↬ তোমার প্রিয় ঋতু
↬ বাংলার শ্রেষ্ঠ ঋতু
↬ বাংলার বর্ষা
↬ আমাদের জীবনে বর্ষা
↬ বর্ষায় বাংলাদেশ
ভূমিকা :
‘কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত, দাদুরী ডাকিছে সঘনে।
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে।’
গ্রীষ্মের অগ্নিক্ষরা দহনে নিসর্গ প্রকৃতি যখন দগ্ধ, নিরুদ্ধ-নিশ্বাস, তার তৃষ্ণাদীর্ণ বুকে যখন সুতীব্র, অস্থির হাহাকার, তখনই একদিন মেঘমেদুর অম্বরে আবির্ভাব ঘটে ভৈরব হরষে ‘ঘন গৌরবে নবযৌবনা’ বর্ষার। অরণ্যে অরণ্যে নতুন প্রাণের শিহরন-স্পর্শ। দিকে দিকে ওড়ে তার বিজয়-বৈজয়ন্তী, আকাশে দেখা যায় ধূসর পিঙ্গল কৃষ্ণ মেঘের সমারোহ। সেখানে মুহুর্মহু বিদ্যুৎস্ফুরণের আলোক-সজ্জা। শোনা যায়, ‘ঘন দেয়া গরজন’। তারপর বাদলের ‘ধারা ঝরে ঝর ঝর’। নিদাঘতপ্ত বঙ্গ-প্রকৃতির ধূলিধূসর অঙ্গ থেকে রুক্ষতার মালিন্য যায় মুছে। নবজলধারায় অবগাহন করে নিসর্গ প্রকৃতি পায় নবনী-কোমল স্নিগ্ধ শ্যামশ্রী। চোখে তার মুগ্ধতার মায়াঞ্জন। অঙ্গে-কদম্ব-কেতকীর সুবাস। ‘শত শতাব্দীর পূর্বেকার কালিদাসের মেঘ’ আজও মর্ত্যের বিরহী মানুষের কাছে নিয়ে আসে নতুনের বার্তা। আষাঢ়ের ওই মৃদঙ্গধ্বনি আজও মানুষকে নিয়ে যায় কোন অলকাপুরীতে, কোন চিরযৌবনের রাজ্যে, চির-বিচ্ছেদের, বেদনায়, চির-মিলনের আশ্বাসে, চির-সৌন্দর্যের কৈলাসপুরীর পথচিহ্নহীন তীর্থাভিমুখে।
বর্ষাকালের সীমারেখা :
‘আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে, মমতায় বর্মপুট ভরি।’
-সুফিয়া কামাল
ব্যাপ্তিতে, বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের বর্ষাকালের তুলনা নেই। ঠিক কোন্ দিনটিতে যে বর্ষার আবির্ভাব, আর কোন্ দিনটিতে যে তার সমাপ্তি, হিসেবের খড়ি দিয়ে তার সীমারেখা টানা দুষ্কর। মহাকবি কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ মেঘের আবির্ভাব দেখেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি বর্ষার পরিধি-বিস্তার। তবে আষাঢ়-শ্রাবণেই বর্ষার পরিপূর্ণ রূপ-বৈভব। গর্জনে, বর্ষণে, চিত্রবিন্যাসে, প্রয়োজনের আশ্বাসে, অপ্রয়োজনের নিরুদ্দেশ অভিসারে এ দু মাসেই তার পূর্ণতা।
বর্ষায় গ্রাম-বাংলার চিত্র :
‘এদিক দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল,
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।’
-যতদূর দৃষ্টি যায় আকাশে পাংশুটে মেঘের জাল বোনা, প্রকৃতি নিথর নিস্তব্ধ। বর্ষায় গ্রাম-বাংলার অপরূপ শ্যামশ্রী সত্যই অনির্বচনীয়। তার দূলি-মলিন বিবর্ণতার অবসান হয়েছে। শুষ্কতার দীনতা গেছে মুছে। দগ্ধ তৃণভূমিতে জেগেছে প্রাণের হিল্লোল। সর্বত্রই শ্যামল সবুজের নয়ননন্দন সমারোহ। আকাশে দিগন্তবিস্তার ধূসর কৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ। সজল দিগন্তে ভেসে চলে বলাকার সারি। চাতকের দীর্ঘ তৃষ্ণার হয়েছে নিবৃত্তি। ‘কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত’। আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় জনহীন পথ। ক্ষুব্ধ পবনের মত্ততা। ভবনে ভবনে রুদ্ধ দুয়ার। থেকে থেকে দীপ্ত দামিনীর চমক-উদ্ভাস। ‘কাঁপিছে কানন ঝিল্লীর রবে’। চারদিকে গীতময় তরু-লতিকার মহোল্লাস। তমাল কুঞ্জ তিমিরে মত্ত দাদুরী, ডাকে ডাহুকী। বিচিত্র পুষ্প-বিকাশের লগ্ন হয় সমাগত। কদম, কেয়া, জুঁই, কামিনী, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসব বঙ্গ-প্রকৃতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়। তাই কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
