↬ নদীমাতৃক বাংলাদেশ
↬ নদী ভাঙন
ভূমিকা : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের নদীমালা এর গর্ব। এ দেশের ওপর দিয়ে ছোট-বড় প্রায় ৭০০টি নদ-নদী বয়ে গেছে। নদীবহুল দেশ বলে স্বভাবতই এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর দিয়ে নদীর প্রভাব রয়েছে। উপনদী ও শাখানদীসহ বাংলাদেশে নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪,১৪০ কিলোমিটার। নদীর কারণেই আমাদের দেশ সুজলা-সুফলা ও শস্য-শ্যামলা।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদী : বাংলাদেশের সবগুলো নদীর একটি পূর্ণঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা বেশ কঠিন। ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়া, আঁকাবাঁকা মৌসুমি খাড়ি, কর্দমপূর্ণ খালবিল, যথার্থ দৃষ্টিনন্দন নদ-নদী ও ওদের উপনদী এবং শাখানদীর সমন্বয়ে বাংলাদেশের বিশাল নদীব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কিছু কিছু স্থান যেমন, পটুয়াখালি, বরিশাল এবং সুন্দরবন অঞ্চলে নদীনালা এত বেশি যে সে অঞ্চলে প্রকৃতই নদীজালিকার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদীগুলো হল-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রধান নদীর পরিচয় তুলে ধরা হল-
পদ্মা : বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী পদ্মা। গঙ্গা নদী হিমালয়ের সঙ্গোত্রী হিমবাহ হতে উৎপন্ন হয়েছে। এটি প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও পরে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে ভারতের হরিদ্বারের নিকট সমভূমিতে পড়েছে। এরপর ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ান নামক স্থানে ভাগীরথী নামে এর একটি শাখা বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ রাজশাহী অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে গঙ্গা নদীটি পদ্মা নামে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমানা বরাবর এসে কুষ্টিয়ার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর দৌলতদিয়ার নিকট যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ মিলিত ধারা পদ্মা নামেই দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই তিন নদীর মিলিত স্রোত মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
কুমার, মাথাভাঙা, ভৈরব, গড়াই, মধুমতী ও আড়িয়াল খাঁ প্রভৃতি পদ্মার প্রধান শাখানদী। মহানন্দা প্রধান উপনদী। পুনর্ভরা, নাগর, পাগলা, কুলিক, ট্যাংগন মহানন্দার উপনদী।
ব্রহ্মপুত্র : এ নদী হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকট মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে তিব্বতের ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে ও পরে আসামের ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিক প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতঃপর দেওয়ানগঞ্জের কাছে দক্ষিণ-পূর্বে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পতিত হয়েছে। ধরলা ও তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের প্রধান উপনদী। বংশী ও শীতলক্ষ্যা প্রধান শাখা নদী।
যমুনা : বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা যমুনা নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ধরলা, তিস্তা, করতোয়া ও আত্রাই যমুনার উপনদী। ধলেশ্বরী এর শাখানদী এবং ধলেশ্বরীর শাখানদী বুড়িগঙ্গা।
মেঘনা : আসামের বরাক নদী নাগা মনিপুর অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের সিলেট জেলায় প্রবেশ করেছে। উত্তরের শাখা সুরমা পশ্চিম দিকে ছাতক, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আজমিরিগঞ্জের কাছ উত্তর সিলেটের সুরমা, দক্ষিণ সিলেটের কুশিয়ারা নদী এবং হবিগঞ্জের কালনী নদী একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। পরে সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহ কালনী নামে দক্ষিণে কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। মেঘনা ভৈরববাজারে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে এবং চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। গোমতি, তিতাস, মনু, বাউলাই প্রভৃতি মেঘনার উপনদী।
কর্ণফুলী : আসামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এটি প্রায় ২৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ।
হালদা, বোয়ালখালি ও কাসালং কর্ণফুলীর প্রধান উপনদী। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশের প্রধান নদী বন্দর চট্টগ্রাম এ নদীর তীরে অবস্থিত।
সাঙ্গু : এ নদী মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমার আরাকানের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বান্দরবান ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলী নদীর মোহনার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
