মার্চের দিনগুলি

রচনা : নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

↬ নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান

↬ নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ


ভূমিকা : বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করে লিখেছিলেন—

“ছয় কোটি ষাট লক্ষের ক্রন্দন ধ্বনিতে আকাশ যে ফাটিয়া যাইতেছে— বাঙ্গালার লোক যে লিখিল না, বাঙ্গালায় লোক যে শিক্ষিত হয় নাই; ইহা সুশিক্ষিত বুঝেন না।”

বস্তুত শিক্ষাই সব সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক তাবৎ অমঙ্গল নিবারণের উপায়। অশিক্ষাই বৈষম্যকে, তাবৎ দুঃখকে স্থায়ী করে। তাই নিরক্ষরতা যে কোনো দেশের, যে কোনো জাতির পক্ষে এক নিদারুণ অভিশাপ।

বিজ্ঞানের বিস্ময় ও নিরক্ষরতার অভিশাপ : স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সেই ১৯৭১ সালে। কিন্তু বিশ্ব সমাজে বাংলাদেশ এখনো মর্যাদাবান জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারে নি। জাতি হিসেবে আমরা এখনো ব্যাপক অনগ্রসর। আর এর জন্য যতগুলো সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায় তার মধ্যে নিরক্ষরতা অন্যতম। বর্তমানে এদেশে প্রায় ৭৭ জন লোক নিরক্ষর। এর মধ্যে নারীশিক্ষার হার খুবই শ্লথ। সমগ্র পৃথিবীতে যেখানে নিরক্ষরে সংখ্যা ১৯৭০ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগ থেকে কমে ২২ ভাগ এ কমে এসে দাঁড়িয়েছে ; সেখানে এ একটি দেশের জনসংখ্যা শিক্ষার হার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ কথা ভাবতে খুবই অবাক লাগে। অথব এ পৃথিবীর মানুষ ইতোমধ্যে আবিষ্কার করেছে পারমাণবিক বোমা৷ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। তারা নক্ষত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অ্যান্টকর্টিকা অভিযানে অভাবনীয় সাফল্যের অধিকারী হয়েছে, চাঁদে মানুষ নামিয়েছে, মঙ্গলগ্রহে অভিযান চালিয়েছে, মহাকাশে দীর্ঘকাল অবস্থানের রহস্য আয়ত্ত করেছে। সেই পৃথিবীর মাটির উপর যাদের বাস, সেই বিজ্ঞানের গৌরবময় যুগে যাদের বসবাস, তারা নিরক্ষর ; তারা লিখতে পড়তে জানে না, নিজের নাম সই করতে জানে না।।তারা বৃহৎ জগৎ তো দূরের কথা, নিজের দেশের ব্যক্তির কোনো সন্ধান রাখে না— এও সত্য ; নিদারুণ সত্য। এ বেদনা, এ অপমান আজ অসহনীয়। এ যেন আত্মঘাতী ছিন্নমস্তা – মূর্তি।

নিরক্ষরতার স্বরূপ : নিরক্ষরতা বলতে আমরা বুঝি অক্ষরজ্ঞানহীনতা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অক্ষরহীন, সেই হলো নিরক্ষর। নিরক্ষরতার জন্য জনগণের মনে কুসংস্কার বাসা বাঁধে। আর এ জন্য তারা মনে উন্নত চিন্তা চেতনা জাগ্রত করতে পারে না। আমাদের দেশের অনেক সমস্যা এবং এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের পথে প্রধান বাঁধা হচ্ছে নিরক্ষরতা। আমাদের দেশে দুই - তৃতীয়াংশ লোকই নিরক্ষর। তাছাড়া আমাদের দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না নিরক্ষরতার কারণে। এজন্য বহির্বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির অভাব পূরণ করতে পারছে না। ফলে দেশের উন্নয়নে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রভাবকের কাজ করছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। একটি দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিও নিরক্ষরতা ফল। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করছে নিরক্ষরতা। শিক্ষার অভাবে জাতীয় জীবনে বড় কোনো সমস্যা মোকাবিলা করাও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের জাতীয় জীবনকে অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি করছে নিরক্ষরতা।

নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় : নিরক্ষরতা একটি ভয়াবহ সমস্যা। দেশের উন্নয়নের পথে এটি একটি হুমকিস্বরুপ। এজন্য নিরক্ষরতা দূরীকরণে আমাদের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন :

(ক) বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকরী করা।

(খ) প্রত্যেক পরিবারকে তাদের শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হবে।

(গ) দরিদ্র ও মেধাবী শিশুদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে হবে। এজন্য সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

(ঘ) বয়স্ক শিক্ষাক্রম জোরদার করতে হবে। এ ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করতে হলে দেশের বিভিন্ন স্তরের ছাত্র, শিক্ষক ও বিভিন্ন ধরনের সমাজকর্মী এবং অন্যান্য শিক্ষিত জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি পাড়া মহল্লা এবং গ্রামে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

(ঙ) বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আর তাই কৃষির এ দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে। দেশের অধিকাংশ কৃষক নিরক্ষর বলে তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করতে পারে না এবং কৃষিকাজের বিভিন্ন লাভজনক পদ্ধতি সমূহ জানে না। এজন্য কৃষকদের শিক্ষিত করে তোলা একান্ত প্রয়োজন।

(চ) দেশের নিরক্ষর জনগণকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয়ভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

(ছ) সর্বোপরি ছাত্র সমাজকে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে গৃহীত ব্যবস্থা : নিরক্ষরতা দূরীকরণে সরকার ইতিমধ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। সরকার ২০০০ সালে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। তাছাড়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা ও গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। ১৯৯৩ সাল থেকে সরকার খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এছাড়া মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা পরিচালনা করে আসছে। এখন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ ও নানা রকম উপবৃত্তি সুবিধা চালু করেছে মানুষকে শিক্ষামুখী করতে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ব্যবহৃত পদ্ধতি : নিরক্ষরতা দূরীকরণে সরকারের পাশাপাশি ছাত্রসমাজ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি উদ্যোগে অর্থের অপ্রতুলতা, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা, সরকারি কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রীতার বাধা ইত্যাদির জন্য নিরক্ষরতা দূরীকরণে ঈপ্সিত সুফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ছাত্র সমাজকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ ছাত্রসমাজ এদেশে নবচেতনা সঞ্চারে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাই ছাত্র সমাজকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে আত্মনিয়োগ করলে এদেশ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করা সম্ভব। দেশের সব জায়গায় ছাত্র সমাজ ছড়িয়ে রয়েছে। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজ কাজ করে তাহলে দেশে শিক্ষিতের হার বাড়বে এবং দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজ কীভাবে কাজে লাগতে পারে তার একটি পরিকল্পনা তারা তৈরি করতে পারে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাদের সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো নিম্নরূপ :

১. ছাত্রদের আসেপাশে বসবাসকারী নিরক্ষর মানুষের একটি তালিকা তৈরি করা।

২. স্থানীয় কোনো সংগঠন, কর্তৃপক্ষ কিংবা তারা নিজেরা কয়েকজন মিলে এলাকার নিরক্ষর লোকদের একটি সংগঠন তৈরি করা। এক্ষেত্রে পাড়া বা মহল্লার ছাত্রদের সাথে যৌথভাবে কাজে হাত দিলে তা বেশি ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৩. সাক্ষরতা বৃদ্ধি কার্যের জন্য একটি নিদির্ষ্ট সাক্ষরতা কেন্দ্র নির্মাণ করা।

৪. স্কুল ছুটির পর বা ছুটির দিনে যখন স্কুলগৃহ খালি পড়ে থাকে তখন ছাত্ররা সেটা কাজে লাগাতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ক্লাব ঘর, বাড়ীর আঙিনা কিংবা আম কাঁঠালের বাগানে পরিষ্কার জায়গাগুলোতে সাক্ষরতা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে স্থানীয় নিরক্ষরদের শিক্ষার ব্যবস্থা ছাত্র সমাজ করতে পারে।

