রচনা : একুশ শতকের পৃথিবী

ভূমিকা : বিশ শতকে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অব্যাহত বিজয় অভিযাত্রা শেষে একুশ শতকে পা রেখেছে পৃথিবীর মানুষ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ক্ষেত্রে কী কী বিস্ময় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে তা যেমন স্পষ্টভাবে বলা মুশকিল তেমনি সমাজ জীবনে কী ধরণের পরিবর্তন আসবে তাও অনুমান করা শক্ত। তবু বিশ শতকের অভিজ্ঞতার আলোকে একুশ শতকের পৃথিবীতে আসন্ন পরিবর্তন ও সম্ভাবনা সম্পর্কে একেবারেই যে ধারণা করা যায় না তা নয়।

কম্পিউটার প্রভাতিত নতুন শতাব্দী : নতুন শতাব্দীতে যে কম্পিউটারের ব্যাপক ও যুগান্তকারী উন্নয়ন ও প্রয়োগ ঘটবে তা এই শতকে পা রেখেই বলা যায়। মহাকাশ যোগাযোগ থেকে দোকানের লাভ-ক্ষতির হিসাব- সর্বত্রই কম্পিউটার তার আধিপত্য বিস্তার করবে। কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে মানুষের শ্রম বহুগুণে লাঘব হবে। উপযুক্ত প্রতিবিধানের পরিকল্পনা নেওয়া না হলে এর ফলে পৃথিবীতে বেকারত্ব বাড়তে পারে কিংবা অকর্মণ্য ও অলস মানুষে পৃথিবী ভরে যেতে পারে।

একুশ শতকের গণমাধ্যম : বিশ শতক শেষ না হতেই পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। কম্পিউটারের কল্যাণে পৃথিবীর বৈশ্বিক গ্রাম বা ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবীতে ‘এক জাতি, এক প্রাণ’ গড়ার স্বপ্ন কতদূর সফল হবে তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু তা না হলেও একুশ শতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাঁধে ভর করে গণমাধ্যম চলে যাবে প্রায় সমস্ত মানুষের ঘরে ঘরে। তবে আশঙ্কা হয়, ‘মিডিয়া’ বা গণমাধ্যমের উপর পশ্চিমি দুনিয়ার একচ্ছত্রি আধিপত্য ও খবরদারির ফলে তাদের সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির নীরব আগ্রাসনের শিকার হতে পারে উন্নয়নকামী বিশ্ব। ফলে তৃতীয় বিশ্বে জনগণের মনোজগতে স্থাপিত হতে পারে পশ্চিমি দুনিয়ার নতুন উপনিবেশ। এর ফলে আমরাও হয়তো জাতিগত সত্তার পরিচয় সংকটে আচ্ছন্ন হতে পারি।

জ্বালানির নতুন উৎস : বিশ শতকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে পৃথিবীতে পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে পরিবেশ দূষণ। আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে দেখা দিয়েছে ‘গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া’। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে এবং ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে তেল ও গ্যাসের মজুত ভাণ্ডারও নিঃশেষ হতে চলেছে। অন্যদিকে পরমাণু শক্তির ব্যবহারে মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে একুশ শতকে প্রাধান্য পাবে নতুন ধরনের জ্বালানি শক্তি- সৌর শক্তি ও পরমাণু সংযোজন-ভিত্তিক ফিউশন শক্তি। একুশ শতকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের ব্যবহার অধিকতর গুরুত্ব পাবে বলে আমাদের ধারণা।

একুশ শতকের নতুন সম্ভাবনা- জৈবপ্রযুক্তি : বিশ শতকের শেষার্ধে জৈব প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে জীবনের মূল রহস্য। স্বাভাবিকভাবেই একুশ শতকে জৈব প্রযুক্তির প্রভাব হবে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ভেষজ শিল্প, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষি, রাসায়নিক প্রযুক্তি, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জিন-প্রযুক্তি বা Genetic Engineering বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাবে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে জিন-প্রযুক্তির প্রয়োগ একুশ শতকে অত্যন্ত কার্যকর হবে বলে ধারণা। এর সাহায্যে হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া, ডায়াবেটিস, হৃদবৈকল্য, ক্যানসার ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা তথা Gene Therapy সম্ভব হবে।

