প্রবন্ধ রচনা : গ্রাম্য মেলা

↬ গ্রামের মেলা

↬ গ্রামীণ ঐতিহ্য : মেলা

↬ মেলা

↬ গ্রামীণজীবনে মেলার গুরুত্ব


ভূমিকা :
‘মিলনের মধ্যে যে সত্য তা কেবল বিজ্ঞান নয়, তা আনন্দ, তা রস-স্বরূপ, তা প্রেম। তা আংশিক নয়, তা সমগ্র; কারণ তা কেবল বুদ্ধিতে নয়, তা হৃদয়কেও পূর্ণ করে।’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘মেলার’ আক্ষরিক অর্থ ‘লিমন’। মেলার নামে সবার মন এক অভূতপূর্ব আনন্দের উচ্ছ্বাসে ওঠে নেচে। মেলার আনন্দের স্মৃতি সকলের মনেই থাকে গভীরভাবে মুদ্রিত। মেলা পরস্পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাব-সম্মিলনের সংযোগ সেতু। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রাম্য মেলার গুরুত্ব তাই অসীম।

মেলার প্রচলন : বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষে মেলার প্রচলন হলেও এখন গ্রামীণ-জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণত বছরের শেষে অথবা বছরের শুরুতে এই মেলা বসে অথবা বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষেও মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

মেলার স্থান ও সময় : বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই নানা ধরনের মেলার প্রচলন রয়েছে। স্থান বিশেষে রয়েছে কিছু বিখ্যাত মেলা। যা ঐ স্থানের নামেই সুপরিচিত। সাধারণত মেলা বসার জন্য হাট-বাজারের ন্যায় নির্দিষ্ট কোন স্থান নির্ধারিত থাকে না। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে খোলা মাঠে, মন্দির প্রাঙ্গণে, নদীর তীরে অথবা বড় বৃক্ষের নিচে গ্রাম্য মেলা বসতে দেখা যায়। পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। মেলার স্থানে সাময়িকভাবে দোকানপাট বসার মত চালা নির্মাণ করা হয়। মেলা শেষ হওয়ার পর এগুলো ভেঙে ফেলা হয়। বছরের শেষে মেলার আনন্দে আবারও মুখরিত হয়ে ওঠে মেলার সে স্থানে। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলাগুলোর কোনটি একদিন, কোনটি এক সাপ্তাহ্, কোনটি পনের দিন আবার কোন কোন মেলা এক মাসব্যাপী চলতে থাকে। আজকাল শুধু গ্রাম নয়, শহর ও আধা শহরেও মেলার আসর বসে। তবে গ্রামই মেলার উপযুক্ত পটভূমি।

মেলার উপলক্ষ : আমাদের দেশে গ্রামে সাধারণত ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পহেলা বৈশাখ, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বিজয়া দশমী, দশই মহরম, চৈত্র সংক্রান্তি এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মেলা বসে থাকে। তবে উপলক্ষ যাই হোক না কেন মেলা বাঙালি সমাজ ও মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের দিন। মেলায় সমাজের সর্ব শ্রেণীর মানুষ, ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ-নির্বিশেষে সকলেই এসে মিলিত হয়। বিভেধের পার্থক্য ভুলে গিয়ে সকলেই এক আনন্দের জোয়ারে গা ভাসায়। মেলাকে আশ্রয় করে গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-উৎসের রুদ্ধ দুয়ার খোলে যায়। এর মধ্যেই সে খুঁজে পায় বেঁচে থাকার সার্থকতা। খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ। সত্যপীর, শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী, ওলাবিবি, সতী-মা এমনি কত লৌকিক দেবদেবী গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কত শত শতাব্দীর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ধর্মীয় আকুতির সঙ্গে এঁদের আত্মিক সম্পর্ক। এদের কেন্দ্র করে কত লোকগাথা, কত ব্রতকথা, পাঁচালী, ছড়া, গ্রাম্য সাহিত্য-সঙ্গীতের ধারা আজও চলে আসছে। মেলা গ্রামীণ জীবনের শুকনো খাতে নিয়ে আসে প্রবল আনন্দ-জোয়ার। সেই জোয়ারেই বাঙালীর চিত্তভূমি সিক্ত হয়েছে।

মেলার প্রস্তুতি : কোন্ দিন মেলা বসবে তা এলাকার লোকেরা আগে থেকেই জানে এবং সে অনুসারে তাদের প্রস্তুতি চলে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আগে থেকেই মেলায় খরচ করার জন্য তাদের পিতা-মাতার নিকট থেকে টাকা-পয়সা জমা করতে থাকে। এছাড়া আশেপাশের কারিগরেরা মেলায় বিক্রির জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতে থাকে।

