ও বাঙালি। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গড়ে তুললো নানা মঞ্চ। মঞ্চে মঞ্চে সংগীতে রসুরের লহরী আর নৃত্যকলার ছন্দে ছন্দে জেগে উঠল যেন পঁচিশ বছর আগের সেই বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্দীপনামূলক সেই গানে গানে মুখরিত হল জনপদ, শহর, গ্রাম আর নগর-বন্দর। আনন্দ সুরের প্লাবনে উচ্ছল গতিবেগ এলো বাঙালির মন ও মননে।
“একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
একটি দেশের জন্য মোরা অস্ত্র ধরি।”
রজত-জয়ন্তীতে গানের এ বাণী যেন আমাদের প্রাণে দিয়ে গেল অনুপ্রেরণার নতুন স্পর্শ। রাজধানী ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি ভবনে ভবনে উড়ল লাল-সবুজ পতাকা। অলিগলি প্রান্তর শোভিত হল পতাকায় পতাকায়। রমনা বটমূল, টি.এস.সি. চত্বর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শতায়ু অঙ্গন বিজয় স্মরণী, মুক্তি স্মরণী হল লোকে লোকারণ্য। অলিতে গলিতে বসল বিজয় মেলা। বিজয়ের বর্ণাঢ্য মিছিলে মিছিলে সারাদেশ শিহরিত হল আনন্দ আবেদনে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণায় মুখর হল জনপদ।
দীর্ঘ পঁচিশ বছরের পথ পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যেন ঝাঁপসা হয়ে এসেছিল। রজত-জয়ন্তী প্রতিটি বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিল সেই স্মৃতির সোনালি আবেদন নতুন করে নতুনভাবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে পঁচিশ বছর পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নিয়াজী, মিত্রবাহিনী প্রধান জগজিৎ সিং আরোরার কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেখানে স্থাপন করলেন স্মৃতি স্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর। এখানেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭১-এর ৭ই মার্চ জনতার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন-
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল ৯ একর এলাকা জুড়ে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় জেগে উঠেছিল জাতি ২৫ বছর পূর্বের উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, যারা ইতিহাসের বাইরে ছিটকে পড়েছিল, তাদের নতুন করে আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জাতি খুঁজে পেল ‘তারামন বিবিদের’ মত হাজারো মুক্তিযোদ্ধা। বিকৃত ইতিহাসের আস্তাকুড় হতে বেরিয়ে আসা বস্তুনিষ্ঠ তথ্যে মুক্তিযুদ্ধের রজত-জয়ন্তী চেতনাকে দিল নতুন মাত্রা। স্পন্দিত প্রাণের শতকণ্ঠে ধ্বনিত হল-
“কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান,
না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।”
মুক্তিযুদ্ধের রজত-জয়ন্তীতে ১লা ডিসেম্বর হতে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলার পথে পথে জনতার ঢল, আনন্দ-উল্লাস আর চেতনার নতুন গতিতে জাতি গতিমান হয়ে উঠেছিল। পরম আত্মতৃপ্তি নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করল বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর ধরে রেখেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরল স্মৃতি ভাণ্ডার। সেখানেও মানুষের ঢল নামল রজত-জয়ন্তীতে। মানুষের মনে প্রাণে যেন সতঃস্ফূর্ত আবেদনের এক প্রবল বন্যা। ১৬ই ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রতিটি নগরীর বক্ষ কাঁপিয়ে আনন্দে গর্জে উঠল তোপধ্বনি। জাতীয় স্মৃতিসৌধে আর শহীদ মিনারে স্তূপীকৃত হল পুষ্পস্তবক লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হল-
“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনল যারা,
আমরা তোমাদের ভুলব না-ভুলব না।”
উপসংহার : স্বাধীনতা পঁচিশ বছর পর যেন আমাদের চোখে ঝরে পড়ল অশ্রু রজত ধারা। শাশ্বত সুন্দর এ জয়োৎসবে বাঙালি নতুন করে শপথ নিল অর্থনৈতিক মুক্তির। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার দৃপ্ত প্রত্যয়ে উদ্যাপিত রজত-জয়ন্তী আমাদের পথ দেখাবে সুবর্ণ ও হীরক জয়ন্তীর। তাই, একাত্তরের মুক্তিপাগল জনতা এবার মেতে উঠেছে সোনার বাংলা গড়ার নতুন শপথে। এই নব শপথের ভিত হল মুক্তিযুদ্ধের রজত-জয়ন্তী।