‘গুরু গুরু ডাকে দেয়া, ফুটিছে কদম কেয়া-
ময়ূর পেখম তুলে সুখে তান ধরেছে
বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে।’
চারদিকেই বর্ষার মৃদঙ্গ-মুরল-মুরলীর সুর-মূর্চ্ছনা। কখনো অবিরাম ধারাবর্ষণ, কখনো ক্ষণবর্ষণ। কখনো আলো, কখনো আঁধার। মেঘ-রৌদ্রের সকৌতুক খেলা। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগেরও অধিক বর্ষাকালেই সংঘটিত হয়। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে অধিকাংশ প্লাবনভূমিই বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। এ সময় গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। বর্ষায় নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা, কলমিলতা আর শাপলার সমারোহ দেখা যায়। এ ঋতুতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।
বর্ষা ও বাংলার অর্থনৈতিক জীবন : বর্ণবিলসিত ঋতুচক্রের মধ্যে বর্ষাই বাঙালির সবচেয়ে আদরের ঋতু। সজল মেঘমেদুর অপরূপ বর্ষার সঙ্গে রয়েছে বাঙালির আজন্মকালের হৃদয়-বন্ধন। এ ঋতু বাঙালির জীবনে এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। তার ভাবজীবনকে করেছে বিচিত্র রসসম্পদে সমৃদ্ধ। বর্ষার ক্লান্তিহীন ধারাবর্ষণ, বজ্রবিদ্যুৎ-ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা-তাণ্ডব, ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেও বাংলার কৃষক মাঠে মাঠে সবুজ সতেজ প্রাণের করে আবাহন। রৌদ্র-জলে মাখামাখি হয়ে সে জীব বোনে। রোপণ করে চারাগাছ। শস্যশিশুর কলকল উচ্ছ্বাসে তার চোখে লাগে অনাগত দিনের স্বপ্ন-নেশা। বুক ভরে ওঠে নতুন দিনের আশ্বাসে। বর্ষার অকৃপণ প্রসন্ন দাক্ষিণ্যে বাংলার মাঠ-প্রান্তর হয় শস্যশ্যামলা। বর্ষাকালই বাংলার আনন্দ-ঘন নবান্ন উৎসবের নেপথ্য-মঞ্চ। আবার তারই অপ্রসন্ন, অভিমানী দৃষ্টিতে ঘরে ঘরে অন্তহীন দুঃখের আঁধার, হাহাকার। অতি বর্ষণে তার ভয়াল সংহাররূপে মানুষ আতঙ্কিত, ভীত সন্ত্রস্ত। শ্যাম-গম্ভীর বর্ষা একদিকে যেমন গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে আশীর্বাদ, অন্যদিকে সে-ই আবার দরিদ্র পল্লীবাসীর দুঃখের কারণ। তবু বর্ষা বাংলাদেশের অর্থনীতি-সমৃদ্ধ জীবন-প্রবাহের এক অপরিহার্য কল্যাণী-ঋতু।
বর্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবন : শুধু অর্থনৈতিক জীবনের নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক, ভাবগত জীবনেও বর্ষা ঋতুর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। বর্ষার সরস সজল স্পর্শ, শুধু বাংলার রুক্ষ ধূসর প্রান্তরকেই অসীম প্রাণপ্রবাহে স্পন্দিত করে নি, বাঙালির মনকেও করেছে সরস। করেছে নব নব সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে উদ্বুদ্ধ। তার শ্যামল নীলিমায় দূর-দিগন্তে বাঙালি ছড়িয়ে দিয়েছে তার মুক্ত মনের বিহঙ্গ-ডানা। বর্ষা শুধু তৃষ্ণিত ধরিত্রীর মরুবক্ষকেই সিক্ত করে নি, মর্ত্যমানুষের মনকেও করেছে বিচিত্র ভাবরসে রঞ্জীবিত। বাঙালির গৃহাঙ্গন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা উৎসব-আনন্দে। রচিত হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। উৎসব-আয়োজন এই ঋতুরই উপযুক্ত পটভূমি। রচনা করেছে কত সঙ্গীত, কত কাহিনী। স্নিগ্ধ-সজল পটভূমিতে সে আয়োজন করেছে কল্পনা-বিলাসী। হৃদয়কে দিয়েছে নিত্যনতুন ভাব-সম্পদের সন্ধান। চারিত্রকে করেছে কোমলে-কঠোরে সহনীয়।
