মার্চের দিনগুলি

রচনা : বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা

↬ সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা

↬ সবার জন্যে শিক্ষা

↬ গণশিক্ষা

↬ মাবন সম্পদ উন্নয়নে সার্বজনীন শিক্ষার ভূমিকা


ভূমিকা : স্বাধীন দেশে জাতীয় অগ্রগতি ও আর্থিক-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে চাই সবার জন্যে শিক্ষা। আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানব সম্পদে পরিণত করার জন্যেও চাই উপযুক্ত শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা সেই শিক্ষা প্রাথমিক স্তর বা নিম্নতম সোপান। প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের জাতীয় শিক্ষারও মূল ভিত্তি। তাই শিক্ষিত, মর্যাদাসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বা সবার জন্যে শিক্ষা কর্মসূচির সফল বাস্তমায়ন।

প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব : প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষিত জাতি ও শ্রমশক্তি গড়ে তোলার ভিত। দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা ও পশ্চাদপদতার হাত থেকে জাতির উত্তরণ ঘটাতে হলে চাই সবার জন্যে শিক্ষা। দেশের প্রত্যেকের পক্ষে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করা সম্ভব না হলেও সকলের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের অন্তর্নিহিত সৃজনীশক্তির অঙ্কুরোদ্গম হয়। তারা ভাষিক, সাহিত্যিক ও গাণিতিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি শৃঙ্খলা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা ইত্যদির শিক্ষা পায়। নিজেদের নম্র, মার্জিত, বিনয়ী, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রেরণা পায়। একই সঙ্গে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজকর্মের ধারণা পায়। তাই জাতীয় বিকাশ ও উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষা পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার দিকটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের উদ্যোগ : সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রায় দেড়’শ বছর আগে থেকে। ১৮৪৫ সালে ‘উডস এডুকেশন ডেসপাচ’ থেকে শুরু করে ১৮৮২ সালের ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন’, ১৯১৭-২৭ কালপর্বের ’বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন’, ১৯৪৪ সালের ‘সার্জেন্ট রিপোর্ট’ ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রস্তাব ও উদ্যোগ সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হয় নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫-এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তা কমিশনের প্রস্তাবও উপেক্ষিত হয়। শেষে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ২০০০ সালের মধ্যে দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু ২০০০ সালের শেষে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত লোকের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৭ কোটি। ফলে সার্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের পথে বিরাট সমস্য থেকেই যাচ্ছে।

সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পথে বাধা : সার্বজনীন প্রথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব ছাড়াও কিছু বাস্তব বাধা রয়েছে। প্রধান প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

(১) চরম দারিদ্র্যের কারণে বিপুল সংখ্যক অভিভাবকের কাছে প্রতিপাল্যকে স্কুলে পাঠানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে খেতে খামারে বা শহরাঞ্চলে কায়িক শ্রমের কাজে লাগানোই তারা শ্রেয় মনে করেন;

(২) আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে অনেক লোকেরই রয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কার। এদের ভ্রান্ত ধারণা : আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এদের সন্তান ধর্মকর্ম ও মাতাপিতাকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করবে;

(৩) গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক সংখ্যক অভিবাবকের মধ্যে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাব রয়েছে;

(৪) প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠক্রম বহুলাংশে গ্রামাঞ্চলের নিম্নবর্ণের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও জীবনমুখী নয়;

(৫) সাধারণভাবে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম গ্রামাঞ্চলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বাস্তব জীবনের সঙ্গে শিক্ষার যোগসূত্র ক্ষীণ;

(৬) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সবার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। তারা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনের দিকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারছেন না।

সার্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপায় : সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন নির্ভর করছে সরকার, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক সম্প্রদায়, শিক্ষাবিদ সম্প্রদায়, অভিভাবকসহ সব মহলের সর্বাঙ্গীণ ও সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর। এক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে :

(১) গণমাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের ব্যাপক ও নিয়মিত প্রচার;

(২) দরিদ্র্যপীড়িত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্যে খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এ নিয়ে যে কোনো ধরনের দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন;

(৩) দারিদ্র্যপীড়িত ছাত্রচাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে বইপত্র ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ;

(৪) স্কুলগামী শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি নারী বলে কন্যা সন্তানদের শিক্ষার জন্যে বিশেষ আন্দোলন সংগঠন পদক্ষেপ গ্রহণ;

(৫) দেশের শিক্ষিত বেকারদের সংগঠিত করে তাদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে শিক্ষা সম্প্রসারণে ব্রতী ও প্রাণিত করা ইত্যাদি।

উপসংহার : সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রসার সহজ কাজ নয়। এজন্যে চাই জাতীয় উদ্যোগ, প্রাণবন্ত নিরলস উদ্দীপনাময় ভূমিকা। জাতীয় ভিত্তিক জাগরণমূলক প্রচেষ্টা নিয়েই রাশিয়া শতকরা ১০০ ভাগ, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ শতকরা ৯৮ ভাগ, এমনকি জাপান শতকরা ৯৯ ভাগ স্বাক্ষরতা অর্জন করেছে। আমাদেরও তেমনি জাতীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের পথে বাস্তব বাধাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। সেগুলো মোকাবেলা করে দৃঢ় পায়ে অগ্রসর হতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অভিবাবক, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষাবিদ সম্প্রদায়, সম্মানিত শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষিত তরুণ সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হলে পথের বাধা যে দূর হবে তাতে সন্দেহ নেই।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post