↬ শীতকাল
রাত্রি শেষ।
কুয়াশায় ক্লান্তমুখ শীতের সকাল-
পাতার ঝরোকা খুলে ডানা ঝাড়ে ক্লান্ত হরিয়াল।
শিশির স্নাত ঘাসে মুখ রেখে শেষের কান্নায়
দু‘চোখ ঝরছে কার, পরিচিত পাখিদের পায়।
---- আহসান হাবীব
ষড়ঋতুর রঙে রঙিন আমাদের এই দেশ। বর্ণিল প্রকৃতির ঋতুবঙ্গশালায় তার ছন্দোময়, আনন্দময় অনুপম বিস্তার। ঋতু পরিবর্তনের বর্ণবিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তহীন রূপ, রং আর সুরের খেলা। ষড়ঋতুর এই খেলায় হেমন্তের পৌঢ়ত্বের পর আসে জরাগ্রস্ত শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্কতা, রিক্ততা আর দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। শীতের আগমনের সাথে সাথে বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার। মালতীলতা পত্রশূন্য, ঝুমকোলতার রং ফুরায়, পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে ফাণ্ডুরতা। তবু শীতের সকালের একটা মাধুর্য আছে। কুয়াশাঘেরা, শিশিরভেজা পত্রশূন্য প্রকৃতির আছে স্নিগ্ধতা। সে কেবল বৈরাগী, উদাসীন নয়। তার মধ্যেও রয়েছে আনন্দ, চাঞ্চল্যের বিভিন্ন উপাদান। শীতের সকালে হাড়কাঁপানো শীত অনুভূত হয় একথা সত্যি। কিন্তু এ হাড়কাঁপানো শীতই মানুষের মধ্যে সঞ্চার করে প্রাণচাঞ্চল্য। শীতের সকালে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনে উৎসবের ধুম পড়ে যায়। পিঠা-পায়েসের উৎসবে মেতে ওঠে গ্রামবাংলা। শীতের সময় গ্রামে গ্রামে নানা মেলা, পার্বণ হয়। মানুষের মনে আসে আনন্দের জোয়ার। ঔদাসীন্য, বৈরাগ্যের মাঝে যে আনন্দের সুর, এটাই শীতের সকালের কাছে আমাদের বড় প্রাপ্তি।
শীতের বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশে ষড়ঋতুর পঞ্চম ঋতু হলো শীত। শীত গ্রীষ্মের ঠিক বিপরীত। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস নিয়ে শীতকাল। ইংরেজি মাসের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতকাল হলেও মূলত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীত অনুভূত হয়। শীতকালে আমাদের দেশে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। শীতকালের তাপমাত্রা স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে নিচে নেমে যায়। এ সময় তীব্র শীত পড়ে। শীতকালে দিন ছোট আর রত হয় দীর্ঘ। বাংলাদেশের বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের মাত্র ৪ শতাংশ শীতকালে হয়।
শীতের সকালের রূপ : অন্যান্য সকাল থেকে শীতের সকাল একটু পৃথক, একটু বৈচিত্র্যময়। শীতের সকাল আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রকৃতির পালাবদলের হাওয়ায় শীতের যে রূপ বা রিক্ততার রূপ। তবে এ রিক্ততা প্রকৃতিকে এক ভিন্ন সাজে সজ্জিত করে। শীতের সময় গাছের পাতা ঝরে যায়। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। যত দূর চোখ যায় কেবল কুয়াশাঘেরা অন্ধকার প্রকৃতি। এ সময় লেপ-কাঁথা ছেড়ে বিছানা থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে করে না। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও অজানা এক অলসতা মানুষকে বিছানায় আটকে রাখে। ধীরে ধীরে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্য আলো ছড়াতে থাকে। হিমশীতল হাওয়া বইতে থাকে ধীরে ধীরে। গাছপালা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিশির। শিশিরভেজা দূর্বাঘাস কিংবা টিনের চালে সূর্যের আলো পড়লে মনে হয় যেন মুক্তো ঝলমল করছে। সূর্যের উত্তাপ না ছড়ানো পর্যন্ত কেউ ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতে চায় না। কিন্তু কাজকর্মের তাগিদে অবশেষে লেপ ছেড়ে উঠতে হয়। এই যে কর্মব্যস্ততা আর আলস্যের পাশাপাশি অবস্থান- এটা শীত ছাড়া অন্য কোনো সময় সাধারণত চোখে পড়ে না। সবার গায়ে শীতের পোশাক জড়ানো থাকে। মানুষ সূর্যের উত্তাপের আশায় ঘর ছেড়ে বাইরে আসে। বিভিন্ন স্থানে মানুষ আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। গ্রামে এ দৃশ্য প্রায়শ দেখা গেলেও শহরে খুব একটা দেখা যায় না। সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লে কুয়াশা কেটে যায়। ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে আর শুরু হয়ে যায় কর্মব্যস্ততা।
শীতের সকালের প্রকৃতি : শীতের সকাল আসে ধীর লয়ে। যেমন তার কোনো ব্যস্ততা নেই। উত্তর দিক থেকে হিমশীতল বাতাস বইতে থাকে। যেন এ দীর্ঘশ্বাসের মতো গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে শিরশির করে এ বাতাস বয়ে যায়। এই বাতাসে পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে ওঠে। পাতা থেকে ঝরে পড়ে শিশির সূর্য উঠলে ধীরে ধীরে শিশির বিদায় নেয়। আবার অনেক সময় এত কুয়াশা পড়ে যে সারাদিন সূর্যের মুখও দেখা যায় না। কুয়াশার কারণে পাখিরাও নীড় ছেড়ে বের হয় না, কোলাহলে মেতে ওঠে না। চারদিক থেকে ভেসে আসে সরষে ফুলের মধুর সৌরভ। শীতকালে বাংলাদেশে প্রচুর শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। মাঠে মাঠে সেই সবুজ শাক-সবজি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে প্রকৃতিকে আরও কোমল করে তোলে। ঘাসের ডগায়, পাতার কিনারায় রাতের শিশিরকণা সূর্যালোকে ঝলমল করে হাসতে থাকে। শীতকালে নদীনালা, খালবিল, পুকুর, ডোবা সব শুকিয়ে যায়। গাছপালা পত্রশূন্য বলে পকৃতির সর্বত্রই বৈরাগ্যের ভাব ফুটে ওঠে। কৃষকেরা সকাল হতেই গরু আর লাঙল নিয়ে বের হয়ে যায়। তারা খেতে মুগ, মসুর, ছোলা, অড়হর, সরিষার বীজ বোনে। কয়দিন পর যখন সেগুলোর কচি পাতা মাথা উঁচু করে তখন চারদিকে বিরাজ করে এক অপূর্ব স্নিগ্ধতা, কোমলতা। খেজুর গাছে ঝুলতে থাকে রসের হাঁড়ি। খেজুর রসের লোভনীয় মিষ্টি গন্ধে মন মেতে ওঠে।
গ্রামে শীতের সকাল : শীতের আসল সৌন্দর্য গ্রামেই। গ্রামীণ প্রকৃতিতেই শীতের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে গ্রামের ভোর। এই ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতের মধ্যেই কৃষককে বের হতে হয় মাঠের উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ এ সময় ইরি ধান আবাদ করে, আবার কেউ কেউ চাষ করে রবি শস্য। তাই শীতকে উপেক্ষা করেই, হয়তো গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয় গ্রামের কৃষকেরা। গ্রামের মানুষরা আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। গাছিরা খেজুর গাছ থেকে খেজুর রসের হাঁড়ি নামায়। বাড়িতে কৃষকের বউ সেগুলো জ্বাল দেয়। খেজুর রসের মৌ মৌ গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছোটছেলে মেয়েরা মিষ্টি রোদে বসে গুড় দিয়ে মুড়ি খায়। গ্রামের বধুরা শীতকালে নানারকম পিঠা-পুলি তৈরি করে। আর চলে তাদের গল্প গুজব।