৫. দরিদ্র নিরক্ষরদের মাঝে নিজেরা চাঁদা তুলে বিনামূল্যে বই খাতা তথা শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে পারে।

৬. স্কুলের শিক্ষক কিংবা মসজিদের ঈমামের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কর্মসূচী ত্বরান্বিত করতে পারে।

৭. সরকারি গণশিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষকতার কাজ করতে পারে। এক সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সাথে কর্ম অভিজ্ঞতা নামে ছাত্র ছাত্রীদের সাক্ষরতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন শুরুর আগে নিরক্ষরতা দূরীকরণে কিছু দায়িত্ব বাধ্যতামূলকভাবে দেওয়ার রীতি আছে। এ ধরনের ব্যবস্থাগুলোর মতো আরও কিছু ব্যবস্থা সরকার করে দিলে ছাত্ররা তাড দায়িত্ব নিতে পারে।

ছাত্র সমাজ যদি নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজে আন্তরিকতা ও সততার সাথে এগিয়ে আসে তাহলে দেশ থেকে এ সমস্যা অচিরেই দূর করা সম্ভব।

নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় : নিরক্ষরতার এ চিত্র মেনে নেওয়া যায় না। আর তাই ইতোমধ্যে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা মূলক কার্যক্রৃ শুরু হয়েছে। দল–মত নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরক্ষরমুক্ত দেশ গঠনের আন্দোলনে। এ আন্দোলন চলছে বিভিন্নভাবে। যথা :

ক. সরকারি প্রচেষ্টা : নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। যেমন : গণশিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিকরণ। তাছাড়া ' মিনা ' কার্টুনের মাধ্যমেও শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বহুবিধ তথ্য বেতার এবং টেলিভিশনে প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার ব্যাপক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

খ. বেসরকারী প্রচেষ্ঠা : সাক্ষরতা আন্দোলনকে কর্মসূচীকে সফল করার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকাও ব্যাপক। তবে আমাদের দেশে কয়েকটি এনজিও নিরক্ষরতা দূরীকরণে কর্মসূচী চালালেও এখন পর্যন্ত বেসরকারি উন্নয়ন খাতে উল্লেখ করার মতো কর্মসূচী চোখে পড়ে না। তবে এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রচেষ্টা খুবই জরুরি।

গ. ছাত্র সমাজের ভূমিকা : নিরক্ষরতা দূরীকরণে একটি দেশের ছাত্রসমাজ সবচেয়ে বেশি বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির সভাপতি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. সত্যেন্দ্রনাথ সেনের বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭৩ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসে তিনি ঘোষণা করেছিলেন—

“ছাত্র শিক্ষকদের অকুণ্ঠ ও জোরালো সহযোগিতা ছাড়া নিরক্ষরতা দূর করা সম্ভব নয়। ছাত্রদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে তার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে।”

তিনি আরো বলেন,

“বিশেষত ছাত্র–ছাত্রীদের এই কার্যক্রমে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই দেশের মধ্য থেকে নিরক্ষরতাকে উচ্ছেদ করা যায়।”

প্রকৃতপক্ষে নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজই কেবল সবচেয়ে জোরালে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, বহু বছর আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ লেখায় দেশের শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ছাত্রদের অফুরন্ত উৎসাহ, কর্মোদ্দীপনা ও মানসিক শক্তিকে অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। ‘অপমান’ (নামান্তর ‘দুর্ভাগা দেশ’) কবিতায় তিনি বলেছিলেন,

“অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।”

অতএব, দেশ এবং মঙ্গলের উদ্দেশ্যে ছাত্রদের নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া একান্ত কাম্য। আর নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজ দুটি পর্যায়ে এগোতে পারে। যথা : (ক) ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং (খ) সমষ্টিগত পর্যায়ে। মূলত স্কুল - কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দীর্ঘকালীন ছুটি পাওয়া যায় তখন ছাত্ররা দল বেঁধে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাময়িক অক্ষর - শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। তাছাড়া তারা ব্যক্তিগতভাবে যদি প্রত্যেকে একজন করেও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলে তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৮০ – ৮৫ শতাংশে এসে দাঁড়াবে। তাই ছাত্রদের এখনই এ সামাজিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা : নিরক্ষরতার হাত থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সর্বস্তরের শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারি এবং বেসরকারিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে গোটা শিক্ষিত জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে।

বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা : জনবহুল বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই নিরক্ষর। শিশুদের মতো বয়স্কদেরও শিক্ষাদানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গ্রামে গ্রামে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে এ শ্রেণির বয়স্কদের পাঠদান করতে হবে। আমাদের দেশে এ জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য। এ ধরনের শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে ব্যাপকতায় রূপদান করতে হবে।

নারীশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব : সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন,

“Give me a good mother I will give you a good nation.”

একজন শিক্ষিত মা–ই তার সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারেন। কেননা পরিবার হলো একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাদানের সবচেয়ে প্রথম ও সহজতম মাধ্যম। তাই জাতিকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হলে নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। নারী এবং পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। এদের যে কোনো একজনকে পশ্চাতে রেখে অপরজনকে সামনে এগিয়ে নেওয়া দূরহ ব্যাপার। এ সম্পর্কে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়—

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির–কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

পৃথিবীর প্রত্যেক মহৎ কর্মের পেছনে নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান কাজ করে। এজন্য সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে, সমাজকে শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে নারী শিক্ষার পেছনেও গুরুত্ব দিতে হবে। পুরুষদের নিরক্ষরতা থেকে সাক্ষরতা সম্পন্ন করতে তাদের অর্ধাঙ্গীদেরও সচেতন করতে হবে। তাদেরকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা : যে কোনো জাতির উন্নয়নের জন্য প্রথম ও প্রধান উপকরণ হচ্ছে শিক্ষা। কারণ শিক্ষা ছাড়া কোনো কখনো সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। এজন্য বলা হয়ে থাকে—

“Education is the backbone of a nation.”

অর্থাৎ একটা জাতির মূল চালিকা শক্তি তার চলার মেরুদণ্ড হল তার শিক্ষিত জনবল। এজন্য দেশকে এগিয়ে দেশকে উন্নতির শিখরে তুলতে সকল স্তরে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জনসমষ্টিকে শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। নিরক্ষরতা পদে পদে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একজন নিরক্ষর মানুষ ব্যক্তি জীবনে যেমন অভিশপ্ত তেমনি জাতীয় জীবনেও তিনি একটি অভিশাপ। তাই সমগ্র জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে সাক্ষরতার প্রয়োজন বাঞ্ছনীয়।

আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠনে নিরক্ষরতা দূরীকরণ : পরিবার বলতে আমরা মূলত মা, বাবা, ভাই–বোন, চাচা–চাচি ও দাদা–দাদি সবাই মিলে একত্রে বসবাস করা বুঝি। কিন্তু একটি পরিবার শিক্ষিত হলে সেই পরিবার হয়ে ওঠে একটি আদর্শ পরিবার। নিরক্ষর পরিবারে সবসময়ই নানা রকম

ঝগড়াঝাটি, বিবাদ–কলহ ও বিরোধ লেগেই থাকে। আবার একজন বাবা এবং মা নিরক্ষর হলে তার সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে তারাও উদাসীন থাকে। একজন অশিক্ষিত বাবা–মা তার সন্তানের সঠিকভাবে লালন পালন করতে পারেন না৷ তাই একটি আদর্শ পরিবার গঠন করতে একটি শিক্ষিত পরিবার আবশ্যক। সেজন্য পরিবারের সদস্যকে শিক্ষিত করতে হলে শিক্ষিত হতে হবে আপনাকে আমাকে। কারণ একটি আদর্শ পরিবার উপহার দিতে পারে একটি আদর্শ সমাজ। তাই আদর্শ সমাজ গঠনেও নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রয়োজন।

