ভাবের সুসঙ্গত সার্থক প্রসারণই ভাব-সম্প্রসারণ। আবৃতকে উন্মোচিত, সংকেতকে নির্নীত করে তুলনীয় দৃষ্টান্ত ও প্রবাদ-প্রবচনের সাহায্যে সহজ ভাষায় ভাবের বিন্দুকে বিস্তার করার নাম ভাব-সম্প্রসারণ। অনেকটা, ভাবসম্প্রসারণ এর ইংরেজি Expansion of the feeling বলা যায়।
সাধারণত কবিতা বা গদ্যের দুই-একটি তাৎপর্যপূর্ণ বা ভাবব্যঞ্জনাময় চরণ ভাব-সম্প্রসারণের জন্যে দেওয়া হয়। এই ভাবব্যঞ্জনায় লুক্কায়িত থাকে মানব-জীবনের কোনো মহৎ আদর্শ কিংবা কোনো ব্যক্তিচরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, নৈতিক কোনো বিচ্যুতি। ভাব-সম্প্রসারণের সময় সেই গভীর ভাবটুকু উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় যুক্তি, বিশ্লেষণ, উপমা, উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে। কবি বা লেখক যেখানে তাঁর বক্তব্যকে ব্যঞ্জনা বা ইঙ্গিতধর্মী করে প্রকাশ করেন, ভাব-সম্প্রসারণে তাকে সেখানে আলোচনাধর্মী করে উপস্থাপিত করা হয়।
ভাব-সম্প্রসারণের জন্য প্রদত্ত কবিতা বা গদ্যের অংশটি সাধারণত খুব সংক্ষিপ্ত হয়। পরিসর যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, তা কিন্তু একটি বড় ভাবকে আশ্রয় দিয়ে থাকে। সতর্কতার সঙ্গে সেই মৌল ভাবটিকে খুঁজে বের করতে হবে। নিচের উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক :
এখানে ‘কেরোসিন শিখা’, ‘মাটির প্রদীপ’ এবং ‘চাঁদ’ এই তিনটি বস্তুই রূপক। অর্থাৎ এদের রূপের আড়ালে কবি ভিন্ন কোনো ভাবের কথা ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। যে কেরোসিন শিখা মাটির প্রদীপের আত্মীয়তা অস্বীকার করে, সেই আবার নিজের অবস্থা বিস্মৃত হয়ে চাঁদকে আত্মীয় সম্ভাষণে বিগলিত হয়ে ওঠে। এখানে কেরোসিন শিখার মধ্যেই মূল ভাবটি দ্যোতিত হয়েছে। সে আসলে কেরোসিন শিখা নয়; সে হল আত্মমর্যাদাহীন, সংকীর্ণচিত্ত, আত্মম্ভরী তোষামোদপ্রিয় মানুষ। এখানে সেই মানুষের কথাই বিশদভাবে বলতে হবে।
আর একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যাক :
এই কাব্যাংশটি রূপকাশ্রিত নয়; ভাবব্যঞ্জক এই চরণে একটি বিশেষ চিন্তা নিহিত আছে। কবিতাটির বাচ্যার্থ হল, সেই বিচারই শ্রেষ্ঠ যেখানে দণ্ডদাতা দণ্ডিতের সাথে সমপরিমাণ বেদনা বোধ করেন। কিন্তু বাচ্যার্থ এখানে সমগ্র ভাবটিকে প্রকাশ করতে পারছে না কেননা বাচ্যার্থকে ছাপিয়ে বিষয়টির ভাব ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। বিচারক যদি নিষ্প্রাণ যন্ত্রবিশেষরূপে শুধু আইনের অনুসরণ করেই বিচারকার্য সম্পন্ন করেন তবে সে বিচার সার্থক নয়। দণ্ডিতকে ঘৃণিত অপরাধীরূপে নয়, তাকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে, মমতা ও সহানুভূতির সাহায্যে বিচার করতে হবে।
ভাব-সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা :
জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে ভাব-সম্প্রসারণের অনুশীলন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, ভাব-সম্প্রসারণ নিয়মিত অনুশীলন করলে-
১। কোনো সংক্ষিপ্ত, অর্থপূর্ণ বক্তব্যকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
২। কোনো বিশেষ বক্তব্য থেকে সাধারণ সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
৩। ভাব-প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা চর্চার যে গুরুত্ব আছে তা অনুধাবন করা যায়।
ভাব-সম্প্রসারণ লেখার পদ্ধতি
ভাব-সম্প্রসারণের কাজটি সার্থক করতে হলে নিচের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে :
১। ভাব-সম্প্রসারণ করতে হলে উদ্ধৃত অংশ বা সারগর্ভ বাক্যটি মনোযোগ দিয়ে বারবার পড়ে তার প্রচ্ছন্ন ভাবটুকু বুঝে নিতে হবে। লেখকের রসঘন অর্থবহ রচনার মূল্যবান অংশ, কবিগণের ভাবগর্ভ পঙক্তি, প্রবাদ, কবিতার উজ্জ্বল পঙক্তি ইত্যাদি যেসব অংশ ভাব-সম্প্রসারণের জন্যে দেয়া হয়, তার যথার্থ মর্ম বুঝতে পারলে ভাব-সম্প্রসারণ সহজ হয়।
