↬ তোমার শৈশব স্মৃতি
↬ সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি
↬ ফেলে আসা দিনগুলি
মানুষের সবচেয়ে আনন্দঘন সময় কাটে বুঝিবা শৈশবে। কিন্তু শৈশবকাল যখন অতীত হয়ে যায় তখনই তা উপলব্ধিতে আসে। রচিত হয় গল্প, কবিতা কিংবা গান।
শৈশবের স্মৃতির পাতা যখন চোখের সামনে মেলে ধরে, ছাড়াছবির মতো একের পর এক ভেসে ওঠে কত ঘটনা, কত ছবি। আর কিছু কিছু বেদনার অধিকাংশই আনন্দের। তাই শৈশব স্মৃতি সততেই সুখের। সব কথা হয়তো মনে পড়ে না, আলো-আঁধারির খেলায় ঢাকা পড়ে যায় অনেক ক্ষণ। তবু শৈশবকে যখনই মনে পড়ে, বর্তমানকে তুচ্ছ লাগে।
আমার শৈশব কেটেছে গাঁয়ে। ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম- মধুখালি। এই কমলডাঙ্গায় কত না সুন্দর ভোর হতো, কত না সুন্দর পাখিরা গাইতো। আর এক ঝাঁক দস্যি ছেলেমেয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো। আমি তাদেরই কতজন ছিলাম।
আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল। সব চাচা এক সাথে থাকতেন। আমরা চাচাতো ভাই-বোন সব মিলে ছিলাম এগারো জন- একটা ফুটবল টিম। মাঝে মাঝে ফরিদপুর সদর থেকে আসতেন আমার ফুপু। তখন আরো তিনজন সদস্য বেড়ে যেত। আর আমাদের আনন্দ একলাফে উঠে যেত আকাশে। সারাদিন শুধু হৈচৈ আর খেলা। প্রতি বেলায় রান্না হতো মজার মজার খাবার।
আমাদের বাড়িটা ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মস্ত উঠোনের চারধারে চারটে বড় বড় টিনের ঘর। পাশেই বিশাল বাগান। সান বাঁধানো পুকুরও ছিল একটা। আমার দাদু খুবই স্বচ্ছল ছিলেন। তাই দূর-সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনে সব সময় আমাদের বাড়িটা ভরে থাকতো। বেশির ভাগ সময়ই আমরা ছোটরা দাদুর ঘরে ঘুমাতাম। মেঝেতে ঢালাও বিছানা হত। কে কার পাশে শোব এ নিয়ে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। দাদি তাঁর হাতের তালপাখার ডাঁট দিয়ে আমাদের পিঠে দু-এক ঘা দিতেন আমরা যে যার মতো টুপটাপ শুয়ে পড়তাম। আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রনিক বাতি, পাখা সবই ছিল। তারপরও দাদি সারাদিন হাতে তালপাখা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।
রেলগাড়ি দেখা ছিল আমার খুব প্রিয় সখ। মাঝে মাঝে তাই একা আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম রেলস্টশনে। জংশন স্টেশন। কোন ট্রেন যেত ভাটিয়াপাড়া, কোনটা যেত কামারখালি। ট্রেন চলে গেলে আমি স্লিপারের ওপর দিয়ে হেঁটে ফিরতাম বাড়ির দিকে। রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে টেলিগ্রাফ পোস্টে ছুঁড়ে মারতাম। টং করে আওয়াজ হলেই মন বলতো, আজ খুব আনন্দের কিছু একটা হবে। বেশির ভাগ সময়ই আমার ছুঁড়ে দেয়া পাথর পোস্টে লাগত না, অনেক দূর দিয়ে চলে যেত। শরৎকালে রেললাইনের দুপাশে সাদা কাশফুল ফুটতো। মনের ভেতর তখন অন্য শিহরণ। গাঁয়ে এবার ঢোল বাজবে, মাইক বাজবে। পূজা এলো বলে।
আমরা সবাই একসাথে স্কুলে যেতাম। একবার স্কুল ফাঁকি দিয়ে ম্যাজিক আর বানরের খেলা দেখেছিলাম। শাস্তি হিসেবে দাদু আমাকে পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছিলেন। বড় উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি যখন কান ধরে ওঠাবসা করেছি, ফুটবল টিমের অন্য সদস্যরা তখন দাঁত বের করে হেসেছে। ইচ্ছে হয়েছে,বড় একটা সুঁই দিয়ে ওদের সবার ঠোঁট সেলাই করে দেই।
আমাদের পুকুরের চারধারে অনেক নারকেল আর সুপারি গাছ ছিল। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো ফুলির মা। সে সব সময় ভয় দেখিয়ে বলতো ঐসব গাছে ভূত আছে। একদিন পুকুরে বাসন মাজতে গিয়ে সে ভূত দেখেছি। যেদিন এসব গল্প শুনতাম তারপর থেকে বেশ কয়েকদিন আমার আর ওমুখো হতাম না। এক দুপুরে আমি একলা পুকুর ঘাটে বসে কত গল্পের বই পড়েছি। আমার ছোট মামা ঢাকায় থাকতেন। সেখান থেকে প্রায়ই আমার জন্যে মজার মজার গল্পের বই পাঠাতেন। সেদিন পড়ছিলাম ’কুৎসিত হাঁসের ছানা’ বইটি। আমি ভীষণ মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পানির ভেতর ভীষণ জোরে অদ্ভুত এক শব্দ হল। আমি তো হাতের বই ছুঁড়ে ফেলে পড়িমড়ি করে দৌঁড়। উঠোনে গিয়েই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। পরে জেনেছিলাম, গাছ থেকে পুকুরের পানিতে পড়ছিল এক ছড়া শুকনো নারকেল। তারপরও দু’রাত আমার ভালোমত ঘুম হয় নি।
