প্রবন্ধ রচনা : বর্ষণমুখর একটি সন্ধ্যা

↬ যখন সন্ধ্যা নামে

↬ আমার স্মরণীয় দিন


“মন যূথীবনে শ্রাবণ মেঘের
সজল পরশ লেগেছে,
তৃষাতুর মন-অঙ্গনে যেন
প্রথম বরষা নেমেছে।”
                                                       -রবীন্দ্রনাথঠাকুর
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। কখনো টিপটিপ করে কখনো জোরেসোরে। সারাটা দুপুর ঘুমিয়ে কাটালাম। জেগে উঠলাম জলের ঝাপটায়। দেখি বাইরে তুমুল বৃষ্টি, সেই সাথে হাওয়া। জানালার পাশে আমার ছোট্ট বিছানাটাকে মনে হলো নৌকা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। আজকের সন্ধ্যাটা বর্ষণে বর্ষণে মুখরিত।

ঘরের ভেতর কিছুটা জমাট অন্ধকার। সময়ের আগেই আজ সন্ধ্যা নেমেছে। বৃষ্টির জোর কমে নি তবে হাওয়া কমেছে। হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা করে ছোট্ট বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড শব্দে কোথাও বাজ পড়ল, ইলেট্রিসিটি চলে গিয়ে পুরো শহর অন্ধকারে ডুবে রইল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম এক অপার্থিব দৃশ্য, একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। আজ আষাঢ়ের কত তারিখ? মধ্য আষাঢ়, এটা জানি। বহু বছর আগে এমনি দিনে একনি এক সময়ে হয়তো কবিগুরু লিখেছিলেন-
আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে।
বাঁধন-হারা বৃষ্টি ধারা ঝরছে রয়ে রয়ে-
একলা বসে ঘরের কোণে কী যে ভাবি আপন-মনে,
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে-
কিংবা এমনও হতে পারে, গ্রীষ্মের কাঁঠালপাকা গরমে মধ্য দুপুরে বসেই কবি রচনা করেছিলেন এটি। কল্পনাই তো কবিদের রচনার অন্যতম উৎস। মনে হলো জেনে নিই, ঘরে তো রবীন্দ্র রচনাবলি আছেই। তবু এক পা নড়তে ইচ্ছে হলো না। মন বলল, আজ নয়, অন্য কোনো দিন, অন্য কোনো সময়ে। আজ তো ‘মন হারাবার বেলা, পথ ভুলিবার খেলা’।

বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। বর্ষা নিয়ে বিস্তর লেখা আমি পড়েছি। সেসব লেখার যূথী বন, কেয়া ঝোপ, কদম ফুলের কথা এসেছে বিভিন্নভাবে। আচ্ছা, যূথী বন কেমন হয়? কেয়া ঝোপের আশেপাশে কি সারাক্ষণ কেয়া ফুলের সুরভি ভেসে বেড়ায়? কদম ফুলে ছেয়ে যাওয়া একটা গাছ দেখা হলো না বলে এই মুহূর্তে জীবনটাকে মনে হচ্ছে ‘ষোল আনাই মিছে’

ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। সড়কবাতিগুলো জ্বলছে। নাগরিক সভ্যতায় ভেসে যাওয়া ঝলমল শহরের সড়কের দু’ধারে অসংখ্য দোকানপাট। এই ভরা বাদলে রাস্তায় লোকজন খানিকটা কম। যারা বেরিয়েছে নিতান্ত প্রয়োজনেই বেরিয়েছে। একটু আগে বাবা-মা ফিরেছে কাজ সেরে। আজ রাতে ইলিশ-পোলাও হবে। সারাদিন চারটে কি পাঁচটে মাছওয়ালা ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ ফেরি করেছে। বাবা ঘরে ফিরেই দৈনিক পত্রিকা নিয়ে বসলেন। মা রান্না সামলাতে রান্নাঘরে। আমি বললাম, রাখ তোমাদের কাজ, বারান্দায় এসে দাঁড়াও, বৃষ্টি দেখ। আমার কথায় বাবা ফিরেও তাকালেন না। মা উল্টা আমাকে ধমক দিলেন, “বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা হচ্ছে, সর্দি জ্বর বাঁধাতে চাস? শিগগির ঘরে আয়।” আমি বললাম, “দোহাই মা, তোমার পায়ে পড়ি, আজ আমার কিচ্ছু বলো না। তুমি বরং মুড়ি ভেজে দাও।” আমার কথায় মা হেসে ফেললেন, ভুবনজয়ী হাসি। সুতরাং আবার আমি বারান্দায়। মনে পড়ে গেল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র কথা। সত্যজিৎ রায়ের চিত্রায়ণে ছবিটি আমি ছ’বার দেখেছি, আবারও দেখতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় ‘দুর্গা’ হয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে মাথার চুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচি। ডুবসাঁতারে পুকুরের মাঝখানে গিয়ে শালুক তুলে আনি।

অন্যসব দিন সন্ধ্যার এ মুহূর্তে ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’। আজ হয়তো পাখিরা বেরুতেই পারে না। তাই বাতাসে পাখিদের কলরব নেই, নেই কাকের কর্কশ স্বর। আজ কেবল বৃষ্টির ধ্বনি- রিমঝিম, রিমঝিম।