২। মূলভাব উপমা, রূপক, প্রতীক বা সংকেতের আড়ালে আছে কিনা তা দেখে, মূল তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৩। ভাব-সম্প্রসারণ কথাটির অর্থ যেহেতু ভাবের সম্প্রসারণ বা বৃদ্ধি, তাই প্রয়োজনীয় উপমা বা দৃষ্টান্ত এবং যুক্তি দিয়ে বক্তব্য-বিষয়কে সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করতে হবে। প্রাসঙ্গিক হলে ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা বৈজ্ঞানিক তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে।
৪। ভাব-সম্প্রসারণের সময় ভাবের সম্প্রসারণ বা বৃদ্ধি করতে হয় বলে বাহুল্য বর্জন করতে হবে, অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় কথা কিংবা একই কথার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। সম্প্রসারিত লেখার আয়তন হবে প্রদত্ত মান নির্ধারক নম্বর অনুযায়ী।
৫। সম্প্রসারিত-ভাবের বিষয়বস্তুকে ছোট ছোট অনুচ্ছেদের মাধ্যমে স্পষ্ট করে তুলতে হবে। তবে দুই-তিন অনুচ্ছেদের বেশি না হওয়াই ভাল।
৬। আলোচনাটি যাতে রসহীন মনে না হয় সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। প্রকাশভঙ্গির সৌন্দর্যের ওপরে ভাব সম্প্রসারণের সার্থকতা নির্ভর করে।
৭। কাজটি যেহেতু ভাবের বিস্তার তাই কবি বা লেখকের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এমনকি প্রদত্ত কবিতা বা গদ্যের শব্দ বা শব্দগুচ্ছ হুবহু ব্যবহার করা যাবে না। যেমন : ‘কবি এখানে বলতে চেয়েছেন ..... ‘; ‘লেখকের মতে .......’ ইত্যাদি।
৮। প্রবাদ-প্রবচনের সঠিক ব্যবহার লেখার তীক্ষ্নতা বৃদ্ধি করে বলে তা গ্রহণযোগ্য। প্রয়োজনে যুক্তিযুক্ত উপমা কিংবা উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে অযথা উদ্ধৃতির ব্যবহার মূল বিষয়ের সৌন্দর্যহানি ঘটায় বলে তা অবশ্যই বর্জনীয়।
উপর্যুক্ত নিয়মগুলো অনুসরণ করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
সঙ্গতি : একজাতীয় ভাবের বাক্যকে পাশাপাশি অবস্থিত আরেক জাতীয় ভাবের বাক্যের সাথে গঠনগত এবং ভঙ্গির দিক থেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, অর্থাৎ একটি বাক্যের ভাবের গতিকে পরবর্তী ভাবের মধ্যে মসৃণভাবে অনুপ্রবিষ্ট করে দিতে হবে। এভাবে একটি অনুচ্ছেদের সাথে পরবর্তী অনুচ্ছেদটিকে কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গেঁথে দেয়া যায় তাও ভাবতে হবে। বাক্যের সাথে বাক্যের বা অনুচ্ছেদের সাথে অনুচ্ছেদের এই সঙ্গতি বিধানের উপায়কে ‘সঙ্গতি’ (coherence) বলে আখ্যায়িত করা যায়।
নিচের অনুচ্ছেদটি লক্ষ কর
মানুষ সামাজিক জীব। তাকে সমাজের আর দশজনের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এই বন্ধন পারস্পরিক নির্ভরশীলতার, পারস্পরিক সহানুভূতির। কারণ, কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একের সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে, আচারে-অনুষ্ঠানে, সব ক্ষেত্রেই অপরের অবদান বিদ্যমান। সমাজের বিশাল পরিবারের তারা প্রত্যেকেই এক এক জন সদস্য। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাথে বাঁধা। ফলে, প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের কোনো-না-কোনো দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক বিদ্যমান। মোটের উপর, এই দেয়া-নেয়া হল বন্ধুত্বের দেয়া-নেয়া, হৃদ্যতার আদান-প্রদান। কিন্তু, বিশেষভাবে সংকীর্ণ অর্থে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, সেই দেয়া-নেয়ার মধ্যে বস্তুগত উপাদানও রয়েছে।
উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদটিতে মোট অক্ষর বিশিষ্ট পদগুলো বাক্যের সাথে বাক্যের সঙ্গতি রক্ষার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
তথ্য এবং অভিমত
যে-কোনো লেখায়, লেখকের কিছু তথ্য এবং অভিমত মিশ্রিত থাকা স্বাভাবিক। এ কারণে এ-দুটি উপাদানকে লেখার মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেন কোনটি তথ্য কোনটি অভিমত তা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়। যেমন : তথ্য উপস্থাপন করার আগে অনেক সময় কোনো সংকেত দেয়াই হয় না। আবার কখনো কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে সে ব্যাপারে আগে থেকে আভাস দেয়া হয়। যেমন : অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ...... / বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, ...... / প্রকৃতপক্ষে, ....... / আসলে, ....... / দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ...... ইত্যাদি। অপরপক্ষে, মতামত বা অভিমত প্রকাশ করার আগে কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত, যেমন : এ-ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, ......./ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বা হচ্ছে ...... / বলা হয়ে থাকে যে, ...... ইত্যাদি।
বৈচিত্র্য এবং বাক্যবিন্যাস
রচনা, ভাব-সম্প্রসারণ, প্রতিবেদন, গল্প, গবেষণাপত্র ইত্যাদি লেখার সময়- সঠিক বাক্যবিন্যাসের মাধ্যমে লেখায় বা বক্তব্যের উপস্থাপনে কীভাবে বৈচিত্র্য আনা যায় সে-দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। দেখতে হবে সব বাক্যের দৈর্ঘ্য যেন একরূপ না হয়। তাতে লেখাটিতে একঘেয়েমির দোষ এসে যাবে। এছাড়া কিছু কিছু বিশেষ গঠনের বাক্যের সাথে অন্যান্য নির্দিষ্ট কিছু গঠনের বাক্য খাপ খায় না, বা তারা পাশাপাশি অবস্থান করলে লেখার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। যেমন, একই ভাবকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে একই অনুচ্ছেদে কর্তৃবাচ্যের বাক্য এবং কর্মবাচ্যের বাক্য ব্যবহার কালে অনুচ্ছেদের গঠনগত সৌন্দর্য নষ্ট হবার সাথে সাথে তার উপস্থাপনগত অসঙ্গতি দেখা দেয়। আরো কিছু ক্ষেত্রে এরূপ সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং এ- বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে।
অন্তঃস্থাপন
কখনো কখনো একটি বাক্যকে অন্য একটি বাক্যের অংশ হিসেবে অনুপ্রবিষ্ট করানো হয়, যাকে পুরোপরি স্বতন্ত্র একটি বাক্য হিসেবে ব্যবহার করা যেত। বৈচিত্র্য, সংক্ষিপ্ততা এবং নাটকীয়তা আনয়নের উদ্দেশ্যে লেখার মধ্যে এভাবে একটি বাক্যকে অন্য একটি বাক্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই উপায়টিকে ‘অন্তঃস্থাপন’ নামে অভিহিত করা যায়। লেখার মান উন্নত করার জন্যে এটি একটি বহুল-ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এভাবে ব্যবহৃত অনুপ্রবিষ্ট বাক্যকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল বাক্য থেকে কমা ( , ) বা ড্যাশ ( - ) চিহ্ন দ্বারা বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। যেমন : রহিম সাহেব আজ মারা গেছেন। তিনি ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এ-বাক্য দুটির বদলে একটিমাত্র বাক্য লেখা যায়, যেখানে প্রথমটিতে দ্বিতীয়টি অন্তঃস্থাপিত। যেমন : রহিম সাহেব এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আজ মারা গেছেন।
Hmmmmm Thtz Nice atleast For First timer.
ReplyDeleteVery well written...
ReplyDeleteAdmin Qus-
ReplyDeleteভাইয়া তুমি তোমার এই পোস্ট এবং বাকি পোস্টগুলো কিভাবে SEO করো সেটা নিয়ে লিখলে প্রচুর উপকৃত হতাম। এটাকে একটা অনুরোধ মনে করো।
আমার দারুন সাহায্য করে
ReplyDeletewow
ReplyDelete