কৃষিক্ষেত্রে জিন-প্রযুক্তির প্রয়োগে এমন-সব তরিতরকারি ও ফলমূল জন্মানো সম্ভব হবে যা সহজে পচবে না। এমন ফসল ফলানো সম্ভব হবে যা ভাইরাস আক্রান্ত হবে না। ফসরে উৎপাদন এমনভাবে বাড়ানো সম্ভব হবে যে সারকারখানার দরকার পড়বে না।

পরিবেশ নিয়ন্ত্রণেও জিন-প্রযুক্তি অনেক সাফল্য আনবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তা নদী-নালার দূষণ নিরসনে, ওজোন মণ্ডলের ধ্বংস ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এভাবে জিন-প্রযুক্তিই সম্ভবত একুশ শতকের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পুরোধার ভূমিকা পালন করবে। তবে এক্ষেত্রেও শেষ কথা বলা মুশকিল। জিন-প্রযুক্তির ব্যবহার যে মানব-জীবন ও জীবন পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না তাই-বা কে বলতে পারে।

জনসংখ্যা ও পরিবেশ সমস্যা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত এসব সম্ভাবনা সত্ত্বেও একুশ শতকে মানুষকে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। এর একটি হচ্ছে জনসংখ্যা সমস্যা। বিশ শতকেই পৃথিবীর জনসংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ২০৪০-এর মধ্যে তা দ্বিগুণ হয়ে হাজার কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। বন-বনানী নির্বিচারে আরো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় দূষণসহ নানারকম দূষণের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য আরো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবহমন্ডলে দেখা দিতে পারে বিপর্যয়ের আশঙ্কা। তাই এসব সমস্যা হয়তো ভাবিয়ে তুলবে একুশ শতকের বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়ক ও চিন্তাবিদদের। তাঁরা হয়তো এর সমাধানে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন। কিংবা হয়তো মহাশূন্য গবেষণার নবতর সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে অন্য কোনো গ্রহে গড়ে তুলবেন মানব জাতির নতুন আবাসন।

মারণাস্ত্রের ভাণ্ডার ও একুশ শতক : বিশ শতকে পৃথিবীর বুকে যে বিপুল মরণাস্ত্রের ভাণ্ডার জমেছে তা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয় নি। ফলে মানব সভ্যতা ধ্বংষের আশঙ্কা নিয়েই আমরা একুশ শতকে পদার্পন করেছি। একুশ শতকের নব নব আবিষ্কার যে স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে পড়ে মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না তার কোন নিশ্চতা নেই।

বিশ্বব্যবস্থ ও একুশ শতক : বিশ শতকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের কিছু সমাজতান্ত্রিক দেশে যে বিপর্যয় ঘটে গেছে তা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয় নি। একুশ শতকে হয়তো সেই মীমাংসায় পৌঁছানো যাবে- পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাই কি শেষ পর্যন্ত টিকে থকবে? নাকি সমাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পুনরুত্থান হবে? পাশাপাশি বিশ্ববাসী অবলোকন করবে বিশ শতকের পৃথিবীতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে বিপুল ব্যবধান বেড়েছে তার অবসান হবে কিনা। বিশ্ববাসী আরো দেখবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মূল চাবিকাঠিগুলো কেবলি কি পশ্চিমি দুনিয়ার করায়ত্ত থাকবে এবং তাদের স্বার্থেই ব্যবহৃত হবে না কি? পিছিয়ে পড়া দেশ ও জাতিগুলোকে আনা হবে সম পর্যায়ে? এসব দেখার জন্যেও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

একুশ শতক ও বাংলাদেশ : অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বাংলাদেশ পদার্পন করেছে একুশ শতকে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা কতটা অগ্রসর হতে পারব তা নির্ভর করছে আমাদের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় কর্মপ্রয়াসের ওপর এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মৈত্রী, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ওপর। এক কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এখন আমাদের অগ্রসর হতে হবে।

উপসংহার : একুশ শতকের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা আশা করব, একুশ শতক হবে বিশ্ববাসীর জন্যে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়। মানুষ পৃথিবী থেকে ক্ষুধা দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে পারবে। আশা করব, নিরক্ষরতা, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্য দূর হবে। ভূগোলের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বে গড়ে ওঠবে বৃহত্তর মানব মেলা। পররাজ্য গ্রাস নয়, অস্ত্র প্রতিযোগিতা নয়, শান্তিময়, আনন্দময়, সুস্থ পরিবেশে নিরাপদে বাসযোগ্য নতুন পৃথিবী গড়াই হোক একুশ শতকের মানুষের সাধনার লক্ষ্য।


আরো দেখুন :
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post