মেলার বর্ণনা ও মেলার সাধারণ চিত্র : প্রত্যেক মেলারই একটা সাধারণ চিত্র আছে। যেন চলমান এক ছবি। ভিড়, চেঁচামেছি, হট্টগোল, ঠেলাঠেলি, হাসি-কান্না, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি, খুশির উচ্ছ্বাস, রঙবেরঙের পোশাক-আশাক। নাগরদোলা, কাটামুণ্ডু জোড়া লাগার জাদুবিদ্যা, তালপাতার বাঁশীর আওয়াজ, রকমারি খেলনা, মণ্ডা-মিঠাইয়ের দোকান, জিলিপি খাওয়ার ধুম, পাঁপড়-তেলেভাজার ঘ্রাণ, জামা-কাপড়, হাঁড়িকুড়ি নানা রকমের পণ্য-পসরা, এমনি একের পর এক আরও কত জীবন্ত চিত্র।
মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে দোকানদাররা আসে। মেলায় দোকানগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো থাকে। মেলায় কোথাও খেলনা, কোথাও ডালা-কুলা-চালুনি, কোথাও কাঠের জিনিসপত্র, কোথাও মাটির জিনিসপত্র, কোথাও ঘুড়ি এবং কোথাও খাবারের জিনিসের দোকান বসে। এছাড়া মেলার একপাশে নাগরদোলা, রাধাচক্র ও সার্কাস বসে। চলে বানরের নাচ, পুতুল নাচ, তার সাথে চলে ছোট ছেলেমেয়েদের নাচানাচি। অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় হাজির হয়। কুটির শিল্পের অসংখ্য নমুনা এখানে আনা হয়ে থাকে। আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর কারিগরেরা যেসব জিনিস তৈরি করে, তা তারা বিক্রয়ের জন্য মেলায় নিয়ে আসে। এভাবে সুন্দর সুন্দর জিনিসের সমারোহে সারা মেলা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোন কোন মেলায় কিছু খেলাধুলার প্রতিযোগিতাও চলে। এর মধ্যে হা-ডু-ডু ও কুস্তি প্রতিযোগিতা দর্শকদের বিশেষ আনন্দ দেয়।

মেলার তাৎপর্য : মেলার আছে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক : মনস্তাত্মিকঅর্থনৈতিক। মনস্তাত্ত্বিক দিক হল : ভাবের আদান-প্রদান, অর্থনৈতিক দিকটি হল পণ্য বিকিকিনি। গ্রামীণ জীবনে মেলা গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে অনাবিল আনন্দের উৎস হিসেবে উদযাপিত হয়। মেলা গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। গ্রামের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী, নানা শিল্প সম্ভার মেলায় প্রদর্শিত হয়ে গ্রামীণ জীবনের ছবি স্পষ্ট করে তোলে। গ্রামীণ জীবনের কৃতিত্বের পরিচয় রূপায়িত হয় গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে। গ্রামের নানা খেলা ও আমোদ-প্রমোদের উপকরণ দেখতে পাওয়া যায় গ্রাম্য মেলায়। বস্তুত গ্রামকে চেনা যায় গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে।

মেলার আকর্ষণ : মেলার জন্য বহুদিন থেকে চলে নানা উদ্যোগ, আয়োজন। মেলায় আসা বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী মেলার অন্যতম আকর্ষণ। এ মেলা উপলক্ষে বিক্রেতারা তাদের বিচিত্র দ্রব্যের সমাবেশ ঘটায়। এখানে কুটির শিল্পজাত ও মৃৎশিল্প, তাল পাতার পাখা, কাগজের তৈরি রকমারি খেলনা, শীতল পাটি, নকশী কাঁথা ইত্যাদি নানা সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে। মেলাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে বাঁশের বাঁশি, চামড়ার ঢোল ইত্যাদি। এছাড়াও মেলায় উপভোগ করার মত আছে সার্কাস, ম্যাজিক, যাত্রা, থিয়েটার ইত্যাদি বিনোদনমূলক উপাদান।

মেলার উপকারিতা : আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম্য মেলা শুধু আনন্দ চিত্তের শান্তিই দেয় না, বিত্তের শক্তিও যোগায়। মেলায় কৃষি ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের কামার-কুমার, তাঁতী, সুতারদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস বানানোর হিড়িক পড়ে যায়। তাই দেখা যাচ্ছে, মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উপার্জনের পথও প্রশস্ত হয়। এছাড়া সার্কাস ও যাত্রাদলসহ আরো অনেকেই মেলায় ব্যবসায় করে থাকে। এতে করে বহু লোকের কিছুটা হলেও অন্ন সংস্থান হয়। প্রসঙ্গত ডঃ কে, টি, হোসাইন বলেছেন,
“There is certain economic importance of the village fair which could improve the lot of the general people lying in the village.”