ছোট শিশুরা ঘুম থেকে উঠে সরাসরি চলে আসে চুলার পাশে। একদিকে মা পিঠা ভাজে আর অন্যদিকে তারা আগুন পোহায় আর পিঠা খায়। কুয়াশা কেটে রোদ উঠলে গ্রামের মানুষ রোদে এসে বসে। শীতের সকালে সূর্য আসে সুখকর উষ্ণতা নিয়ে। কৃষক মাঠ থেকে ফসল আনে আর কৃষকবধূ ব্যস্ত হয়ে যায় সেই ফসল ঘরে তোলার কাজে। তারা তখন আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। গ্রামের ঘরে ঘরে একই আনন্দ। সুখের পাশাপাশি দুঃখও আসে গ্রামের মানুষের। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব। অনেকের শীতের কাপড় থাকে না। তীব্র শীতে তাদের প্রচণ্ড কষ্ট হয়। শীতের সকাল তাদের জন্য কোনো আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে না।
শীতের সকালে কৃষাণ-কৃষাণী : শীতের সাকালে কৃষকের ব্যস্ত থাকতে হয় ফসল বোনা আর ফসল কাটা নিয়ে শীতের শুরুতে তারা খেতে রবিশস্যের বীজ বপন করে। শীতের শেষে সেগুলো ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। কৃষকবধূও এ সময় ব্যস্ত সময় কাটায়। কারণ বাড়ির পাশের খেতের তদারকি করতে হয় তাকেই। আবার ফসল ঘরে তোলার অধিকাংশ কাজই সে করে। শীতের সকালে কৃষকবধু খেজুরের রস জ্বাল দেয়। সেই রস চালের গুঁড়া দিয়ে সে তৈরি করে নানারকম পিঠা, পায়েশ। পরিবারের সবাইকে পিঠাপুলি খাইয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্য কাজে। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। বিশেষত ছোট ছেলেমেয়েদের। এ স্মৃতিকে স্মরণ করে কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন-
“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে
খুশিতে বিষম খেয়ে
আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে
মায়ের বকনি খেয়ে।”
গ্রামের কৃষক পরিবারে শীত আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। কারণ এ সময় নানা ধরনের শাক-সবজি আর ফসলে তাদের ঘর ভরে ওঠে।
শহরে শীতের সকাল : শহর আর গ্রামের শীতের সকালের চিত্র ভিন্ন। শহরে তুলনামূলকভাবে শীতের প্রকোপ গ্রামের চেয়ে কম। শহরের মানুষ একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তাই তাদের কাছে সকালটা যেন হট করেই চলে যায়। উঁচু উঁচু দালান কোঠায় বসবাসকারী শহরের মানুষ শীতের সকালটাকে উপভোগ করতে পারে না। তাই শীতের সকাল তাদের কাছে কোনো ভিন্ন আবেদন নিয়ে আসে না। যারা চাকরি করে তারা অফিসে যাওয়ার একটু আগে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর একটু চা বা কফি খেয়ে খবরের কাগজ চোখ বুলায়। এরপর নাশতা করে ছোটে অফিসের উদ্দেশ্যে। এরপর ডুবে যায় কর্মব্যস্ততায়। শহরের শীতের সকালে নেই কুয়াশাভেজা মেঠো পথ। নেই পিঠে পুলির উৎসব। তবে সকালে অনেক কুয়াশা পড়ে। এ কুয়াশা উপেক্ষা করেই দিনমজুরেরা কাজের সন্ধানে বের হয়। খুব সকালে রাস্তায় তেমন একটা গাড়ি চলে না। রাস্তার পাশে ভাপা পিঠা বিক্রি হয়। বাড়ির ছাদে কিংবা ফুল বাগানে ফুটে থাকে নানা রকম ফুল। কিন্তু সে ফুল গ্রামের বুনো ফুলের মতো সৌরভ ছড়ায় না। একদল লোক প্রাতঃভ্রমণে বের হয়। ছিন্নমূল মানুষেরা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যান্ত্রিক সভ্যতায় শহরের মানুষ অভ্যস্ত। ইট, বালুর দেয়ালে বসে প্রকৃতিক সুষমা উপভোগ করার মতো সময় তাদের নেই।