ডোর-বেলের আওয়াজ হঠাৎ চমকে গেলাম। দরজা খুলে দেখি আমাদের বাসায় যে মহিলা কাজ করে তার মেয়ে। জানিয়ে গেল ওর মা আজ আসতে পারবে না। বৃষ্টির পানি ওদের কাঁচাঘরে ঢুকে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বর্ষা কারো কারো জন্যে বিলাসিতা, কারো জন্যে বেদনা আর আতঙ্ক। মনে পড়ল গত বছর এমনি এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির কাছেই পাহাড় ধরে কাঁচাঘর ভেঙে অনেক অসহায় গরিব লোক মারা গেছে। আজ আমি বৃষ্টি দেখে দেখে স্মৃতির সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছি আর এই মেয়েটি এই সন্ধ্যায় মোকাবেলা করবে কঠিন বাস্তবের। মনে হলো, শহরের ফুপাতে, রেল স্টেশনে কিংবা বাস টার্মিনালে প্রচুর গৃহহারা, আশ্রয়হীন লোক থাকে। এই বিরামহীন অঝোর বৃষ্টিতে কী করছে ওরা? কী করছে অসহায় দিনমজুরেরা? আজ সারাদিন এদের অনেকেই হয়তো কোনো কাজ পায় নি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওরা কি আজ অভুক্ত থাকবে? আজ মনটা বেহিসেবি রকমের এলোমেলো লাগছে। কোথাও যেন একটুকু স্থির হয়ে বসছে না। মা গরম গরম মুড়ি ভাজা দিয়ে গেল। আমাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগানটায় পানি জমে গেছে, গাছগুলো ভিজে নুয়ে পড়েছে। তবে সবুজ পাতাগুলো একেবারে পরিষ্কার, ঝকঝকে। টবের গোলাপ গাছটায় দুটো গোলাপ ফুটেছিল। কেন যে আগেই কেটে আনলাম না। চুপসে যাওয়া গোলাপ দুটোকে দেখে মায়া হলো ভীষণ। আমি নিজেও অনেকটা ভিজে গেছি। একটু একটু ঠাণ্ডাও লাগছে। আরেক কাপ চা খেতে পেলে মন্দ হতো না। ঝালমুড়ি আর চা। সেই সাথে যদি থাকত টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। ঝমঝম শব্দ হতো টিনের চালে। সেই শব্দে ভেতরের আমরা কেউ কারো কথা শুনতে পেতাম না।

ভাবছিলাম গ্রামে বৃষ্টি কেমন রূপ নিয়ে আসে সে কথা। শুনেছি, তবে দেখি নি কখনো। আজ, এই সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই বাংলাদেশের কোনো-না-কোনো গ্রামে এমনই বৃষ্টি হচ্ছে। এখন তো আষাঢ় মাস। গ্রামের পথঘাট কাদাজলে পিছল। ভর সন্ধ্যার এই আষাঢ় মোড়লের দহলিজে হুঁকো তামাক নিয়ে আসর বসেছে গল্পের। আর বৌ-ঝিরা হাতের সব কাজ সেরে নিয়েছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আজ আর পাড়া বেড়ানোর উপায় নেই। তাই ঘরে বসে অবসরে সেলাই করছে নকশি কাঁথা কিংবা বালিশের ঢাকনায় রঙিন ফুল। কোনো বউ হয়তো হারিয়ে গেছে তার শৈশব, কৈশোরে- বাপের বাড়ির উঠোনে কী চমৎকার বৃষ্টিতে ভেজা হতো।

মার ডাকে হঠাৎ ঘোর ভাঙল। কর্মব্যস্ত শহরে একটি বাড়িতে দাঁড়িয়েও আমি চলে গিয়েছিলাম নাম না জানা ছোট্ট সবুজ গ্রামে, খানিকক্ষণের জন্যে। মার হাতে ধুমায়িত চায়ের কাপ দেখে মন আনন্দে নেচে উঠল।

ক’টা বাজল কী জানি। তবে সন্ধ্যা উতরে গেছে। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে যে ঘন কালো মেঘে পুরো আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল তার অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।

বৃষ্টির তেজও কমে গেছে। বিষন্ন আকাশ অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে এখন যেন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। একসময় বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেল। আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠল মানুষ। রিকশার টুংটাং, বাস, টেম্পু আর গাড়ির হর্ন শোনা যেতে লাগল। আবার সেই একঘেয়ে শহুরে বাস্তবতা। কিছুক্ষণের জন্যে প্রকৃতির সাথে এক হয়ে মিশে গিয়েছিলাম। এই পাওয়াটুকুই বা কম কী?

বারান্দা ছেড়ে ঘরের ভেতর যাব। আকাশ তাকিয়ে দেখি মেঘের ফাঁকে রূপোর থালার মতো বিশাল চাঁদ। একটু দেখা দিয়েই আবার হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। আজ বুঝি আষাঢ়ে পূর্ণিমা। চট করে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের গান-
“ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা আমার, আজি রইলে আড়ালে-
স্বপনের আবরণে লুকিয়ে দাঁড়ালে-”
গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ঘরের ভেতরে এলাম। ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে সরষে ইলিশের ঘ্রাণ।


4 Comments

  1. Wow...honestly probably the best bangla essay I've ever read....it felt like I was envisioning all these... You are a great story teller...keep it up...and I'm looking forward to read more of your stories

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল একটি রচনা ছিল꫰꫰ ধন্যবাদ

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post