আমাদের স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক যোগেন্দ্রমোহন বাড়িতে এসে পড়াতেন। সবাই তাকে ভীষণ ভয় পেত। যোগেন্দ্রমোহনকে সংক্ষেপ করে বলতো, ’যম স্যার’। স্যারের কাছে পাঁচ রকমের বেত ছিল। দুষ্টুমির মাত্রা অনুযায়ী এর ব্যবহার হতো। স্যার সন্ধ্যার পর আসতেন। আমরা সবাই লাইন ধরে সুর করে করে পড়তাম।
এক বুড়ো গান গেয়ে ভিক্ষা করতো। আমরা ছোটরা খুচরো পয়সা নিয়ে তার পেছনে পেছনে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে দাদু সেই বুড়োকে কাছারি ঘরের সামনে ডেকে নিয়ে গান শুনতো। ছোট্ট দুধের কৌটায় তবলার বোল তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সে গাইতো, ‘শোন মোমিন মুসলমান, করি আমি নিবেদন’। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে দাদি, মা আর চাচিরা দূরে দাঁড়িয়ে শুনতো। দাদুর চোখে চিকচিক করতো জল।
বাগানের পেছনে গন্ধলেবুর ঝোপে সন্ধ্যার আগেই আঁধার নামতো। সেখানে জোনাকির আড্ডা। আমরা দু’তিন জন ছোট ছোট কাঁচের শিশি নিয়ে জোনাকি ধরার প্রতিযোগিতায় নামতাম। লেবুর কাঁটায় গাঁ ছিড়ে যেত। তবু থামাথামি নেই। যম স্যারের কাছে পড়বার সময় সেই শিশি থাকতো পকেটে। শিশির মুখ পাতলা কাপড় দিয়ে বাঁধা। তখনও রোজাই লোড শেডিং হতো। আর লোড শেডিং হলেই আমরা জোনাকিগুলো ছেড়ে দিতাম। মনে হতো, আকাশ থেকে অসংখ্য তারা নেমে এসেছে মাটিতে।
আমার বয়স যখন ন’বছর তখন একবার ভীষণ জ্বর হল। দিন-রাত শুয়ে থাকতাম, মুখ তেতো হয়ে গিয়েছিল। কিছুই খেতে পারতাম না। সকালের দিকে জ্বরটা একটু কমলে মা আমায় বারান্দায় নিয়ে আসতো। চাদর দিয়ে সারা গা পেঁচিয়ে পিঁড়ি পেতে বসে থাকতাম আমি। প্রায় একমাস ভুগেছিলাম। সবাই হৈচৈ করে স্কুলে যাচ্ছে, দল বেঁধে খেলছে। কেবল আমি অসহায়ের মত বসে থেকেছি। একটু বসলেই মাথা ঝিমঝিম করতো, বমি পেতো, গা কেঁপে চোখ জ্বালা করতো। বুঝতাম, আবার জ্বর আসছে। সারাক্ষণ এক ঘোর লাগা ভাব, কনে ঝিঁ ঝিঁ পাকার ডাক। সেই ছেলেবেলাতেই মনে হতো- আর বুঝি ভালো হবো না।
পৃথিবীর অমোষ পরিবর্তনশীলতায় সবকিছু পাল্টে যায়। সকালের ঝকঝকে রোদ দুপুরে গড়ায়, দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ণের ছায়া দীর্ঘতর হয়, নামে রাত। মানুষের জীবনও তো তেমনি। সেই কবে শৈশব পেরিয়ে এসেছি। যাদের নিয়ে আমার চমৎকার আনন্দমুখর সময়গুলো কেটেছে তাদের কেউ কেউ পৃথিবীতেই নেই।
আমাদের ফুটবল টিমের প্রায় সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছি বিভিন্ন জায়গায়। দাদু, দাদির কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে গান গাইয়ে বুড়োটার কথা, যোগেন্দ্রমোহন স্যারের কথা। তাঁদের কেউই আজ আর নেই। শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, গন্ধলেবুর ঝোপ, রেললাইন আর সেই ছোট্ট স্টেশনটা আজও আমায় টানে। কিন্তু কিছুই আর আগের মতো নেই। তবু মনে হয় আবার যদি ফিরে পেতাম হারানো শৈশব। কিন্তু কর্মচঞ্চল জীবনের টানে টানে সময় গড়িয়ে যায় ব্যস্ততায়। ভবিষ্যৎ গড়ার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে দিন কাটে। শৈশবে ফিরে যাওয়া হয় না, ফিরে পাওয়াও যায় না তাকে। কেবল কাঁটার মতো বিঁধে থাকে একটু সুখের স্মৃতি।
- প্রবন্ধ রচনা : স্কুল-জীবনের স্মৃতি
- প্রবন্ধ রচনা : কলেজ জীবনের স্মৃতি
- প্রবন্ধ রচনা : একটি ঝড়ের রাত
- প্রবন্ধ রচনা : নদীতীরে সূর্যাস্ত
- প্রবন্ধ রচনা : বর্ষণমুখর একটি সন্ধ্যা
- প্রবন্ধ রচনা : জ্যোৎস্না রাতে
- প্রবন্ধ রচনা : একটি দিনের দিনলিপি
- প্রবন্ধ রচনা : যখন সন্ধ্যা নামে
- প্রবন্ধ রচনা : নগরজীবন
- প্রবন্ধ রচনা : সমুদ্র সৈকতে একদিন
- Composition : My Childhood
- Composition : A Memorable Day in Your Life
It's excellent. সবার শৈশবটা এরকম আননদময়ী। I wish Ican get that moment's again.
ReplyDeleteহৃদয় ছুঁয়ে গেল।
ReplyDelete