↬ একটি পূর্ণিমা রাত
অপূর্ব মন মাতানো জ্যোৎস্নার রূপ দেখার আগে রাতের আকাশেকে অন্ধকার বলেই ভেবেছি আমি। আমার ধারণা ছিল রাতের কর্মহীন পৃথিবী পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। হয়ে যায় নিঝুম। কিন্তু রাতের পৃথিবীতে যে সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যময় সমারোহ ঘটতে পারে তা কখনো আমার অভিজ্ঞতায় ছিল না। অভিজ্ঞতা হলো সেদিন হঠাৎ করে আকাশে চন্দ্রোলোকিত রাতের শোভা দেখেছিলাম মুগ্ধনয়নে। সৌন্দর্যের এমন মাদকতা আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে কখনও অবলোকন করি নি।
পৃথিবীতে এমন লোক হয়ত খুবই কম পাওয়া যাবে যে অন্ধকারে ভয় পায় না। অন্ধকার সবার মনকে দুর্বল করে দেয়; বয়ে আনে ভয়ংকর রহস্যের শিহরণ। যতক্ষণ ঘরে আলো থাকে কিংবা পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকি ততক্ষণ কোনো কিছুকেই ভয় পাই না। কিন্তু ঘর অন্ধকার হলে বা রাতে ঘুম না আসলে অজানা এক ভয় আমাকে গ্রাস করে। সেই আমি জ্যোৎস্নার মোহনীয় রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ঘটনাচক্রে এক রাতে জ্যোৎস্নার রূপ-মাধুরী নিজ চোখে অবলোকন করার সৌভাগ্য আমার হয়। সে এক অপরূপ রাত- রূপময় জ্যোৎস্না রাত।
পরীক্ষা সমানে। তাই লেখাপড়ার চাপ খুবই বেশি। কোন দিকে তাকানোর সময় নেই। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ালেখা করতে হচ্ছে।
চারতলার ঘরে প্রচণ্ড গরমে সিদ্ধ হয়ে বাসার সবাই গেছে ছাদে। আমি একা পড়ছি। পড়তে পড়তে মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। কোনো পড়াই আর মাথায় ঢুকছে বলে মনে হচ্ছিল না।
হঠাৎ তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। মা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলেন। বললেন, গরমে অসুখ বাঁধাবি। চল কিছুক্ষণ ছাদে বসবি। চমৎকার চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণিমার চাঁদ।
মা’র সঙ্গে ছাদে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় অভিভূত। ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। চারপাশের লোড শেডিংয়ের মধ্যে মনে হলো, স্বচ্ছ রূপালি ঝরনার মত চাঁদের আলো যেন চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘ নেই। সারা আকাশ জুড়ে কেবল মিটিমিটি জ্বলছে চাঁদের সাথী তারারা। চাঁদের আলোর বন্যায় রাতকে মনে হচ্ছে যেন এক মায়াবী দিন। চাঁদ যতই উপরে উঠছে ততই বাড়ছে তার উজ্জ্বলতা। বাড়ছে সেই মায়াবী রাতের সৌন্দর্য। এরই মধ্যে আমার ছোট ভাই বোনেরা সবাই মিলে গান ধরলো :
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তেরই মাতাল সমীকরণে....
আমিও তাদের সঙ্গে সুর মেলালাম।
বাড়ির ছাদে জ্যোৎস্নার সৌন্দর্যের যে এমন সমারোহ ঘটতে পারে তা কখনো আমার কল্পনায় ছিল না। এর আগেও রাতে অনেকবার ছাদে উঠেছি অন্যদের সঙ্গে কিন্তু এমন অপূর্ব অনুভূতি কখনো মনে জাগে নি। ভাবলাম, কত যে সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করতে আমরা ব্যর্থ হই পড়ার চাপে আর টেলিভিশনের আকর্ষণে।
বাইরে চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। সব পাখপাখালি তাদের নীডে ঘুমাচ্ছে। কোথাও পাতা নড়ার শব্দও নেই। যেন সম্পূর্ণ প্রকৃতি ঘুমে আচ্ছন্ন, খালি জেগে আছে আকাশের বিশাল উজ্জ্বল চাঁদটা আর তার সাথী তারারা। চারপাশের বাড়িঘর, গাছপালা সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় সবাইকে কেমন যেন মায়াবী দেখাচ্ছিল। আমাদের চারপাশে জ্যোৎস্নার সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে। চারপাশের সবুজ প্রকৃতির কারণে তা রূপ বহুক্ষণ দেখতে পাব। আজ বুঝতে পারলাম, কেন কবি লিখেছিলেন-
“এমন চাঁদের আলো মরি যদি তাও ভালো
সে মরণ স্বর্গ সমান।”
হঠাৎ করে অনেকগুলো কাক ডেকে উঠলো। শুনেছি, জ্যোৎস্না হলে কাকেরা মনে করে ভোর হয়ে আসছে। তাই তারা ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে কোথা থেকে হাসনাহেনা ফুলের মন মাতানো সুরভি এসে মনপ্রাণ ভরে দিচ্ছে। আকাশে উজ্জ্বল আলোময় ঝলমলে চাঁদ, চারপাশে তারই প্রভাবে অপূর্ব সৌন্দর্যময় পৃথিবী এবং মনমাতানো ফুলের সুরভি আমাকে আপ্লুত করে তুলল। মনে হলো, কবি-শিল্পীরা এই জন্যেই এমন জ্যোৎস্না রাতে কবিতা লিখেছেন, গান গেয়েছেন।
এই সব ভাবছি। এমন সময় হঠাৎ চারপাশে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠল। লোড শেডিং শেষ হয়েছে। আমার ঘোর ভেঙে গেল। আরে, কাল যে আমার পরীক্ষা! তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে আবার পড়ার টেবিলে।
সে রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, আমি ডানাওয়ালা পরীদের সঙ্গে জ্যোৎস্না-সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছি।
- প্রবন্ধ রচনা : একটি ঝড়ের রাত
- প্রবন্ধ রচনা : শৈশব স্মৃতি
- প্রবন্ধ রচনা : নদীতীরে সূর্যাস্ত
- প্রবন্ধ রচনা : বর্ষণমুখর একটি সন্ধ্যা
- প্রবন্ধ রচনা : একটি দিনের দিনলিপি
- প্রবন্ধ রচনা : যখন সন্ধ্যা নামে
- প্রবন্ধ রচনা : স্কুল-জীবনের স্মৃতি
- প্রবন্ধ রচনা : বাদল দিনে
- প্রবন্ধ রচনা : সমুদ্র সৈকতে একদিন
- প্রবন্ধ রচনা : নিজের দেশকে জানো
চমৎকার উপস্থাপন
ReplyDelete