ফেনী : এ নদী পার্বত্য ত্রিপুরায় উৎপন্ন হয়ে ফেনী জেলার পূর্ব সীমানা দিয়ে সন্দীপের উত্তরে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের নদীমালার মধ্যে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ বিশ্বের ২২তম (২,৮৫০ কিমি) এবং গঙ্গা (পদ্মা) নদী ৩০তম (২,৫২০ কিমি) স্থানের অধিকারী।
নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা : নদীপথে যাতায়াত সুবিধা এবং নদী উপত্যকাসমূহের পলিমাটি উৎকৃষ্ট কৃষিজমি হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতাসমূহ নদী উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। নাব্য নদ-নদীসমূহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নগর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রধান শহর, নগর ও বাণিজ্যকেন্দ্রসমূহ বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে উঠেছে, যেমন- বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা মহানগরী, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দর, কর্ণফুলি নদীর তীরে চট্টগ্রাম, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ময়মনসিংহ শহর গড়ে উঠেছে। পর্যাপ্ত প্রবাহ, গতিবেগ এবং নতিমাত্রাবিশিষ্ট নদী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কাপ্তাই নামক স্থানে কর্নফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎন্ন করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সত্যিই বাংলাদেশের নদীমালা এর গর্ব।
উপকারিতা : ইতিহাসের সুদূর অতীত থেকেই বাংলাদেশ শস্য-শ্যামলা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন। তার মূলে রয়েছে নদ-নদীর অবদান। এ দেশের অধিকাংশ নদী দক্ষিণমুখী প্রবাহিত। চাষাবাদের জন্য পানির প্রধান উৎস এবং বাণিজ্যিক পরিবহণ পথ হিসেবে নদীগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়া নদীগুলো স্বাদুপানির মাছের গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ মৎস্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আঁকাবাঁকা সর্পিল নদীর তীরভাঙন ও নিয়মিত বন্যা জনগণের জন্য অপরিমেয় দুঃখকষ্টের সৃষ্টি করে এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার নদীপ্রণালীগুলো দেশের কৃষিভূমিতে পলি ছড়িয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক উর্বরতা ব্যবস্থা করে থাকে। নদীগুলো প্রতিবছর প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন পলি বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করে যার ফলে সমুদ্রমুখ বরাবর গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ভূমি। মৌসুমি বায়ু প্রবাহকালীন নদীগুলো সাগরে অতিরিক্ত পানি নির্গমন করে থাকে। এভাবে বিশাল নদী প্রণালীসমূহ একই সঙ্গে দেশের আর্শীবাদ আবার বিপর্যয়সৃষ্টিকারীও বটে।
অপকারিতা : নদীগুলো এঁকেবেঁকে চলে। বাঁক ফিরতে স্রোতের চাপ এক পাড়ে গিয়ে পড়ে। তখন সেই পাড়ে ভাঙন শুরু হয়। বর্ষাকালে নদীতে স্রোতের বেগ বাড়ে। তখন নদীর ভাঙন বেশি হয়। কোন কোন স্থানে দেখা যায় ভাঙতে ভাঙতে গ্রামের পর গ্রাম নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। সে সকল এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। তাতে তাদের খুব কষ্ট হয় এবং অনেক ক্ষতি হয়।
নদীভাঙন ও নদীভাঙনে আর্থ-সামাজিক প্রভাব : নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি স্থানীয় ও পুনঃসংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছর নদী ভাঙনের কারণে লক্ষ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট প্লাবনভূমির প্রায় ৫% প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৪৮৯টি থানার মধ্যে প্রায় ৯৪টি থানায় নদীভাঙন ঘটেছে। কোন কোনও বিশেষজ্ঞ এর সঙ্গে আরও ৫৬টি থানার সন্ধান পেয়েছেন যেখানে নদীভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি থানায় নদীভাঙন ও বন্যার দুর্ভোগ প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি থানা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশ অবজার্ভার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে ১৬টি জেলায় ২৫০০০-এর বেশি পরিবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে বাস্তুভিটাচ্যুত হয়েছে।