মেলার অপকারিতা : মেলা উপকারের পাশাপাশি অপকারও আছে। মেলায় বিচিত্র লোকের সমাগম ঘটে। জুয়া, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অসামাজিক ও অন্যায় অবৈধ কাজ মেলায় সংঘটিত হতে পারে বা হয়। অল্পকিছু চরিত্রহীন দ্বারা নারী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। তাছাড়া যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের ফলে ভীষণ দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। ফলে পরিবেশ দূষিত হয় এবং নানা রকম রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। অনেক সময় পচা-বাসী খাবার খাওয়ার ফলে কলেরার ও প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

উপসংহার : মেলা হচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মেলা লোক সংস্কৃতিরই এক বিশেষ ধমনী। এই ধমনীতেই জীবনের স্পন্দন। এরই মধ্যে বাঙালী খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। মেলা তা নিছক আনন্দ-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র নয়। এর সঙ্গে যুক্ত আছে তার দীর্ঘকালের ধর্ম-সাধনা। আছে তার জীবন-লীলার নানা তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাত। এরই মধ্যে আছে তার অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার আশ্বাস। আছে জীবনের অফুরান প্রাণশক্তির প্রকাশ। মেলাই তার বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি। তার অস্তিত্ব। তার দর্পণ।


[ একই প্রবন্ধ আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা : গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ মেলা। বিনোদনহীন নিরানন্দ একঘেয়ে গ্রাম্য জীবনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে মেলা। গ্রামবাসী এই দিনটির প্রতীক্ষায় প্রহর গোণে। জাত-ধর্ম-বর্ণ একাকার হয়ে মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। মানুষের সাথে মানুষের, শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয়। মানুষের মেলা আর মেলার মানুষ একসূত্রে বাঁধা পড়ে।

মেলার উৎপত্তি : মেলার শুরু ঠিক কবে থেকে সে সম্পর্কে কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। অর্থাৎ মেলার জন্মকথা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথা বলা যায় : যখন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু, তখন থেকে মেলারও শুরু।

মেলার স্থান, উপলক্ষ : গ্রামের বেশির ভাগ মেলাই বসে নদীর তীরে। মেলার পসরা সাজিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসে নৌবহর। বিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের ছায়ায়, কখনো বা বিস্তৃত খোলা মাঠে বসে মেলা। নির্জন অশ্বত্থ তল কিংবা নদীতীর হয়ে ওঠে কোলাহল মুখরিত।

নানা উপলক্ষে প্রামে মেলা বসে। আবহাওয়া ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন জনপদে মেলার বৈচিত্র্য দেখা যায়। প্রবীণরা এখনো বলেন, এলা পৌষ গেলো পৌষ বলে শীত যখন জেঁকে বসে তখন প্রথমেই মনে পড়ে যায় মেলার কথা। শীতের শেষে গাঁয়ের মানুষের শস্যভাণ্ডার থাকে পূর্ণ। পিঠা-পার্বণের উৎসব চলে। এ সময় তাদের অখণ্ড অবসর। এই অবসরে আনন্দের স্পর্শ জাগায় মেলা। বাংলা বছরের শেষে চৈত্র সংক্রান্তির মেলার মধ্য দিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় আর বৈশাখী মেলায় নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এ ছাড়াও মহরমের সময়ও মেলা বসে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। আবহমান কাল থেকে ধর্মীয় ও লৌকিক উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মেলা। রবীন্দ্র পরিবারে ছিল মেলার চল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দীক্ষা উপলক্ষে বাংলা ১২৫০ সনের ৭ই পৌষ একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। মেলার উদ্বোধনী দিনে তিনি ভাষণও দিতেন। এমনই এক মেলায় উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন,
‘এই মেলার উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়- হৃদয় খুলে দান করবার ও গ্রহণ করবার এই মেলাই হলো প্রধান উৎস ও উপলক্ষ।’

গ্রাম্য মেলার পুরনো ইতিহাস : বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে মেলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। মোগল আমলে নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গ্রাম্য মেলা বসতো। ‘আইন-ই-আকবরী’তে বলা হয়েছে, মেলা এলেই গ্রামে পড়ে যেত সাজ সাজ রব। গ্রাম বাংলার আসল রূপ যেন তখনই ফুটে উঠতো। মানুষের মন তখন আনন্দমুখর। এরও আগে মেলা রাজ-আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ছেচল্লিশ সালে জুলিয়াস সিজার একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন, যেখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার ছিল না। ইরানের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘নওরোজ’ উপলক্ষে এক ধরনের মেলার প্রচলন ছিল। কালের আবর্তে মেলা সাধারণ জনগণের আওতায় আসে। গাঁয়ের সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে গ্রাম্য মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা ছিল গ্রাম্য মেলাগুলোর। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, পালাগান, যাত্রা, লেটোর আসর। বিদ্রোহী কবি নজরুল কিশোর বয়সে এই লেটোর দলেই ব্রিটিশ-বিরোধী গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী গানের সূচনা করেন শান্তিনিকেতনের এক মেলায়।