বর্ষা ও বাংলা সাহিত্য : বর্ষা বাঙালিকে দিয়েছে প্রয়োজনের জগৎ থেকে অপ্রয়োজনের জগতে অনন্ত অভিসার-বাসনা। তার মনোভূমি হয়েছে নিত্য নবীন ভাবরসে সিক্ত। বর্ষার স্নিগ্ধ-সজল মায়াঞ্জনে যুগে যুগে কবি-হৃদয় উদ্বেল হয়েছে। যাত্রা করেছে চিরসৌন্দর্যের অলকাপুরীতে। বর্ষাকে সে জানিয়েছে স্বাগত অভিবাদন। পাড়ি দিয়েছে সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ পথে। ভাবের প্রাচুর্যে-ঐশ্বর্যে, শ্যামলে-নবীনে ভরে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের অপরূপ অঙ্গ-কান্তি। কবি জয়দেব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিকতম কবি-সাহিত্যিকরা বর্ষা-বন্দনার বিচিত্র মালা গেঁথেছেন। কবি জয়দেব বলেছেন মেঘমেদুর অম্বরের কথা। বৈষ্ণব কবি সজল বর্ষার গম্ভীর পরিবেশে খুঁজে পেয়েছেন দুশ্চর সাধনার সংকেত। তাঁরা শাঙন রজনীর ‘ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত’ বর্ষণ-মুখর অন্ধকারে রাধিকার অভিসারচিত্র অঙ্কন করেছেন। ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর’ -এর শূন্যতার মধ্যে করেছেন অনন্তের সন্ধান। মঙ্গলকাব্যের কবিরা এঁকেছেন বর্ষার দুঃখের ছবি। বর্ষার চিত্রশালে যুগে যুগে সঞ্চিত হয়েছে বাংলা সঙ্গীত কবিতার কত অজস্র বর্ণাঢ্য চিত্র। বর্ষাকে বাঙালি কবি সাহিত্যিক করেছে প্রাণের দোসর। ‘আষাঢ়ের নীলাভ মেঘচ্ছায়াবৃত নদ-নদী নগর-জলপদের’ ওপর দিয়ে কবিমন যাত্রা করেছে চিরসৌন্দর্যের অমরাবতীতে। পরিচিত জগৎ-সংসারের বন্ধন তখন তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। কবি-কল্পনায় ‘পূর্বমেঘ’ ও ‘উত্তরমেঘ’ -এর স্বরূপ হয়েছে উদ্ঘাটিত। বর্ষার মধ্যে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন অনন্ত বিরহ। ‘ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা-একমাত্র’। তাই কবিগুরু লিখেছেন-
‘এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়।’
এমন ঘনঘোর বরিষায়।’
কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থব্যঞ্জনায় বিধৃত। বর্ষা হল অবকাশের, নিষ্প্রয়োজনের ঋতু। কবি-কণ্ঠে উচ্চারিত হল, ‘এই মেঘাবগুণ্ঠিত বর্ষামঞ্জির-মুখর মাসটি সকল কাজের বাহির, ইহার ছায়াবৃত প্রহরগুলোর পসরায় কেবল বাজে কথার পণ্য।’ কবি গুরু বলেছেন-
‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে জানিনে জানিনে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না
ঝরঝর মুখর বালদ দিনে।’
উপসংহার : বাংলার বর্ষা রূপ-বৈচিত্র্যে তুলনাহীন। বর্ষাকাল বাঙালির প্রাণের ঋতু। ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শে তা সজীব। বর্ষা মানুষের মনে সঞ্চার করে অনন্ত বিরহ-বেদনা। মনকে দেয় রিচসৌন্দর্যলোকের আভাস। বর্ষার এক হাতে বরাভয়, অন্য হাতে ধ্বংসের প্রলয়-ডমরু। এক পদপাতে সৃজনের প্রাচুর্য, অন্য পদপাতে ধ্বংসের তাণ্ডব। একচোখে অশ্রু, অন্যচোখে হাসি। বর্ষা তাই, আমাদের কাছে চির আদরের ঋতু, অনন্ত বেদনার ঋতু।
একই রচনা অন্য বই থেকে সংগ্রহ করে আবার দেয়া হলো
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপে যখন খাল-বিল, নদী, ফসলের খেত ফেটে চৌচির আর অসহ্য গরমে অস্থির মানুষ যখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে দু’ফোঁটা জলের জন্যে, তখন ধূলিধূসর রুক্ষতার মালিন্য মুছিয়ে দিতে স্নিগ্ধতার ডালি নিয়ে আসে বর্ষা। বনে বনে লাগে নতুন প্রাণের শিহরণ। বৃষ্টির ধারায় ধরণী সজল, সজীব, সরস ও সুন্দর হয়ে ওঠে।