শীতের সাকালে দরিদ্র মানুষের অবস্থা : শীত যেমন আনন্দ নিয়ে আসে, তেমনি নিয়ে আসে কষ্টও। বিশেষত দরিদ্র লোকের জন্য শীত যেন অভিশাপ। শহর আর গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। গ্রামের মানুষের তবু মাথা গোঁজার ঠাঁইকুটু আছে। কিন্তু শহরের ছিন্নমূল মানুষদের সেটুকুও নেই। তারা ফুটপাতে, বাস অথবা রেল স্টেশনে যেখানে একটু জায়গা পায় সেখানেই ঘুমায়। গরিব মানুষের শীতের কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। তাই শীতের সকালে তাদের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। পাতলা কাপড় গায়ে দিয়ে গুড়িসুটি হয়ে তারা শুয়ে থাকে। শীতের সকালের মিষ্টি রোদের সৌন্দর্য আর পিঠা-পুলির স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত। শীতের সকাল তাদের কাছে সৌন্দর্যের উৎস নয়। তারা শীত বিদায়ের অপেক্ষায় থাকে। শীতের অভিশাপ থেকে তারা মুক্তি পেতে চায়। একটু উষ্ণতার জন্য তারা অপেক্ষা করে। এই শ্রেণির মানুষের দুঃখ অনুভব করে কবি শামসুল রহমান বলেছেন-
“শীত সকালে লোকটা কাঁপে
কাঁদে সবার পা ধরে।
একটা শুধু ছিল জামা
তা-ও ছিঁড়েছে ভাদরে।
হি-হি শীতে থাকে পড়ে
ডাকে না কেউ আদরে।”
শীতের সকালে খাবার-দাবার : শীতের সকালে নানা ধরনের খাবার তৈরি হয় বিশেষত গ্রামে। গ্রামের ঘরে ঘরে পিঠা পায়েস তৈরি করা হয়। গ্রামের মেয়েরা ভোরে উঠে ঢেঁকিতে চাল গুড়া করে। তারপর কুয়াশাঘেরা সকালবেলায় শুরু হয়ে যায় তাদের ব্যস্ততা। ঘরের বাইরে খোলা উনুনে তারা পিঠা ভাজে। তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা, রসের পিঠা, পাটি সাপটাসহ নানা ধরনের পিঠার মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে যায়। শীতের সাকলে পরিবারের সবাই মিষ্টি রোদে বসে আনন্দে পিঠা খায়। এভাবে শীতের সকালটি তাদের কাছে হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। কেবল গ্রামেই নয়, শহরের বিভিন্ন রাস্তার পাশেও বিক্রি হয় ধোঁয়া ওঠা গরম ভাপা পিঠা। শীতে গ্রামে নানা ধরনের শাক-সবজির চাষ হয়। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, গাজর, বরবটি, পালংশাক প্রভৃতি শীতের ফসল।
উপসংহার : কুয়াশাঘেরা রূপের মাধুরী নিয়ে আগমন ঘটে শীত সকালের। কনকনে ঠাণ্ডায় কেউ বাইরে বের হতে চায় না। এক অজানা আলস্য মানুষকে যেন বিছানায় আটকে রাখে। গ্রামের মানুষ শীতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারলেও শহরের মানুষ তা একেবারেই পারে না। কারণ নগরজীবনে সকাল হয় অনেক দেরিতে। আবার নাগরিক পরিবেশে শীত তার সৌন্দর্য ছড়াতে পারে না। শীতের সকালের সৌন্দর্য ও মাধুর্যের সন্ধান পেতে হলে যেতে হবে গ্রামে। সেখানে প্রকৃতি তার রূপটি উজাড় করে দিয়েছে। শীতের সকালে যেমন আনন্দ আছে, শীতের সকালকে ঘিরে যেমন উৎসবের ছোঁড়া আছে, তেমনি আবার শীতের সকালে কষ্টও আছে। কিন্তু ছিন্নমূল, দরিদ্র মানুষের কাছে শীতের সকাল উৎসবের আনন্দের নয়। তাদের কাছে তা কষ্টের, যন্ত্রণার। তাদের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই শীতের এক একটি সকাল সকলের মনে সৃষ্টি করবে সৌন্দর্যানুভূতি, মনে সঞ্চার করবে আনন্দ।
