প্রবন্ধ রচনা : বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ

ভূমিকা : বিশ্বায়ন আধুনিক বিশ্বের একটি প্রক্রিয়া যা রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের পুরোনো কাঠামো ও সীমানাকে ক্রম-অবলুপ্ত করে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ক্রমিক পরাজাতিকরণ (Trans-Nationalization) ঘটাচ্ছে এবং এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক বিশ্বসীমানা ও বিশ্বসম্প্রদায়। অন্যভাবে বিশ্বায়নকে বলা চলে বি-আঞ্চলিকীকরণ (de-localization) প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ফলে আমাদের জীবনযাত্রা আর ‘স্থানীয়’ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। আমাদের খাদ্য, আমাদের পোশাক, আমাদের সংগীত- এগুলোর স্বতন্ত্র্যের সীমা ক্রমেই ভেঙে যাচ্ছে আর তা হয়ে উঠছে ক্রম বিশ্বায়িত। আর বিশ্বায়ন কথাটার সূত্রে আমরা পরিচিত হচ্ছি নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে। আমাদের ধারণার ভাণ্ডারে যোগ হচ্ছে ‘মুক্ত আকাশ, ‘মুক্ত বাজার’, ’মুক্ত অর্থনীতি’, ‘মুক্ত সংস্কৃতি’, ‘ভিসামুক্ত বিশ্ব’, ’বিশ্বনাগরিকত্ব’, ‘বিশ্বগ্রাম’ ইত্যাদি প্রত্যয়। বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে সতর্ক আলোচনা গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে।

বিশ্বায়ন কী? : বিশ্বায়ন বহুমাত্রিক একটি ধারণা ও প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত ও অভাবনীয় উন্নতি এবং সেই সঙ্গে সড়ক, নৌ ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপি বিপুল পণ্যবাণিজ্যের প্রসারের ফলে বিশ্বের দেশে দেশে দ্রুত যোগাযোগ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জালবিস্তার, যোগাযোগের ক্ষেত্রে যোগাযোগ উপগ্রহ, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, ই-মেইল ইত্যাদির বিস্ময়কর উন্নয়ন এবং মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে কম্পিউটার, টেলিফোন ও টেলিভিশনের যুগপৎ ব্যবহারের ফলে বিশ্বের যেকোন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের মুহুর্তের যোগাযোগ ঘটেছে। এভাবে দেশ-ধর্ম-বর্ণ-পশা-মর্যাদা-লিঙ্গ-গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বের মানুষের পক্ষে একে অন্যের সান্নিধ্যে আসা একেবারে সহজ হয়ে উঠেছে। এভাবে বিশ্বব্যাপী মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রযুক্তিগত নৈকট্য ও অভিন্নতামুখিতার ধারাকে সাধারণভাবে অভিহিত করা চলে বিশ্বায়ন বলে। বিশ্বায়ন শব্দটি ইংরেজি “Globalization” শব্দের বাংলা পরিভাষা।

বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপট : পৃথিবীতে বিশ্বায়নের ব্যাপরটি একেবারে নতুন নয়। সভ্যতার জন্ম থেকেই বিশ্বায়নের প্রাথমিক সূচনা। সেকালে পরিব্রুজকের ধর্ম প্রচারের জন্য একদেশ থেকে অন্য দেশে যেতেন। চিন্তার আদান-প্রদান করতেন। দীর্ঘকাল ধরে সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য চলেছে। ডাক যোগাযোগ, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বেতার ইত্যাদির মাধ্যমেও বিশ্বের মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগান্তকারী অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়ন কথাটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এবং বিশ্বায়নের চরিত্র একেবারেই পাল্টে গেছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের কথাটা দিয়ে যুক্ত অর্থনীতির বিশ্বায়নকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি : অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন কথাটার অর্থ হচ্ছে মুক্ত অর্থনীতির নামে উচ্চতর পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন। এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো বিপুল লাভবান হবে। তারা তাদের অলস পুঁজি বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পাবে। অনুন্নত দেশের বাজারগুলো তাদের দখলে চলে যাবে। এদিক থেকে বিশ্বায়নের লক্ষ্য বিশ্বকে একক বাজারে পরিণত করে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদকে সাহায্য করা। এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো ফায়দা লুটবে আর অনুন্নত দেশগুলো তাদের আত্মরক্ষামূলক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে বাধ্য হবে। এর কারণ অনুন্নত দেশগুলো কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে এবং তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও হবে দুর্বল। তবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া যে খুব অবাদে চলবে তা নয়। ইতোমধ্যেই এর বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। অনুন্নত দেশগুলো বুঝতে পেরেছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে শিল্পোন্নত বিশ্ব অক্টোপাসের মতো বহুমুখী শোষণ জাল বিস্তার করছে বিশ্বায়নের নামে। অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অনুন্নত বিশ্বকে শোষণ করাই উন্নত বিশ্বের লক্ষ্য।

বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি : তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে ইতোমধ্যেই তথ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক তৎপরতারও হয়ে পড়েছে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর। বিশ্বায়নের ফল সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হবে মারাত্মক। বিশ্বায়ন স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে সংকর সংস্কৃতি তৈরি করবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তা ছাড়া বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া যে বিনোদন ও যৌ-নতা-নির্ভর সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করবে তার লক্ষণ আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ করছি। বিশ্বায়নের নামে তৃতীয় বিশ্বকে সংস্কৃতিক পণ্য বিস্তারের উর্বর ভূমি করে তোলার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সহিংসতা ও যৌ-নতার প্রসার ঘটবে।

বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিক : অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের কিছু ইতিবাচক দিক আছে। অবশ্য তার সুফল প্রধানত উন্নত দেশগুলোই পাবে। ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে : ১. দরিদ্র দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পাবে; ২. মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পূর্ণ প্রতিযোগিতা বাজার থাকবে। এর ফলে ক্রেতা বা ভোক্তার স্বার্থ রক্ষিত হবে; ৩. আমদানি-রপ্তানি অবাধ হওয়ায় যে কোন পণ্য বিশ্ব বাজারে ঢোকার সুযোগ পাবে; ৪. শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিনিময় অবাধ হবে; ৫. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিনিময় আরও সহজলভ্য ও গতিশীল হবে; ৬. মানুষের মেধা ও দক্ষতা বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকার পাবে বলে তার সঠিক মূল্যায়ন হবে; ৭. এক বিশ্ব এক জাতি ধারণার ফলে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও মানব সৌহার্দ্য বাড়বে; ৮. তৃতীয় দেশগুলি বৈদেশিক বিনিয়োগ সহায়তার পাশাপাশি জি. এস. পি. সুবিধা পাবে।

বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিক : বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিশ্বায়নের ফলে উন্নত বিশ্ব সাহায্য ও সুবিধা প্রদানের নামে তৃতীয় বিশ্বে বাজার সম্প্রসারণ ঘটাবে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে পরনির্ভরশীল করে তুলবে। এদিক থেকে নেতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে :

১. দেশীয় উৎপাদন কাঠামো, দেশীয় শিল্প ও দেশীয় প্রযুক্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে;
২. উন্নয়ন সাহায্যের নামে উন্নত দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বকে পরনির্ভরশীল করে তুলবে;
৩. মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে দেশীয় পুঁজি ধনী দেশগুলোর করতলে গত হবে;
৪. অবাধ তথ্য প্রবাহের ফলে স্থানীয় ও জাতীয় স্বকীয়ত্ব বিনষ্ট হবে;
৫. সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ ঘটবে। সংস্কৃতির সংকরায়ণ ঘটবে এবং জাতি-সম্প্রসায়ের বিশ্বাস, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হবে।
৬. সকল সুবিধা ভোগ করবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশগুলো।

বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ : বিশ্বায়নের প্রভাবে পরিবর্তনশীলতার জোয়ার লেগেছে বাংলাদেশেও। তার প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি অর্থনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিশ্বায়নের প্রভাবে গার্মেন্টস শিল্প পরিণত হয়েছে অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্পে। গড়ে উঠছে অনেকগুলো রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল বা এক্সপোর্ট প্রোসেসিং জোন। বিশ্বায়ন সমাজ জীবনে এনেছে পরিবর্তনের হাওয়া। বাংলাদেশের মানুষের ভাষা, পোশাক, জীবনযাত্রায় পড়ছে ভিনদেশি সংস্কৃতির ছাপ। আবার উল্টোটাও ঘটছে। বিশ্বায়নের কল্যাণে ১লা বৈশাখের মতো নিজস্ব সংস্কৃতি সমাদৃত হয়ে উঠছে বিশ্বের মানুষের কাছে। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন এ উৎসব দেখতে। এর বিপরীত ঘটনাও ঘটছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশের জারি, সারি, ভাটিয়ালি গান হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশের হাতে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে। ’বাংরেজি’ হয়ে উঠছে তাদের বুলি। তথাকথিত ইংরেজিয়ানা বা বিদেশিয়ানার দাপট ক্রমেই বাড়ছে। অনেক দেশীয় শিল্প বিদেশের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে বিদেশী পণ্যের বাজার। এভাবে বিশ্বায়ন নানা সুফল কুফলের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি-সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

উপসংহার : বিশ্বায়নের মূল লক্ষ্য উন্নত বিশ্বের জন্যে অধিকতর সবিধা নিশ্চিত করা। মানব কল্যাণ এর বুলি হলেও শেষ লক্ষ্য মানবকল্যাণ হয়, মুনাফা অর্জন। সে জন্যে তৃতীয় বিশ্বের যে সব দেশ বিশ্বায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন বিদেশী পুঁজি তাদের স্বার্থহানির কারণ না ঘটায়। অন্যদিকে উন্নত দেশ গুলিতেও যেন তৃতীয় বিশ্বের পণ্য অবাধ রপ্তানির সুযোগ পায়, সেখানে যেন কোনো দেয়াল না থাকে তারও নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বিশ্বায়নের সুফল কারা ভোগ করছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নকে বিশ্বের সকল দেশের জন্যে প্রকৃত উন্নয়ন প্রক্রিয়া হিসেবে নিশ্চিত করার জন্যে বিশেষজ্ঞদের জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

2 Comments

  1. খুব ভাল একটি লেখা

    ReplyDelete
  2. কড়কড়া একটা রচনা ভাইয়া।
    জাস্ট কিপ ইট আপ ব্রো😍

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post