মহাকবি কালিদাস মেগের আবির্ভাব দেখেছিলেন ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’। ষড়ঋতুর হিসেবে বর্ষাকাল মূলত আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুমাস নিয়েই। কিন্তু বাংলাদেশে বর্ষা কখনোই এই দুমাসে সীমাবদ্ধ থাকে না। ঠিক কোন দিনটিতে যে বর্ষা এল কিংবা কবেই-বা চলে গেল এর সঠিক হিসেব টানা যায় না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত এর পরিধি। তবে আষাঢ় আর শ্রাবণেই বর্ষাকে পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়।
বর্ষায় বাংলা অপরূপ রূপ নেয়। ধূলিমলিন বিবর্ণ প্রকৃতিতে প্রাণের হিল্লোল জাগে। বর্ষাকালে প্রায়ই আকাশ থাকে ধূসর কিংবা কালো মেঘে ঢাকা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায় আর মেঘের গুড়ু গুড়ু গর্জনে আমাদের হৃদয়ও আঁতকে ওঠে। গাছের ডালে পাতায় পাতায় লাগে উতল হাওয়ার মাতম। অবিরাম বর্ষণে নদী-নালা, খাল-বিল জলে টইটম্বুর করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ‘আষাঢ়’ কবিতায় বর্ষার ছবি এঁকেছেন-
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাইরে-
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,
কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ্ চাহিরে-
বর্ষার প্রকৃতি সারাদিন অবিরত কেঁদেই চলে। যে নীলাকাশ উদারতার প্রতীক সেও আজ বিষণ্ণ। কবি তাই বলেছেন,
‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে’
অন্যদিকে মাটিতে তখন আনন্দের শিহরণ। বৃষ্টির পরশ পেয়ে সমস্ত প্রকৃতি সরস, সজীব ও শ্যামল হয়ে ওঠে। আষাঢ় আর শ্রাবণে এক এক সময় দিনের পর দিন বর্ষণ চলতে থাকে। আকাশ ভেঙে নামে অঝোর বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপসা আচ্ছাদনে আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারিদিক। দূর বনানীর গা ঘেঁষে সন্ধ্যার অনেক আগেই জমাট অন্ধকার নেমে আসে। আর বৃষ্টির জলে মাঠ-ঘাট থই থই করে। চারিদিকে কেবল পানি আর পানি। মাঝখানে ছোট ছোট গ্রাম দ্বীপের মতো ভাসে। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো উপায় থাকে না। মাঝির কণ্ঠে শোনা যায় সারিগানের সুর। বর্ষার প্রতীক কদমফুলে ছেয়ে যায় গাছ। কেয়া বনে চলে ফুল ফোটার প্রতিযোগিতা। সব মিলিয়ে এ যেন এক মোহনীয় পরিবেশ। প্রকৃতি কেবল সেজেই চলেছে।
বর্ষার ক্লান্তিহীন বর্ষণ, বজ্রপাত কিংবা উতলা বাতাসের মধ্যেও চাষি মাথাল মাথায় দিয়ে হাল চাষ করে, মাঠে বীজ বোনে, রোপণ করে চারাগাছ। কৃষকের চোখে থাকে অনাগত দিনের শস্যশ্যামল মাঠের স্বপ্ন। বর্ষার পানি না পেলে ফসলের আশা কম। তাই বর্ষা কৃষিপ্রাণ বাংলার বুকে আশা- ফসলের প্রতিশ্রুতি। বর্ষার বারিধারা ও জলস্রোত বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে আসে পলিমাটি আর সেই পলিমাটিই জমিকে করে তোলে উর্বরা, সোনাফলা। কিন্তু দিনের পর দিন অঝোর বৃষ্টির কারণে মাঝে মাঝে খেতের কাজ বন্ধ থাকে। তখন চাষিরা গ্রামের বৈঠকখানায় জড়ো হয়। তখন তাদের কিছুটা অবসর যাপনের কাল। সন্ধ্যার পর জমে ওঠে গান কিংবা গল্পের আসর। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এই চিত্রই এঁকেছেন-
‘গাঁয়ের চাষিরা মলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!’