অতীতে প্রধানত শীতকালেই মেলা হতো। কালক্রমে তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঋতু উৎসব, লোকজ সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ ইত্যাদিতে বিস্তৃতি পায়। বৈশাখী মেলা, কার্তিকের মেলা, আশুরার মেলা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের মেলা, খুলনার খান জাহান আলী দরগার মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলার মেলা, কুমিল্লার জগন্নাথ মেলা, রাস পূর্নিমার মেলা, মাঘী পূর্ণিমা তিথি মেলা, লাঙ্গলবন্ধের গঙ্গাস্নানের মেলা ইত্যাদি একসময় শুধুই গ্রামবাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে তা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের কর্মকোলাহলের মাঝেও ঠাঁই করে নিয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ছোট বড় মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৫৩টি মেলা বসে।

মেলায় যেসব জিনিসের সমাগম ঘটে : নতুন ধানের তৈরি পিঠে-পুলি, পায়েস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য যেমন- বাঁশ-বেতের ডালা, কুলা ও অন্যান্য আসবাব, বিভিন্ন ধরনের খেলনা; মৃৎ শিল্প যেমন- মাটির হাড়ি-পাতিল, ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিস, পুতুল, তাল পাতার পাখা, শীতল পাটি, নকশি কাঁথা, লোহার ও কাঠের নানা সামগ্রী, বিন্নি ধানের খই, বাতাসা, নাড়ু, ছাঁচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস যেমন- হাতি, ঘোড়া, পাখি, আম, কাঠাল, মসজিদের গম্বুজ, মন্দিরের চূড়ো, নলের গুড়ের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি ইত্যাদি অসংখ্য সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে।

গ্রাম্য মেলার তাৎপর্য : বাংলা গ্রামীণ জীবন যেন সার্থকভাবে ফুটে ওঠে গ্রামের মেলায়। মেলা যেন উপেক্ষিত গ্রামের মানুষদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র। গ্রামের আর্থ-সামাজিক জীবনের সাথে মেলার যোগ নিবিড়। হস্ত ও কুটির শিল্প এবং রকমারি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে মেলায়। গ্রামের অবহেলিত সম্প্রদায়- দরিদ্র কুমোর, কামার, তাঁতি তাদের তৈরি পণ্য নিয়ে সহজেই মেলায় আসতে পারে। পণ্যের কারিগরের সাথে ক্রেতার সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। আবিষ্কৃত হয় নানা রকম নকশা, কারুকাজ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান পায় পূর্ণতা। কঠোর পরিশ্রমী মানুষ কিছুদিনের জন্যে আনন্দে অভিভূত হয়। এমন প্রাণপ্রাচুর্যময় আয়োজন আর দেখা যায় না। পসরা কেনাবেচার পাশাপাশি চলে লাঠিখেলা, ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা, মোরগের লড়াই, হা-ডু-ডু, পুতুল নাচ প্রভৃতি খেলা। বাঙালি নতুন করে স্বাদ পায় হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যের। আজকাল শহরে শিল্প মেলা, বই মেলা, কৃষিপণ্য মেলা, বাণিজ্য মেলা- ইত্যাদি নানান রকমের মেলা হয়। এর মূল কিন্তু গ্রাম্য মেলাতেই প্রোথিত। মেলার মাধ্যমেই এক গাঁয়ের মানুষের সাথে অন্য গাঁযের পরিচিতজনদের খেলা হয়, পরিচয় ঘটে, ভাবের আদান-প্রদান হয়। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যেসব শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামের মেলায় সেসব যেন প্রাণ ফিরে পায়।

উপসংহার : গ্রামবাংলার মেলা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বছরের পর বছর এই মেলা আমাদের সংস্কৃতিকে একভাবে টিকিয়ে রেখেছে, যদিও আজ নগর জীবনের বিলাসিতার উপকরণ গ্রামগুলোকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। শহরের বৈদ্যুতিক বাতি, মাইক্রোফোন ব্যান্ড সংগীত মেলার পুরনো ঐতিহ্যকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। তারপরও মেলার দিনটির জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে গাঁয়ের মানুষ। গ্রামে এখন প্রাণোচ্ছ্বল সময়, এমন প্রাচুর্যময় মিলন মেলা আর কখনো আসে না।

7 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post