আদর্শ জাতির রাষ্ট্র গঠনে নিরক্ষরতা দূরীকরণ : একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে আদর্শ সমাজ ও পরিবার গঠন করা আবশ্যিক। আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠনের জন্য নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রয়োজন। কেননা আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠিত হলে আদর্শ জাতি ও একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠিত হবে। অর্থাৎ আদর্শ জাতি এবং রাষ্ট্র গঠন করতে হলে নিরক্ষরতা দূর করা প্রয়োজন। সাক্ষরতা ছাড়া, শিক্ষা ছাড়া সচেতন নাগরিক হওয়া যায় না। আর সচেতন নাগরিক না হলে আদর্শ জাতি ও রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। উন্নত জাতীয় চরিত্র গঠন৷ উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন নিরক্ষরতা দূরীকরণ। আজকে আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো তাদের উন্নত হওয়ার অন্যতম কারিগর তাদের শিক্ষা। একটি জাতি শিক্ষিত হলে তার জনবল শিক্ষিত হয়। আর একটি শিক্ষিত জনবল একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। দেশকে এগিয়ে একটি শিক্ষিত জনবলই যথেষ্ট। এজন্য দেশকে এগিয়ে নিতে, দেশের উন্নতি করতে হলে সামগ্রিকভাবে আগে তার জনগণকে শিক্ষিত করতে হবে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণ নবযুগের জিয়নকাঠি : এখন পৃথিবীতে চলছে বিজ্ঞানের যুগ। এই নবযুগে আমাদের দেশের কৃষক, কুটিরশিল্পী, দোকানদার সবাইকে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। নতুবা তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। এই নবযুগে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো নিরক্ষরতা দূরীকরণ। এজন্যই নবযুগের জিয়নকাঠি হলো সাক্ষরতা বা নিরক্ষরতা দূরীকরণ।

উপসংহার : নিরক্ষরতা আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ দেশ সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অভিষ্ট লক্ষ্যে কখনও পৌঁছাতে পারবে না। তাই অনতিবিলম্বে এ ব্যাপারে সম্মিলিত প্রয়াস নিতে হবে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা :
শিক্ষাই জাতির মেরাদণ্ড এবং নিরক্ষরতা দুর্ভাগ্যের প্রসূতিস্বরূপ।

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীতে শিক্ষা বা জ্ঞানই একমাত্র সম্পদ যা জীবনের মতো মহামূল্যবান। এ থেকেই অনুমান করা যায়, নিরক্ষরতা যেকোনো জাতির জন্য কতটা হুমকিস্বরূপ। নিরক্ষরতা প্রতিটি জাতির জন্যই অভিশাপ। মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তি যেমন অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবনযাপন করে, নিরক্ষর ব্যক্তিকেও সমাজে তাই করতে হয়। নিরক্ষর ব্যক্তি অন্ধের সমান। অন্ধের মতোই তাকে অগ্রসর হতে হয়। তাই কোনো জাতির কাছেই নিরক্ষরতা কাম্য নয়। শিক্ষাই আলো- নিরক্ষরতা অন্ধকার। নিরক্ষরতার অন্ধকার ব্যক্তিজীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে, জীবনের বিকাশের কোনো পথ সেখানে নেই। প্রাণহীন জীবনের যেমন কোনো মূল্য থাকে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। তাই প্রতিটি মানুষকে নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশে নরক্ষরতার অবস্থা : বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.) শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি সুদূর চনদেশে যাওয়ার কথাও বলেছেন। এই জ্ঞানার্জনের পথ হচ্ছে শিক্ষা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সমৃদ্ধির পেছনে রয়েছে শিক্ষার অবদান। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জীবনে দারিতদ্র্যের অভিশাপ এসেছে ব্যাপক নিরক্ষরতার কারণে অর্থাৎ শিক্ষার অভাবে। বাংলাদেশে তার প্রভাব আরো ভয়াবহ এবং পরিণতি আশঙ্কাজনক। দেশের প্রায় চৌদ্দ কোটি মানুষের তেষট্টি ভাগ মাত্র তথাকথিত শিক্ষিত অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞান সম্মপন্ন- যারা কোনো রকমে নামমাত্র শিক্ষা পেয়েছে। ফলে যথার্থ শিক্ষিত লোকের সংখ্যা অনেকাংশে কমে আসছে। বাকিরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধু যে নিজের ও পরিবারের জীবনকেই বেদনাকাতর করছে তা নয়, জাতির জন্য বয়ে এনেছে ভয়াবহ অভিশাপ। নিরক্ষরতার জন্যই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি অনগ্রসর এবং পঙ্গু। নিরক্ষরতার জন্যই জীবনের সুখের আস্বাদন থেকে বাংলাদেশের মানুষ বঞ্চিত। জ্ঞানই যে শক্তি, একথা আজ আধুনিক বিশ্বে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না, অথচ আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শ লাভ করেও বাংলাদেশের ভাগ্যের আজো পরিবর্তন হয় নি, বরং শোষণের চাপে পড়ে জীবনে নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার। যুগে যুগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বরাবর অনুভূত হলেও যথার্থ উদ্যোগের অভাবে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে রেহাই পাওয়া যায় নি।

নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রয়োজনীয়তা : নিরক্ষরতার অভিশাপ মাথায় নিয়ে কোনো জাতি উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। নিরক্ষরতা ব্যক্তিজীবনকে যেমন পঙ্গু করে, দেশ ও জাতিকেও তেমনি নিমজ্জিত করে অবনতির অন্ধকারে। তাই আমাদের জাতীয় জীবন থেকে এই নির্মম অভিশাপ দূর করতে হবে বিশ্বের বহু দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও একসময় নিরক্ষরতার অভিশাপ ছিল। ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টার সাহায্যে তারা তাদের জাতীয় জীবন থেকে এ নিরক্ষরতার দুঃখ দূর করতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের জীবনে অবহেলার জন্য এ সমস্যা এখনো প্রকট। অবশ্য নিরক্ষরতা দূরীকরণ খুব সহজ কাজ নয় এবং তাতে সমগ্র জাতি অংশগ্রহণ না করলে এর রাহুগ্রাস থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তাই এমন কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, যার কার্যকারিতায় আমাদের জীবন থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করা যায়। ইউরোপ ও আরমেরিকার অধিকাংশ দেশেই শিক্ষার হার শতকরা শতভাগে উন্নীত হয়েছে। তাই তাদের দেশ হয়েছে এতটা উন্নত। আমরাও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে পারি। তা না হলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। নিরক্ষরমুক্ত হলেই আমাদের দেশ উন্নত হবে। কাজেই নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে গৃহীত পদক্ষেপ : বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই সংগ্রামী। পরাধীনতার শিকল ভেঙে তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে। স্বাধীন দেশকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে দেশের মানুষকে শিক্ষিত হতে হবে। এই লক্ষ্য নিয়েই বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। স্বাধীনতার রঙিন সূর্য আমাদের জাতীয় জীবনে যে নবচেতনার সৃষ্টি করেছে তার প্রভাবে আমরা আত্মসচেতন হয়ে উঠেছি ও এই চেতনা থেকেই জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তাতীয় জীবনে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে ১৯৮০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানের সূচনা হয়েছিল। তখন লক্ষ্য ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ, ১৯৮৫ সাল নাগাদ জাতীয় জীবন থেকে এই সমস্যা দুর করা; তা সফল না হওয়ার কারণে ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষার ঘোষণা দিয়ে সে সাথে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তার মধ্যে গণশিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া মেয়েদের শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য ক্রমান্বয়ে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পদক্ষেপগুলোর আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেছে। সর্বোপরি জাতিকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নেয়া হয়েছে আরো অনেক উদ্যোগ। সম্প্রতি নতুনভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সরকারি ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। ফলে নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় সম্পর্কে আশাবাদী হওয়া যায়। ২০০৬ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল তা সম্পূর্ণ সফল না হলেও সথেষ্ট অগ্রগতি এসেছে।