মোড়লের বৈঠকখানায় গল্পের পাশাপাশি চলে হাতের কাজ। কেউ রশি বানায়, কেউ বা নিখুঁত ফুল বানায় বাঁশের লাঠিতে। গায়েন বানায় সারিন্দা। পাশাপাশি ডাব্বা হুঁকাও ঘুরে বেড়ায় এক হাত থেকে অন্য হাতে। ওদিকে অন্দরমহলে চলে শিকা বানানো কিংবা নকশি কাঁথা তৈরির কাজ। অঝোর বাদলে পাড়ার বৌ-ঝিদের আর এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাবার জো নেই। একদিকে হাত চলে আর মন চলে যায় সুদূর অতীতে। শৈশবে বাপের বাড়িতে কাটানো বর্ষার স্মৃতি হয়তো তার চোখে ধরা দেয় নিবিড় আবেশে।
অনেক সময় অতিবর্ষণের ফলে বর্ষাকালে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো অঞ্চল বন্যায় ভেসে যায়। ফসল, ঘর-বাড়ি, জনপদ অনেক সময় ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়। যাতায়াতের পথ হয়ে ওঠে দুর্গম। প্রাণহানিও ঘটে।
শহুরে জীবনে বর্ষা খানিকটা দুঃসহ। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় শহরের রাস্তায় জল জমে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। বিপর্যস্ত হয় স্বাভাবিক জনজীবন আর নোংরা পানির কারণে পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বস্তিবাসী আর ছিন্নমূল মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। নিঃস্ব আর দরিদ্র পল্লীবাসী এবং শহরের বস্তিবাসীর ভাঙা ঘরে আর ফাঁকা ভিটেতে সংকট বাড়ে। এ সময় নানারকম পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, আমাশয়, কলেরা, জন্ডিস প্রভৃতি সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
বর্ষা কাব্যিক মনে জাগিয়ে তোলে নতুন ভাব। বর্ষায় নিত্যনতুন ভাবরসে সিক্ত হয় মানুষের মন। প্রাচীন কবি জয়দেব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে কবি সাহিত্যিকরা বিচিত্রভাবে বর্ষাকে এঁকেছেন কাব্যে সাহিত্যে। বৈষ্ণব কবি বষণমুখর অন্ধকারে রাধিকার অভিসার চিত্র অঙ্কন করেছেন। বর্ষার দুঃখের ছবি এঁকেছেন মঙ্গলকাব্যের কবিরা। কবি কালিদাস বর্ষায় প্রত্যক্ষ করেছেন অনন্ত বিরহ। বর্ষার নির্জনতা, নিঃসঙ্গতার শান্ত বেদনাভারাতুর ভাব-পরিবেশ কবিকে আচ্ছন্ন করেছে। বারিধারার বিষাদকরুণ সুর তাঁকে আপ্লুত ও অভিভূত করেছে। কবি গেয়েছেন-
‘হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল।
আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,
কোন্ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে।’
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বর্ষা এক প্রয়োজনীয় ঋতু। ভাবুকের চিত্তেও বর্ষার ব্যঞ্জনা অপরিসীম। এ ঋতু অপকারের চেয়ে উপকারই করে বেশি। বর্ষা না এলে মরুভূমি হয়ে যেত এ শস্যশ্যামল দেশ। তাই বর্ষার সাথে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক। বর্ষাকে বিদায় জানাতে কবিগুরু লিখেছেন,
‘কালো মেঘের আর কি আছে দিন
ও যে হলো সাথীহীন।
পুব হাওয়া কয় কালোর এবার যাওয়াই ভালো
শরৎ বলে গেঁথে দেব কালোয় আলো।’
প্রকৃতির নিয়মে আবার ঘুরে ফিরে আসে বর্ষা তার স্নিগ্ধ রূপের ডালি নিয়ে সাজাতে এ বাংলাকে।
ভাষা শিক্ষা
ReplyDeleteড. হায়াৎ মামুদ - এর বই থেকে নেয়া
আমি এটা প্রিন্ট করে পরতে চাই কিন্তু আমি কপি করতে পারতেছি না ।
ReplyDelete