[ একই প্রবন্ধ অন্য বই থেকে সংগ্রহ করে আবার দেয়া হলো ]
কোনো লেখা- সে গল্প-উপন্যাস বা প্রবন্ধ কিংবা কোনো কাজ- সবকিছুরই একটা শুরু থাকে, সূচনা থাকে। তেমনি একটি দিনের শুরু হয় সকাল দিয়ে। একটি সকাল একটি দিনের সূচনা। দিনের এই লগ্নটি ঋতুভেদে বিচিত্র রূপ নিয়ে আসে মানুষের জীবনে। শীতের সকাল আসে কুয়াশার আবরণে আবৃত হয়ে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়েই সে নগর আর গ্রামীণ জীবনে ধরা দেয়।
প্রকৃতির পালাবদলের হাওয়ায় শীত আসে রিক্ততার আর শূন্যতার ডালি নিয়ে। সফলহীন মাঠ, পাতাঝরা শূন্য গাছ- প্রকৃতি যেন বৈরাগ্যের বসন পরেছে। আর শীতের সকাল পাতলা কুয়াশার চাদর পরে আরোও বিষন্ন করে তোলে পরিবেশ। সময় থমকে দাঁড়ায়। কতটা বেলা হলো বোঝার উপায় নেই। কেননা সূর্যের দেখা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় ধোঁয়াটে আবছা অন্ধকার। মনে হয় রাত বুঝি-বা শেষ হয় নি এখনো। সচ্ছল আরামপ্রিয় মানুষ লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে নরম বিছানার উষ্ণতায়। কুয়াশা কেটে দিয়ে সূর্য উঠবে, শুরু হবে জীবনের প্রাত্যহিকতা।
গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা মাঠে কাজ করে, এই শীতের সকালেই তাদের বেরিয়ে পড়তে হয় জীবনের তাগিদে। কানে-মাথায় গামছা বেঁধে পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে নগ্ন পায়ে তাদের মাঠে যেতে হয়। হেমন্তে যে ধান পেকেছে তা ঘরে তুলবার সময় এখন। সোনালি ধান, সোনালি ফসল- সোনালি আশা। সারা বছরের কষ্টের প্রাপ্তি। তাই শীতের কষ্টকে তুচ্ছ করে কুয়াশা কেটে কেটে মাঝের দিকে যায় সে। কেউ কেউ আবার সূর্য ওঠার প্রতীক্ষায় থাকে। কখন রোদের উষ্ণতা গায়ে মেখে ফসল কেটে আনবে সেই প্রতীক্ষা করে। কেননা মাঠে তেমন কোনো কাজ নেই, নেই হালচাষের কিংবা বীজ বোনার ঝক্কি। এ সময় গ্রামের অনেকে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে বসে উত্তাপ নেয়। গ্রামের বৌ-ঝিরা এ সময় নানারকম পিঠেপুলি তৈরি করে, পাশাপাশি চলে হালকা গল্প-গুজব। আর শীতের সকালে গাছ থেকে সদ্য নামানো ঠাণ্ডা খেজুরের রসের আবেদন তো একেবারেই আলাদা। ছোট শিশুরা ঘুম ঘুম চোখে উঠে আসে। তাদের শরীর প্যাঁচানো থাকে বড় চাদরে। গুটি গুটি পায়ে তারাও এসে বসে চুলোর পাড়ে। একসময় কুয়াশা কেটে যায় গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় সূর্য। আগুনের উত্তাপ ছেড়ে এবার সূর্যের উত্তাপ নেওয়ার পালা। যেখানেই রোদ দেখা যায় শিশুর দল সেখানেই দৌড়ে যায়। কাঁচা সোনা রোদে বসে ঘরে ঘরে চলে পিঠে খাবার ধুম। কেউ কেউ মরিচ আর পেঁয়াজ ডলে পান্তা ভাত খায়। শীতের সকালে সূর্য সুখকর উষ্ণতা নিয়ে আসে। শিশিরভেজা মেঠো পথ ধরে কাজে যায়। কখনও কখনও কৃষাণী ক্ষেতে যায়। কৃষাণ তার ধান কাটায় ব্যস্ত। কৃষাণীর হাতে থাকে কখনো