বয়স্ক শিক্ষা চালু : আমাদের অনেকেরই ধারণা শিক্ষার একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে, আর তা হলো শৈশবকাল। এ সময় পার হলে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু এ ধারণা যে ঠিক নয়, তা আজ নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আজ থেকে চৌদ্দ শ বছর আগে বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছিলেন ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার সময়।’ তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, শিক্ষার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। সব সময়ই শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। তবে শিক্ষার একটা পর্যায়কে ধরে রাখতে হলে অবশ্যই শৈশবকাল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। কিন্তু যারা শৈশবে শিক্ষাগ্রহণ করে নি এবং বয়স্ক, তাদেরকে যে নিরক্ষরতার হাত থেকে মুক্ত করা যাবে না- তা নয়। তবে তাদের আগ্রহ থাকতে হবে। এই বয়স্কদের নিরক্ষরমুক্ত করার জন্যই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা নিজের বেলায় কাজকর্ম সেরে রাতের বেলায় এসব কেন্দ্রে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এলাকার শিক্ষিত লোকদের সহযোগিতায় এ কার্যক্রম নিরক্ষরতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনতে পারে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা : ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ। যুগে যুগে তারা দেশের জন্য, জাতির জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সফলতা এনেছে। আমাদের জাতীয় জীবনে আজ নানা সমস্যা বিরাজমান। তার মধ্যে নিরক্ষরতা একটি ভয়াবহ জটিল সমস্যা। এ সমস্যার কারণে দেশ এবং জাতি আজ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। শিক্ষা ছাড়া যেকোনো কাজ ভালোভাবে করা যায় না। মাঠে যে কৃষক কাজ করে তারও লেখাপড়া জানা দরকার। বাংলাদেশকে নিরক্ষরমুক্ত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা যাতে সরাসরি নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে সে জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ছাত্রসমাজ জাতির উন্নয়ন কাজে একটি উপযোগী মাধ্যম হতে পারে। ছাত্রদের লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তবে সারাক্ষণ তারা লেখাপড়ায় মগ্ন থাকে না। তাদের অবসর সময় নিয়ে যদি এমন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়, যেখানে তাদের নিরক্ষরতা দুরীকরণের কাজে লাগানো যাবে, তাহলে দেশের এই ভয়াবহ সমস্যা দূর করা তেমন কঠিন হবে না। আর যদি ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে দেশের এই সমস্যা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা বিশেষভাবে স্বীকৃতি পাবে।

ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছু অবসর সময় থাকে। এই অবসরটুকু যদি নিরক্ষরদের লেখাপড়ার জন্য ব্যয় হয় তবে বেশ বড় কাজ হতে পারে। প্রত্যেক বাড়িতেই কিছু নিরক্ষর লোক থাকে। নিজের পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বা ফাঁকে ফাঁকে তাদের লেখাপড়া শেখানো যায়। পাড়াপ্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেরই লেখাপড়া জানা নেই। পাড়ার ছাত্ররা যদি মিলিতভাবে লেখাপড়া শেখানোর কাজে লাগে, তবে খুব কম সময়ে সবাইকে শিক্ষিত করে তোলা যাবে।

বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন জাতীয় জীবন থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করার কর্মসূচি পালন করে থাকে। সেসব সংগঠনের সাথে ছাত্রসমাজ জড়িত। এক্ষেত্রে ছাত্রদের আরো বেশি করে কাজে লাগানো উচিত। বিশেষকরে ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা হলো ছুটির দিনগুলোতে কাজ করা। সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও আছে গ্রীষ্মের ছুটি, রমযানের ছুটি, শীতের ছুটি ইত্যাদি। এসব ছুটিতে ছাত্রছাত্রীরা নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজ করতে পারে। দেশে অনেক গণশিক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে ছাত্ররা এসব কেন্দ্রে কাজ করলে আমাদের জাতীয় জীবন থেকে অচিরেই নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর হবে।

উপসংহার : নিরক্ষরতার মতো এত বড় অভিশাপ আর নেই। আমাদের জাতীয় জীবন থেকে এই অভিশাপ দূর করতে হলে সুপরিকল্পিতভাবে ছাত্রসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। ছাত্ররাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের মধ্যে যদি আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়, তবে যেকোনো সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post