নদীভাঙনের আর্থসামাজিক প্র্যভাব মারাত্মক। উল্লেখ্য, অধিকাংশ নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন একে প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে ধরে নেয়। আবার অনেকে ‘আল্লাহর গজব’ বলে এই দুর্যোগকে মেনে নিয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিবর্তে দোয়া-মানত ইত্যাদির শরণাপন্ন হয়। আজ জাতীয় দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ এই নদীভাঙন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীভাঙনের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং বিপদাপন্ন লোকের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের জমি, বসতভিটা, ফসল, গবাদি সম্পদ, গাছপালা, গৃহসামগ্রী সবকিছুই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত মানুষ ভূমিহীনের কাতারে সামিল হয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার হয়। এর ফলে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক পঞ্চাশ কোটি ডলার। প্রায় ৩ লক্ষ গৃহহীন পরিবার উন্মুক্ত আকাশের নিচে, পথের পাশে, বাঁধ, ফুটপাত ও সরকারের খাস জমিতে এসে আশ্রয় নেয়। গরীব, ধনী নির্বিশেষে সবাই এই নদীভাঙনের শিকার হয়। বড় ও মাঝারি জোতদার কৃষকরা বেশি জমির মালিক বিধায় তারা ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন চাষির ক্ষতির ভাগ কম। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙনের ফলে গ্রামীণ কৃষিকাজ দারুণভাবে ব্যাহত হয়। বসতভিটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমি, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। বিপন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষি আয় কমে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা সম্পদ হারিয়ে জমানো সঞ্চয়ের ওপর হাত বাড়ায় এবং প্রায়শই নতুন ঋণে জড়িয়ে পড়ে। গবেষকদের মতে, ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ভূমির পরিমাণ নদীর তলদেশ থেকে জেগে ওঠা নতুন ভূমির পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি।
উপসংহার : বাংলাদেশের নদী বাংলাদেশের গৌরব। নদীর কারণেই আমাদের দেশ হতে পেরেছে সমৃদ্ধশালী। তবে দুঃখের বিষয় নদীগুলো এখন ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীগুলোকে নাব্য জল প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য আমাদের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কারণ নদী আমাদের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গণ্য।
[ একই প্রবন্ধ আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]
ভূমিকা : সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে খ্যাতি তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নদীর। ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী বয়ে গেছে এ দেশের ওপর দিয়ে। বাড়িয়েছে দেশের সৌন্দর্য। আর এইসব নদী-বিধৌত পলি, বালি, কাঁকর প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলা অববাহিকা। বাঙালির জীবন-যাত্রায় আর সংস্কৃতিতে এইসব নদ-নদীর প্রভাব অপরিসীম।
নদীর জন্ম ও প্রবাহ : অধিকাংশ নদীর জন্ম হয় হিমবাহ থেকে। এ ছাড়া হ্রদ বা ঝরণা এবং প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের অঞ্চল থেকেও নদীর জন্ম হতে পারে। যেখান থেকে নদীর জন্ম হয় তাকে বলে নদীর উৎস। নদী যেখানে সাগরের সাথে মেশে সে অংশকে বলা হয় মোহনা। চলার পথে দুপাশ থেকে কিছু কিছু ছোট ও মাঝারি নদী বড় নদীর জল প্রবাহের সাথে মেশে, সেগুলো উপনদী হিসেবে পরিচিত। আবার নদী থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যেসব নদী সাগরে মেশে সেগুলো শাখা নদী। বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সাঙ্গু, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, কপোতক্ষ, ধলেশ্বরী এবং এদের উপনদী ও শাখানদীগুলো জালের মতো বিস্তৃত রয়েছে সারা বাংলাদেশ জুড়ে। তাই এ দেশকে বলা হয় নদী-মাতৃক দেশ।
বাংলাদেশের নদ-নদী : পদ্মা, মেঘনা, যমুনা- এই প্রধান তিনটি নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। এ ছাড়া ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী এ দেশের ভূ-প্রকৃতি, মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে প্রবাহিত সব নদ-নদীই আন্তর্জাতিক। অর্থাৎ উৎস বাংলাদেশের বাইরে। কিন্তু সবগুলো নদীই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। কিছু কিছু নদীর উৎপাত্তি হিমালয় পর্বত থেকে, কিছু কিছু নদী অ-হিমালীয়। মিমালীয় নদীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্মা, যমুনা। আর অ-হিমালীয় নদীগুলো মধ্যে কর্ণফুলী, মেঘনা, মাতামুহুরী আর সাঙ্গু উল্লেখযোগ্য।
এই প্রধান নদীগুলোর বেশ কিছু শাখা নদী ও উপনদী রয়েছে। যেমন যমুনার একটি শাখা ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান উপনদীগুলো হলো তিস্তা, করতোয়া, ধরলা, আত্রাই ইত্যাদি। পদ্মার প্রধান উপনদীগুলোর মধ্যে মহানন্দা আর পুনর্ভবা উল্লেখযোগ্য। আর শাখানদীগুলো হলো : অড়িয়াল খাঁ, কুমার, গড়াই ও মাথাভাঙ্গা।
অ-হিমালীয় নদীগুলোর মধ্যে ‘কর্ণফুলী ও মেঘনার উৎপত্তি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে। কর্ণফুলীর উপনদীগুলোর মধ্যে মাইনি, কাসালং, চিংড়ি, এবং রানখিয়াং প্রধান। মেঘনার প্রধান উপনদী কংস, সোমেশ্বরী ও গোমতি। আর শাখা নদীর মধ্যে তিতাস ও ডাকাতিয়া উল্লেখ যোগ্য। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য নদীগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, ভেরব, ধলেশ্বরী, রূপসা, চিত্রা, গোমতি, পুনর্ভবা প্রবৃতি উল্লেখযোগ্য।