পান্তা, কখনও মুড়ি আর গুড়। বাঁধাকপি কিংবা ফুলকপির আল ধরে, হলুদ সরষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে, মটরশুঁটির ভেজা কচি ডগা বাঁচিয়ে রোদের আরাম চেখে চেখে এগিয়ে যায় সে। শীতকালীন ছুটির কারণে ছেলেমেয়েদের থাকে অফুরন্ত অবসর। কেবল খেলা আর আনন্দ। প্রায়ই তারা বনভোজনে মাতে। সকাল থেকেই চলে তার আয়োজন। ততক্ষণে হয়তো পুরোপুরি কেটে যায় কুয়াশা। চারদিকে ঝলমলে আলো। গাছের পাতায় শিশিরের শেষ বিন্দুটুকু শুকিয়ে যাবার আগে হঠাৎ মুক্তোর মতো ঝলসে ওঠে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় খেজুরের রসে তৈরি পায়েস বোঝাই গরুর গাড়ি গাঁয়ের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যায়। কৃষকের মনে দারুণ আনন্দ ঘরে তার ভরে উঠবে সোনালি ধানে। কয়েক মাসের জন্যে একবারে নিশ্চিন্ত থাকা। শীত কাটানোর সে চড়া গলায় গান ধরে-
“ওকি গাড়িয়াল ভাই-
কত রব আমি পন্থের পানে চাইয়া রে....।”
শহুরে জীবনে শীতের সকাল হুট করেই চলে যায়। উঁচু তলায় যাদের বসবাস তাদের কাছে শীত-সকালের কোনো আবেদন নেই বললেই চলে। ইটের পর ইট গেঁথে তৈরি কৃত্রিমতায় শীতের সকালরক উপভোগ করা যায় না। অফিসমুখী লোকজন বেরুবার আগে আগে বিছানা ছাড়ে। একটুখানি কুয়াশা দেখা আর গরম চা কিংবা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ বুলানো। তারপরই সারাদিনের জন্যে কর্মব্যস্ততায় ডুবে যাওয়া। কিন্তু শহরেও শীত নামে, কুয়াশাঘেরা শীতের সকাল আসে। থাকে না কেবল শিশিরভেজা মেঠো পথ, কাঁচা রস, পিঠেপুলি আর ভাটিয়ালি সুর।
শহরে শীতের সকালে কুয়াশায় অনেক সময় বাড়িঘর পথঘাট আচ্ছন্ন হয়ে যায়। দূরের সুউচ্চ দালানগুলো স্পষ্ট দেখা যায় না। দিন মজুরের এই সকালেই কাজের আশায় বেরিয়ে পড়ে। কদাচিৎ কাঁদে হাঁড়ি নিয়ে খেজুরের রস ফেরি করে ফেরিওয়ালা। রাস্তার পাশে স্টোভ জ্বালিয়ে তৈরি হয় ভাপা পিঠা। এক টাকা দু’টাকা দামে সেসব কিনে নেয় নিম্ন আয়ের মানুষেরা। পিঠে বানানোর সময় বাজে না কেবল রেশমি চুড়ির রিনিক ঝিনিক। কারণ, শহরের রাস্তার পাশে যারা এসব পিঠে তৈরি করে তাদের অধিকাংশই পুরুষ। খুব সকালে রাস্তায় যানবাহন কম চলে। প্রয়োজনে ঘন কুয়াশায় হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলে।
নার্সারি, বাড়ির লন, কিংবা ছাদের টবে গাঁদা, ডালিয়া, কসমস ফুলসহ নানান জাতের ফুল ফোটে। পরে কুয়াশা কেটে যখন রোদ ওঠে তখন এসব ফুলের ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দু হিরের দ্যুতি ছড়ায়। স্বাস্থ্য- সচেতন লোকেরা প্রাতঃকালীন ভ্রমণে বের হয়। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা শীতের অতিথি পাখিরা ঢাকা চিড়িয়াখানার লেক-এ ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায়। ফুটপাত, বাসটার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশনে ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষের দল তখনও ঘুমিয়ে। একসময় কুয়াশা কেটে রোদ ওঠে। কোলাহল বাড়ে। রিকশার টুংটাং, টেম্পু, বাস, ট্রাকের হর্ন সকালের স্তব্ধতা ছিন্ন করে দেয়। ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট তখন কিছুটা হলেও লাঘব হয় রোদের উত্তাপ পেয়ে। সকাল থেকেই বাজার বসে। এছাড়া ঠেলাওয়ালা ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শিম ইত্যাদি বিভিন্ন শীতের সবজি নিয়ে শহরের অলিতে গলিতে ঠেলাওয়ালা হাঁকে। শীতের যে কোনো ছুটির সকালে শহুরে সামর্থ্যবান নাগরিক সারাদিনের জন্যে বেড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়াশাময় যান্ত্রিক নগরকে পেছনে ফেলে তাঁরা খানিকটা নির্মল বাতাসের আস্বাদ ও আনন্দ পেতে চায়।
শীতের সকাল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মানব মনের ওপর প্রভাব ফেলে। গ্রাম আর শহরভেদে ভিন্ন আমেজে তা মানুষের মনের অঙিনায় ধরা দেয়। তবে এ কথা ঠিক দু’পরিবেশেই শীতের সকাল আসে কোলাহলহীনতা নিয়ে। গ্রামের প্রকৃতিতে শীত আর আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকে।
শহরে শীত খানিকটা অবগুণ্ঠিত। তারপরও শীত-সকালের আবেদন কারো কাছেই নিতান্ত তুচ্ছ নয়। শীতের সকালে কাজের চাপ থেকে দূরে থেকে মানুষ একান্তে আনন্দ উপভোগ করে। এমন অবসন্ন কুয়াশা কিংবা মায়াময় নরম রোদের আমেজ আর কি কখনও পাই আমরা। পিঠেপুলি আর ঠাণ্ডা রস খাবার এমন মোক্ষম সময় কেবল শীতের সকালই আমাদের দিতে পারে। কুয়াশার পর্দা পরে আমাদের সামনে হাজির হয় কেবল শীতের সকাল। শস্যহীন মাঠ আর পাতাঝরা গাছের মলিনতা থাকলেও ঘর ভরা সোনার ফসলের পূর্ণতা মানুষের মনে অনাবিল আনন্দের পরশ বুলিয়ে দেয়। তবে শীতের সকালে স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। অল্প সময়ের জন্যে এসে মানুষের মনে তার পরশ বুলিয়ে যায়, রেখে যায় কোমল কঠিন স্পর্শ। তাই শীত-সকাল বাঙালির জীবনে স্মৃতিময় হয়ে থাকে।
- প্রবন্ধ রচনা : একটি শীতের সকাল - (Visit : eNS)
- অনুচ্ছেদ : শীতের সকাল
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের ষড়ঋতু
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের বসন্তকাল
- প্রবন্ধ রচনা : শরতে-হেমন্তে বাংলাদেশ
- প্রবন্ধ রচনা : বর্ষাকাল
- প্রবন্ধ রচনা : শরৎকাল
- প্রবন্ধ রচনা : গ্রীষ্মের দুপুর
- Essay : The Rainy Season
- Composition : Winter in Bangladesh
- Composition : Seasons of Bangladesh
- Composition : The Season You Like Most
খুব সুন্দর
ReplyDeletewowwww soo nice many sweet think
ReplyDeleteThank you 😁
ReplyDeleteOnek sundor
Deleteখুব সুন্দর
ReplyDeleteValor laglo
ReplyDeleteখুব ভালো
ReplyDeleteঅসাধারণ
ReplyDeleteকবিগুরুর উক্তি আরো বেশি করে ব্যবহার করা উচিৎ ছিল বলে মনে করি
ReplyDeleteদারুণ হয়েছে। আপনি একজন অসাধারণ ব্লগার।
ReplyDeleteআপনার ব্লগগুলো পড়তে ভাল লাগে। আপনি চাইলে আমার সাইটটি দেখে আসতে পারেন https://www.skiddoah.com
এই গুলো আমাদের অনেকউপকারক,,, ধন্য বাদ Google
ReplyDeleteখুব সুন্দর।আমার অনেক উপকারে এসেছে রচনাটি।আপনাকে অনেএএএএএক ধন্যবাদ রচনাটি দেয়ার জন্য।
ReplyDeleteWHYYY SOOO BIG😭😭😭😭
ReplyDeleteBig is good
Deletenice very nice
ReplyDeleteখুব সুন্দর রচনা
ReplyDeleteখুব সুন্ধর একটা রচনা
ReplyDeletenice post
ReplyDeletenice
ReplyDeleteVery Nice
ReplyDeleteKhub sundor
ReplyDeleteNice
ReplyDelete