জননীবনে নদীর ভূমিকা : বাংলার অপরূপ প্রাকৃতি আর উর্বর ভূমি অজস্র নদীরই দান। বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ সমভূমি বলা হয়ে থাকে। এই ব-দ্বীপ নদী দ্বারাই সৃষ্ট। নদীতীরে গড়ে উঠেছে বড় বড় নগর বা বন্দর। এদেশের মানুষের খাদ্য, পোশাক সর্বোপরী সংস্কৃতি নদীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নদী-তীরবর্তী উল্লেখযোগ্য শহর, বন্দর ও বাণিজ্য স্থানের মধ্যে রয়েছে বাহাদুরাবাদ, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, গোয়ালন্দ, সিলেট, ভৈরব, চাঁদপুর, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা, পাবনা, কুষ্টিয়া, খুলনা, মংলা, চট্টগ্রাম, চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই, লামা প্রভৃতি।
নদীর জল একদিকে বাংলার মাটিকে সরস ও উর্বর করেছে, সেই সাথে মাটির নিচের জলাধার রেখেছে ভরপুর করে। বৃষ্টি আর নদীর জলেই বাংলার প্রকৃতি এতো সবুজ, এতো সজীব। নদীর জল থেকেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় পানীয় জল তৈরি করা হয়। নদীর দুরন্ত গতিপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ যা ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন আচল। চাষাবাদের জলেরও অনেকটাই আমরা পাই নদী থেকে। এ দেশের মৎস সম্পদের অন্যতম প্রধান উৎস নদী। আর বাংলা সাহিত্যে গল্প-উপন্যাস, কবিতা আর গানে এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নদী। তাই বলা চলে, বাঙালির জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে এ দেশের নদ-নদী।
নদী যখন দুঃখের কারণ : শ্যাম-স্নিগ্ধ নদী কখনো কখনো দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাঙনের বিধ্বংসী বিপর্যয় নিয়ে গ্রাস করে মানুষের ভিটেমাটি। কখনো আবার প্রবল গতিতে ভয়ংকর মূর্তিতে এগিয়ে চলে। ডুবে যায় গ্রামের পর গ্রাম, জনপদ। দেখা দেয় বন্যা। বন্যার ভয়াবহতা অনেক প্রাণহানী ঘটে। অনেকে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রয়োজন ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়ানো এবং নদী তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি।
নদী দূষণ : বাংলাদেশের শহরের কোলঘেঁষা বেশ কিছু নদী বর্তমানে মারাত্মক দূষণের শিকার। শহরের ময়লা আবর্জনা, শিল্পবর্জ্য, বসতবাড়ির আবর্জনা ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নদীগুলোকে বিষাক্ত বর্জ্যের বহমান আধারে পরিণত করে চলেছে। তার উপর রয়েছে নদী তীরে অবৈধ স্থাপনা। এতে নদীগুলো ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে এবং বিপন্ন হতে চলেছে নদীর মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদ। সর্বোপরি নদী নিজস্ব নাব্যতা হারাচ্ছে। এ ধরনের দূষণ প্রতিরোধে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জনসচেতনতা।
উপসংহার : বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো স্নেহময়ী মায়ের মতোই। নদীর অকৃত্রিম ভালোবাসার দানে এ দেশ পরিপূর্ণ। ‘মাছে-ভাতে’ বাঙালি বলে যে কথাটি চালু হয়েছে তা-ও এই নদীর দানেই। তাই এইসব নদীর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। কেননা নদী বিপর্যস্ত হলে বাংলার প্রকৃতিও বিপর্যস্ত হবে। আর এর নিষ্ঠুর প্রভাব পড়বে এ দেশের মানুষের ওপর।
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের পাখি
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের ফল
- প্রবন্ধ রচনা : গরু
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের জাতীয় গাছ : আম গাছ
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের জাতীয় মাছ : ইলিশ মাছ
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের জাতীয় ফুল : শাপলা
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের জাতীয় ফুল : শাপলা - [ Visit eNS ]
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের জাতীয় ফল : কাঁঠাল
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের জাতীয় পশু : বাঘ
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের গৃহপালিত পাখি
- প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল : ধান
- প্রবন্ধ রচনা : প্রাণিজগৎ
- প্রবন্ধ রচনা : চিড়িয়াখানা
আমার দেখা নদী রচনাটা দিলে উপক্রিত হতাম
ReplyDeleteamar dekha nodi rochona
ReplyDeleteWow! It is very nice.I can write this in my bengali project.
ReplyDeleteঅনুচ্ছেদ রচনা দিলে ভালো হতো
ReplyDeleteAmar dekha nodi (Jamuna) dile bhalo hoto..... 🤔🤔🤔🙄🙄🙄😌😌😌🙁🙁🙁😞😞😞😭😭😭😌😌😌
ReplyDeleteকয়েকটি নদনদীর বর্ণনা দিলে ভালো হতো
ReplyDeleteAmar dekha ekti nodi dile khub valo hoto
ReplyDeleteAmar dekha ekti nodi dile valo hoto
ReplyDelete